তারাপীড় এইরূপে সকল সুখের পার প্রাপ্ত হইয়াও সন্তানমুখাবলোকনরূপ সুখলাভ না হওয়াতে মনে মনে অতিশয় দুঃখিত থাকেন। সন্তান না হওয়াতে সংসারে অরণ্য জ্ঞান, জীবনে বিড়ম্বনা জ্ঞান ও শরীর ভারমাত্র বলিয়া বোধ হইয়াছিল এবং আপনাকে অসহায়, অনাশ্রয় ও হতভাগ্য বিবেচনা করিতেন। ফলতঃ তাঁহার পক্ষে সংসার অসার ও অন্ধকার রূপে প্রতীয়মান হইয়াছিল। নৃপতির বিলাসবতীনাম্নী পরমরূপবতী পত্নী ছিলেন। কন্দর্পের রতি ও শিবের পার্ব্বতী যেরূপ পরমপ্রণয়িনী, বিলাসবতীও সেইরূপ রাজার পরমপ্রণয়াস্পদ ছিলেন। একদা মহিষী অতিশয় দুঃখিত অন্তঃকরণে অন্তঃপুরে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে নরপতি তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মহিষী বামকরতলে কপোলদেশ সংস্থাপিত করিয়া বিষণ্ণ বদনে রোদন করিতেছেন; অঙ্গের ভূষণ অঙ্গ হইতে উন্মোচন করিয়া ফেলিয়া দিয়াছেন; অঙ্গরাগ বা অঙ্গসংস্কার কিছুমাত্র নাই। সখীগণ নিঃশব্দে ও দুঃখিত চিত্তে পার্শ্বে বসিয়া আছে। অন্তঃপুরবৃদ্ধারা অনতিদূরে উপবিষ্ট হইয়া প্রবোধবাক্যে আশ্বাস প্রদান করিতেছে। রাজা গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলে মহিষী আসন হইতে উঠিয়া সম্ভাষণ করিলেন। রাজাকে দেখিয়া তাঁহার দুঃখ দ্বিগুণতর হইল ও দুই চক্ষু দিয়া অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল। মহিষীর আকস্মিক শোক ও রোদনের কারণ কিছু বুঝিতে না পারিয়া নরপতি মনে মনে কত ভাবনা, কত শঙ্কা ও কল্পনা করিতে লাগিলেন। পরে আসনে উপবিষ্ট হইয়া বসন দ্বারা চক্ষুর জল মুছাইয়া দিয়া মধুর বাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, প্রিয়ে! কি নিমিত্ত বামকরে বামগণ্ড সংস্থাপন করিয়া বিষণ্ণবদনে ও দীননয়নে রোদন করিতেছ? তোমার দুঃখের কারণ কিছু জানিতে না পারিয়া আমার অন্তঃকরণ অতিশয় ব্যাকুল ও বিষণ্ণ হইতেছে। আমি কি কোন অপরাধ করিয়াছি? অথবা অন্য কেহ প্রজ্বলিত অনলশিখায় হস্তক্ষেপ করিয়া থাকিবেক? যাহা হউক শোকের কারণ বর্ণন করিয়া আমার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দূর কর।
রাজা এত অনুনয় করিলেন, বিলাসবতী কিছুই উত্তর দিলেন না—বরং আরও শোকাকুল হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। রাজ্ঞীর তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী বদ্ধাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল, মহারাজ! আপনি কোন অপরাধ করেন নাই এবং রাজমহিষীর নিকটে অন্যে অপরাধ করিবে এ কথাও অসম্ভব। মহিষী যে নিমিত্ত রোদন করিতেছেন তাহা শ্রবণ করুন। সন্তানের মুখাবলোকনরূপ সুখ লাভে বঞ্চিত হইয়া রাণী বহুদিবসাবধি শোকাকুল ছিলেন। কিন্তু মহারাজের মনঃপীড়া হইবে বলিয়া এত দিন দুঃখ প্রকাশ করেন নাই; মনের দুঃখ মনেই গোপন করিয়া রাখিয়াছিলেন। অদ্য চতুর্দ্দশী, মহাদেবের পূজা দিতে মহাকালের মন্দিরে গিয়াছিলেন, তথায় মহাভারত পাঠ হইতেছিল, তাহাতেই শুনিলেন সন্তানবিহীন ব্যক্তিদিগের সদ্গতি হয় না; পুত্ত্র না জন্মিলে পুন্নাম নরক হইতে উদ্ধারের উপায়ান্তর নাই, পুত্ত্রহীন ব্যক্তির ইহলোকে সুখ ও পরলোকে পরিত্রাণ পাইবার সম্ভাবনা নাই; তাহার জীবন, ধন, ঐশ্বর্য্য, সকলই নিষ্ফল। মহাভারতের এই কথা শুনিয়া অবধি রাজ্ঞী অতিশয় উন্মনা ও উৎকণ্ঠিতা হইলেন। বাটী আসিলে সকলে নানাপ্রকার প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিল ও আহার করিতে অনুরোধ করিল; কোন ক্রমেই শান্ত হইলেন না ও আহার করিলেন না। সেই অবধি কাহারও কোন কথার উত্তর দেন না, কাহারও সহিত আলাপ করেন না। কেবল বিষণ্ণবদনে অনবরত রোদন করিতেছেন। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য করুন।
তাম্বুলকরঙ্কবাহিনীর কথা শুনিয়া রাজা ক্ষণকাল নিস্তব্ধ ও নিরুত্তর হইয়া রহিলেন। পরে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, দেবি! দৈবায়ত্ত বিষয়ে শোক ও অনুতাপ করা কোন ক্রমেই বিধেয় নহে। মনুষ্যেরা যত যত্ন ও যত চেষ্টা করুক না কেন, দৈব অনুকূল না হইলে কোন প্রকারে মনোরথ সফল হয় না। পুত্ত্রের আলিঙ্গনে শরীর শীতল হইবে, মুখারবিন্দদর্শনে নেত্র পবিত্র হইবে, অপরিস্ফুট মধুর বচন শ্রবণে কর্ণ জুড়াইবে এমন কি পুণ্য কর্ম্ম করিয়াছি! জন্মান্তরে কত পাপ করিয়া থাকিব, সেই জন্যে এত মনস্তাপ উপস্থিত হইতেছে। দৈব অনুকূল না হইলে কোন অভীষ্টসিদ্ধির সম্ভাবনা নাই। অতএব দৈব কর্ম্মে অত্যন্ত অনুরক্ত হও। মনোযোগপূর্ব্বক গুরুভক্তি, দেবপূজা ও মহর্ষিদিগের পরিচর্য্যা কর। অবিচলিত ও অকৃত্রিম ভক্তিপূর্ব্বক ধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান কর। পুরাণে শুনিয়াছি, মগধদেশের রাজা বৃহদ্রথ সন্তানলাভের আশয়ে চণ্ডকৌশিকের আরাধনা করেন এবং তাঁহার বরপ্রভাবে জরাসন্ধনামে প্রবলপরাক্রান্ত এক পুত্ত্র প্রাপ্ত হন। রাজা দশরথ মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রসন্ন করিয়া রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন নামে মহাবলপরাক্রান্ত চারি পুত্ত্র লাভ করেন। ঋষিগণের আরাধনা কখন বিফল হয় না, অবশ্যই তাহার ফল দর্শে, সন্দেহ নাই। দৃঢ়ব্রত ও একান্ত অনুরক্ত হইয়া ভক্তিসহকারে দেব ও দেবর্ষিদিগের অর্চ্চনা কর তাহাতেই মনোরথ সফল হইবেক। হায়! কত দিনে সেই শুভ দিনের উদয় হইবে, যে দিনে স্নেহময় ও প্রীতিময় সন্তানের সুধাময় মুখচন্দ্র অবলোকন করিয়া জীবন ও নয়ন চরিতার্থ করিব; পরিজনেরা আনন্দে পূর্ণপাত্র গ্রহণ করিবে; নগর উৎসবময় হইয়া নৃত্য, গীত, বাদ্যের কোলাহলে পরিপূর্ণ হইবেক, শশিকলা উদিত হইলে গগনমণ্ডলের যেরূপ শোভা হয়, কত দিনে দেবী পুত্ত্র ক্রোড়ে করিয়া সেইরূপ শোভিত হইবেন; নিরপত্যতা এক্ষণে অতিশয় ক্লেশ দিতেছে। সংসার অরণ্য ও জগৎ শূন্য দেখিতেছি; রাজ্য ও ঐশ্বর্য্য নিষ্ফল বোধ হইতেছে। কিন্তু অপ্রতিবিধেয় বিষয়ে শোক ও দুঃখ করা বৃথা বলিয়াই ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক যথাকথঞ্চিৎ সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছি। এইরূপ নানা প্রবোধবাক্যে আশ্বাস দিয়া স্বহস্তে মহিষীর নেত্রজল মোচন করিয়া দিলেন। অনেক ক্ষণ অন্তঃপুরে থাকিয়া পরে বহির্গত হইলেন।