রাজা অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলে বিলাসবতী প্রবোধবাক্যে কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া স্নান ভোজনাদি সমাপন করিলেন। যে সকল আভরণ ফেলিয়া দিয়াছিলেন তাহা পুনর্ব্বার অঙ্গে ধারণ করিলেন। তদবধি দেবতার আরাধনা, ব্রাহ্মণের সেবা ও গুরু জনের পরিচর্য্যায় অতিশয় অনুরক্ত হইলেন। দৈবকর্ম্মে অনুরক্ত হইয়া চণ্ডিকার গৃহে প্রতিদিন ধূপ গুগ্গুল প্রভৃতি সুগন্ধ দ্রব্যের গন্ধ বিস্তার করেন। দিবসবিশেষে তথায় কুশাসনে শয়ন করিয়া থাকেন। প্রতিদিন প্রাতঃকালে ব্রাহ্মণদিগকে স্বর্ণপাত্র দান করেন। কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দ্দশী রজনীতে চতুষ্পথে দেবতাদিগকে বলি উপহার দেন। অশ্বত্থ প্রভৃতি বনস্পতিদিগকে প্রদক্ষিণ করেন। ষোড়শোপচারে ষষ্ঠীদেবীর পূজা দেন। ফলতঃ যে যেরূপ ব্রতের অনুষ্ঠান করিতে কহে, অতিশয় ক্লেশসাধ্য হইলেও অপত্যতৃষ্ণায় উহার অনুষ্ঠান করেন, কিছুতেই পরাঙ্মুখ হয়েন না। গণক অথবা সিদ্ধপুরুষ দেখিলে সমাদর পূর্ব্বক সন্তানের গণনা করান। রাত্রিতে যে সকল স্বপ্ন দেখেন, প্রভাতে পুরন্ধ্রীদিগকে তাহার ফলাফল জিজ্ঞাসা করেন।
এই রূপে কিছুদিন অতীত হইলে, একদা রাত্রিশেষে রাজা স্বপ্নে দেখিলেন, বিলাসবতী সৌধশিখরে শয়ন করিয়া আছেন, তাঁহার মুখমণ্ডলে পূর্ণচন্দ্র প্রবেশ করিতেছে। স্বপ্নদর্শনানন্তর অমনি জাগরিত হইয়া শীঘ্র শয্যা হইতে উঠিলেন। অনন্তর শুকনাসকে আহ্বান করিয়া তাঁহার সাক্ষাতে স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। শুকনাস শুনিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন ও প্রীতিপ্রফুল্ল বদনে কহিলেন, মহারাজ! বুঝি অনেক কালের পর আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইল। অচিরাৎ আপনি পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিয়া আনন্দিত হইবেন, সন্দেহ নাই। আমিও আজি রজনীতে স্বপ্নে প্রশান্তমূর্ত্তি, দিব্যাকৃতি এক ব্রাহ্মণকে মনোরমার উৎসঙ্গে বিকসিত পুণ্ডরীক নিক্ষেপ করিতে দেখিয়াছি। শাস্ত্রকারেরা কহেন, শুভ ফলোদয়ের পূর্ব্বে শুভ লক্ষণ সকল দেখিতে পাওয়া যায়। যদি আমাদিগের চিরপ্রার্থিত মনোরথ সম্পন্ন হয়, তাহা হইলে, ইহা অপেক্ষা আহ্লাদের বিষয় কি আছে? রাত্রিশেষে যে স্বপ্ন দেখা যায় তাহা প্রায় বিফল হয় না। রাজমহিষী বিলাসবতী অচিরাৎ পুত্ত্রসন্তান প্রসব করিবেন, সন্দেহ নাই। রাজা মন্ত্রীর স্বপ্নবৃত্তান্ত শ্রবণে অধিকতর আহ্লাদিত হইলেন এবং তাঁহার হস্তধারণ পূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া উভয়েই আপন আপন স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা রাজমহিষীর আনন্দোৎপাদন করিলেন।
কিছু দিন পরে বিলাসবতী গর্ভবতী হইলেন। শশধরের প্রতিবিম্ব পতিত হইলে সরোবর যেরূপ উজ্জ্বল হয়, পারিজাত কুসুম বিকসিত হইলে নন্দনবনের যেরূপ শোভা হয়, বিলাসবতী গর্ভ ধারণ করিয়া সেইরূপ অপূর্ব্বশ্রী প্রাপ্ত হইলেন। দিন দিন গর্ভের উপচয় হইতে লাগল। সলিলভারাক্রান্ত মেঘমালার ন্যায় বিলাসবতী গর্ভভারে মন্থরগতি হইলেন। মুখে বারংবার জৃম্ভিকা ও জল উঠিতে লাগিল। শরীর অলস ও পাণ্ডুবর্ণ হইল। এই সকল লক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া পরিজনেরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিল রাণী গর্ভিণী হইয়াছেন।
একদা প্রদোষ সময়ে শুকনাস ও রাজা রাজভবনে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কুলবর্দ্ধনানাম্নী প্রধান পরিচারিকা তথায় উপস্থিত হইয়া রাজার কর্ণে মহিষীর গর্ভসঞ্চারের সংবাদ কহিল। নরপতি শুভ সংবাদ শুনিয়া আনন্দের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন। আহ্লাদে কলেবর রোমাঞ্চিত ও কপোলমূল বিকসিত হইয়া উঠিল। তখন হর্ষোৎফুল্ল লোচনে শুকনাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে তিনি রাজার ও কুলবর্দ্ধনার আকৃতি দেখিয়াই অনুমান করিলেন রাজার অভীষ্ট সিদ্ধ হইয়াছে। তথাপি সন্দেহনিবারণের নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, মহারাজ! স্বপ্নদর্শন কি সফল হইয়াছে? রাজা কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, যদি কুলবর্দ্ধনার কথা মিথ্যা না হয় তাহা হইলে স্বপ্ন সফল বটে। চল, আমরা স্বয়ং গিয়া জানিয়া আসি। এই কথা বলিয়া গাত্র হইতে উন্মোচন করিয়া শুভ সংবাদের পারিতোষিকস্বরূপ বহুমূল্য অলঙ্কার কুলবর্দ্ধনাকে দিয়া বিদায় করিলেন। আপনারাও মহিষীর বাসভবনে চলিলেন। যাইতে যাইতে রাজার দক্ষিণ লোচন স্পন্দিত হইল।
তথায় গিয়া দেখিলেন, মহিষী গর্ভোচিত কোমল শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, গর্ভে সন্তানের উদয় হওয়াতে মেঘাবৃতশশিমণ্ডলশালিনী রজনীর ন্যায় শোভা পাইতেছেন। শিরোভাগে মঙ্গলকলস রহিয়াছে, চতুর্দ্দিকে মণির প্রদীপ জ্বলিতেছে এবং গৃহে শ্বেত সর্ষপ বিকীর্ণ আছে। রাণী রাজাকে দেখিয়া সসম্ভ্রমে শয্যা হইতে উঠিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, রাজা বারণ করিয়া কহিলেন, প্রিয়ে! আর কষ্ট পাইবার প্রয়োজন নাই। বিনা অভ্যুত্থানেই যথেষ্ট আদর প্রকাশ হইয়াছে। এই বলিয়া শয্যার এক পার্শ্বে বসিলেন। শুকনাস স্বতন্ত্র এক স্থানে উপবেশন করিলেন। রাজা মহিষীর আকার প্রকার দেখিয়াই গর্ভলক্ষণ জানিতে পারিলেন; তথাপি পরিহাস পূর্ব্বক কহিলেন, প্রিয়ে! শুকনাস জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কুলবর্দ্ধনা যাহা কহিয়া আসিল সত্য কি না? মহিষী লজ্জায় নম্রমুখী হইয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন। বারংবার জিজ্ঞাসা ও অনুরোধ করাতে কহিলেন, কেন আর আমাকে লজ্জা দাও, আমি কিছুই জানি না; এই বলিয়া পুনর্ব্বার অধোমুখী হইলেন। এইরূপ অনেক পরিহাসকথার পর শুকনাস আপন আলয়ে প্রস্থান করিলেন।