মৃগয়াকোলাহল নিবৃত্ত হইলে অরণ্যানী নিস্তব্ধ হইল। তখন আমি পিতার পক্ষপুট হইতে আস্তে আস্তে বিনির্গত হইয়া কোটর হইতে মুখ বাড়াইয়া যে দিকে কোলাহল হইতেছিল সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম কৃতান্তের সহোদরের ন্যায়, পাপের সারথির ন্যায়, নরকের দ্বারপালের ন্যায় বিকটমূর্ত্তি এক সেনাপতি সমভিব্যাহারে যমদূতের ন্যায় কতকগুলি কুরূপ ও কদাকার শবরসৈন্য আসিতেছে। তাহাদিগকে দেখিলে ভূতবেষ্টিত ভৈরব ও দূতমধ্যবর্ত্তী কালান্তকের স্মরণ হয়। সেনাপতির নাম মাতঙ্গ পশ্চাৎ অবগত হইলাম। সুরাপানে দুই চক্ষু জবাবর্ণ; সর্ব্বশরীরে বিন্দু বিন্দু রক্তকণিকা লাগিয়াছে; সঙ্গে কতকগুলি বড় বড় শিকারী কুকুর আছে। তাহাকে দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন বিকটাকার অসুর বন্য পশু ধরিয়া খাইতে আসিয়াছে। শবরসৈন্য অবলোকন করিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলাম যে, ইহারা কি দুরাচার ও দুষ্কর্ম্মান্বিত। জনশূন্য অরণ্য ইহাদিগের বাসস্থান, মদ্য মাংস আহার, ধনুঃ ধন, কুক্কুর সুহৃৎ, ব্যাঘ্র ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুর সহিত একত্র বাস এবং পশুদিগের প্রাণবধ করাই জীবিকা ও ব্যবসায়। অন্তঃকরণে দয়ার লেশ নাই, অধর্ম্মের ভয় নাই ও সদাচারে প্রবৃত্তি নাই। ইহারা সাধুবিগর্হিত পথ অবলম্বন করিয়া সকলের নিকটে নিন্দাস্পদ ও ঘৃণাস্পদ হইতেছে, সন্দেহ নাই। এইরূপ চিন্তা করিতেছিলাম এমন সময়ে মৃগয়াজন্য শ্রান্তি দূর করিবার নিমিত্ত তাহারা আমাদিগের আবাসতরুতলের ছায়ায় আসিয়া উপবিষ্ট হইল। অনতিদূরস্থিত সরোবর হইতে জল ও মৃণাল আনিয়া পিপাসা ও ক্ষুধা শান্তি করিল। শ্রান্তি দূর করিয়া চলিয়া গেল।
শবরসৈন্যের মধ্যে এক বৃদ্ধ সে দিন কিছুই শিকার করিতে পারে নাই ও মাংস প্রভৃতি কিছুই পায় নাই; সে উহাদিগের সঙ্গে না গিয়া তরুতলে দণ্ডায়মান থাকিল। সকলে দৃষ্টিপথের অগোচর হইলে, রক্তবর্ণ দুইচক্ষু দ্বারা সেই তরুর মূল অবধি অগ্রভাগ পর্য্যন্ত এক বার নিরীক্ষণ করিল। তাহার নেত্রপতনমাত্রেই কোটরস্থিত পক্ষিশাবকদিগের প্রাণ উড়িয়া গেল। হায়, নৃশংসের অসাধ্য কি আছে! সোপানশ্রেণীতে পাদক্ষেপ পূর্ব্বক অট্টালিকায় যেরূপ অনায়াসে উঠা যায়, নৃশংস কণ্টকাকীর্ণ দুরারোহ সেই প্রকাণ্ড মহীরুহে সেইরূপ অবলীলাক্রমে আরোহণ করিল এবং কোটরে কর প্রসারিত করিয়া পক্ষিশাবকদিগকে ধরিয়া একে একে বহির্গত করিয়া প্রাণসংহারপূর্ব্বক ভূতলে নিক্ষেপ করিতে লাগিল। পিতার একে বৃদ্ধ বয়স, তাহাতে অকস্মাৎ এ বিষম সঙ্কট উপস্থিত হওয়াতে নিতান্ত ভীত হইলেন। ভয়ে কলেবর দ্বিগুণ কাঁপিতে লাগিল এবং তালুদেশ শুষ্ক হইয়া গেল। ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন কিন্তু প্রতীকারের কোন উপায় না দেখিয়া আমাকে পক্ষপুটে আচ্ছাদন করিলেন ও আপন বক্ষস্থলের নিম্নে লুকাইয়া রাখিলেন। আমাকে যখন পক্ষপুটে আচ্ছাদন করেন তখন দেখিলাম তাঁহার নয়নযুগল হইতে জলধারা পড়িতেছে। নৃশংস, ক্রমে ক্রমে আমাদিগের কুলায়ের সমীপবর্ত্তী হইয়া কালসর্পাকার বামকর কোটরে প্রবেশিত করিয়া পিতাকে ধরিল। তিনি চঞ্চুপুট দ্বারা যথাশক্তি আঘাত ও দংশন করিলেন, কিছুতেই ছাড়িল না। কোটর হইতে বহির্গত করিল, যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দিল, পরিশেষে প্রাণ বিনষ্ট করিয়া নিম্নে নিক্ষেপ করিল। পিতার পক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত ও ভয় সঙ্কুচিত হইয়াছিলাম বলিয়া আমাকে দেখিতে পাইল না। ঐ তরুতলে শুষ্ক পর্ণরাশি একত্রিত ছিল তাহারই উপর পতিত হইলাম, অধিক আঘাত লাগিল না।
অধিক বয়স না হইলে অন্তঃকরণে স্নেহের সঞ্চার হয় না কিন্তু ভয়ের সঞ্চার জন্মাবধিই হইয়া থাকে। শৈশব প্রযুক্ত আমার অন্তঃকরণে স্নেহসঞ্চার না হওয়াতে কেবল ভয়েরই পরতন্ত্র হইলাম। প্রাণ পরিত্যাগের উপযুক্ত কালেও নিতান্ত নৃশংস ও নির্দ্দয়ের ন্যায় উপরত পিতাকে পরিত্যাগ করিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। অস্থির চরণ ও অসমগ্রোদিত পক্ষপুটের সাহায্যে আস্তে আস্তে গমন করিবার উদ্যোগ করাতে বারংবার ভূতলে পড়িতে ও তথা হইতে উঠিতে লাগিলাম। ভাবিলাম বুঝি এ যাত্রায় কৃতান্তের করাল গ্রাস হইতে পরিত্রাণ হইল। পরিশেষে মন্দ মন্দ গমন করিয়া নিকটস্থিত এক তমাল তরুর মূলদেশে লুকাইলাম। এমন সময়ে সেই নৃশংস চণ্ডাল শাল্মলীবৃক্ষ হইতে নামিয়া পক্ষিশাবকদিগকে একত্রিত ও লতাপাশে বদ্ধ করিল এবং যে পথে শবরসৈন্যেরা গিয়াছিল সেই পথ দিয়া চলিয়া গেল।
দূর হইতে পতিত ও ভয়ে নিতান্ত অভিভূত হওয়াতে আমার কলেবর কম্পিত হইতেছিল; আবার বলবতী পিপাসা কণ্ঠশোষ করিল। এতক্ষণে পিশাচ অনেক দূর গিয়া থাকিবে এই সম্ভাবনা করিয়া মুখ বাড়াইয়া চতুর্দ্দিক অবলোকন করিতে লাগিলাম। কোন দিকে কোন শব্দ শুনিবামাত্র অমনি শঙ্কিত হইয়া পদে পদে বিপদ্ আশঙ্কা করিয়া তমালমূল হইতে নির্গত হইলাম ও আস্তে আস্তে গমন করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলাম। যাইতে যাইতে কখন বা পার্শ্বে কখন বা সম্মুখে পতিত হওয়াতে শরীর ধূলিধূসরিত হইল ও ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতে লাগিল। তখন মনে মনে চিন্তা করিলাম, কি আশ্চর্য্য! যত দুর্দ্দশা ও যত কষ্ট সহ্য করিতে হউক না কেন, তথাপি কেহ জীবনতৃষ্ণা পরিত্যাগ করিতে পারে না। আমার সমক্ষে পিতা প্রাণত্যাগ করিলেন, স্বচক্ষে দেখিলাম, আমিও বৃক্ষ হইতে পতিত হইয়া বিকলেন্দ্রিয় ও মৃতপ্রায় হইয়াছি; তথাপি বাঁচিবার বিলক্ষণ বাসনা আছে। হায়, আমার তুল্য নির্দ্দয় কে আছে? মাতা প্রসবসময়ে প্রাণ ত্যাগ করিলে পিতা জায়াশোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়াও কেবল আমাকেই অবলম্বন করিয়া আমার লালন পালন করিতেছিলেন এবং অত্যন্ত স্নেহ প্রযুক্ত বৃদ্ধ বয়সেও তাদৃশ বিষম ক্লেশ সহ্য করিয়া আমারই রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমি সে সকল একবারে বিস্মৃত হইলাম। আমার পর কৃতঘ্ন আর নাই; আমার মত নৃশংস ও দুরাচার এই ভূমণ্ডলে কাহাকেও দেখিতে পাই না। কি আশ্চর্য্য! সেরূপ অবস্থাতে আমার জল পান করিবার অভিলাষ হইল। দূর হইতে সারস ও কলহংসের অনতিপরিস্ফুট কলরব শুনিয়া অনুমান করিলাম সরোবর দূরে আছে। কি রূপে সরোবরে যাইব, কি রূপে জলপান করিয়া প্রাণ বাঁচাইব, অনবরত এইরূপ ভাবিতে লাগিলাম।