রাজার কথা শুনিয়া কুমারপালিত কহিলেন মহারাজ! পক্ষিজাতি যে মনুষ্যের ন্যায় কথা কহিতে পারে ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। লোকেরা শুক শারিকা প্রভৃতি পক্ষীদিগকে প্রযত্নাতিশয় সহকারে শিক্ষা দেয় এবং উহারাও পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত সংস্কারবশতঃ অনায়াসে শিখিতে পারে। পূর্ব্বে উহারা ঠিক্ মনুষ্যের মত সুস্পষ্ট রূপে কথা কহিতে পারিত; কিন্তু অগ্নির শাপে এক্ষণে উহাদিগের কথার জড়তা জন্মিয়াছে। এই কথা কহিতে কহিতে সভাভঙ্গসূচক মধ্যাহ্নকালীন শঙ্খধ্বনি হইল। স্নানসময় উপস্থিত দেখিয়া নরপতি, সমাগত রাজাদিগকে সম্মানসূচক বাক্য প্রয়োগ দ্বারা সন্তুষ্ট করিয়া বিদায় করিলেন, চণ্ডালকন্যাকে বিশ্রাম করিতে আদেশ দিলেন এবং তাম্বুলকরঙ্কবাহিনীকে কহিলেন তুমি বৈশম্পায়নকে অন্তঃপুরে লইয়া যাও ও স্নান ভোজন করাইয়া দাও।
অনন্তর আপনি সিংহাসন হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক কতিপয় সুহৃৎ সমভিব্যাহারে রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। তথায় স্নান, পূজা, আহার প্রভৃতি সমুদায় কর্ম্ম সমাপন করিয়া শয়নাগারে প্রবেশ পূর্ব্বক শয্যায় শয়ন করিয়া বৈশম্পায়নের আনয়নের নিমিত্ত প্রতীহারীকে আদেশ দিলেন। প্রতীহারী আজ্ঞামাত্র বৈশম্পায়নকে শয়নাগারে আনয়ন করিল। রাজা জিজ্ঞাসিলেন বৈশম্পায়ন! তুমি কোন্ দেশে কিরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছ? তোমার জননী কে? কিরূপে সমস্ত শাস্ত্র অভ্যাস করিলে? তুমি কি জাতিস্মর, অথবা কোন মহাপুরুষ, যোগবলে বিহগবেশ ধারণ করিয়া দেশে দেশে ভ্রমণ করিতেছ, কিম্বা অভীষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করিয়া বর প্রাপ্ত হইয়াছ? তুমি পূর্ব্বে কোথায় বাস করিতে? কিরূপেই বা চণ্ডালহস্তগত হইয়া পিঞ্জরবদ্ধ হইলে এই সকল শুনিতে আমার অতিশয় কৌতুক জন্মিয়াছে, অতএব তোমার আদ্যোপান্ত সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমার কৌতুকাবিষ্ট চিত্তকে পরিতৃপ্ত কর।
বৈশম্পায়ন রাজার এই কথা শুনিয়া বিনয় বাক্যে কহিল যদি আমার জন্মবৃত্তান্ত শুনিতে মহাশয়ের নিতান্ত কৌতুক জন্মিয়া থাকে শ্রবণ করুন।
ভারতবর্ষের মধ্যস্থলে বিন্ধ্যাচলের নিকটে এক অটবী আছে। উহাকে বিন্ধ্যাটবী কহে। ঐ অটবীর মধ্যে গোদাবরী নদীর তীরে ভগবান্ অগস্ত্যের আশ্রম ছিল। যে স্থানে ত্রেতাবতার ভগবান্ রামচন্দ্র পিতৃ আজ্ঞা প্রতিপালনের নিমিত্ত সীতা ও লক্ষ্মণের সহিত পঞ্চবটীতে পর্ণশালা নির্ম্মাণ করিয়া কিঞ্চিৎ কাল অবস্থিতি করিয়াছিলেন। যে স্থানে দুর্ব্বৃত্ত দশাননপ্রেরিত নিশাচর মারীচ কনকমৃগরূপ ধারণ পূর্ব্বক জানকীর নিকট হইতে রামচন্দ্রকে হরণ করিয়াছিল। যে স্থানে মৈথিলীবিয়োগবিধুর রাম ও লক্ষ্মণ সাশ্রু নয়নে ও গদ্গদ বচনে নানাপ্রকার বিলাপ ও অনুতাপ করিয়া তত্রস্থ পশুপক্ষীদিগকেও দুঃখিত এবং বৃক্ষদিগকেও পরিতাপিত করিয়াছিলেন। ঐ আশ্রমের অনতিদূরে পম্পা নামক সরোবর আছে। ঐ সরোবরের পশ্চিম তীরে ভগবান্ রামচন্দ্র শর দ্বারা যে সপ্ততাল বিদ্ধ করিয়াছিলেন তাহার নিকটে এক প্রকাণ্ড শাল্মলী বৃক্ষ আছে; বৃহৎ এক অজগর সর্প সর্ব্বদা ঐ বৃক্ষের মূলদেশে বেষ্টন করিয়া থাকাতে, বোধ হয় যেন, আলবাল রহিয়াছে। উহার শাখা প্রশাখা সকল এরূপ উন্নত ও বিস্তৃত, বোধ হয় যেন, হস্তপ্রসারণ পূর্ব্বক গগনমণ্ডলের দৈর্ঘ্য পরিমাণ করিতে উঠিতেছে। স্কন্ধদেশ এরূপ উচ্চ, বোধ হয় যেন, একবারে পৃথিবীর চতুর্দ্দিক অবলোকন করিবার আশয়ে মুখ বাড়াইতেছে। ঐ তরুর কোটরে, শাখাগ্রে, স্কন্ধদেশে ও বল্কলবিবরে কুলায় নির্ম্মাণ করিয়া শুক শারিকা প্রভৃতি নানাবিধ পক্ষিগণ সুখে বাস করে। তরু অতিশয় প্রাচীন; সুতরাং বিরলপল্লব হইয়াও পক্ষিশাবকদিগের দিবানিশি অবস্থিতি প্রযুক্ত সর্ব্বদা নিবিড়পল্লবাকীর্ণ বোধ হয়। কোন কোন পক্ষিশাবকের পক্ষোদ্ভেদ হয় নাই তাহাদিগকে ঐ বৃক্ষের ফল বলিয়া ভ্রান্তি জন্মে। পক্ষীরা রাত্রিকালে বৃক্ষকোটরে আপন আপন নীড়ে নিদ্রা যায়। প্রভাত হইলে আহারের অন্বেষণে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া গগনমার্গে উড্ডীন হয়। তৎকালে বোধ হয় যেন, হরিদ্বর্ণ দুর্ব্বাদলপরিপূর্ণ ক্ষেত্র আকাশমার্গ দিয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহারা দিগ্দিগন্তে গমন করিয়া আহারদ্রব্য অন্বেষণ পূর্ব্বক আপনারা ভোজন করে এবং শাবকদিগের নিমিত্ত চঞ্চুপুটে করিয়া খাদ্য সামগ্রী আনে ও যত্নপূর্ব্বক আহার করাইয়া দেয়।
সেই মহীরুহের এক জীর্ণ কোটরে আমার পিতা মাতা বাস করিতেন। কালক্রমে মাতা গর্ভবতী হইলেন এবং আমাকে প্রসব করিয়া সূতিকাপীড়ায় অভিভূত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। পিতা তৎকালে বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, আবার প্রিয়তমা জায়ার বিয়োগশোকে অতিশয় ব্যাকুল ও দুঃখিতচিত্ত হইলেন তথাপি স্নেহবশতঃ আমাকেই অবলম্বন করিয়া আমার লালন পালনে ও রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান্ হইয়া কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তাঁহার গমন করিবার কিছুমাত্র শক্তি ছিল না; তথাপি আস্তে আস্তে সেই আবাসতরুতলে নামিয়া পক্ষিকুলায়ভ্রষ্ট যে যৎকিঞ্চিৎ আহারদ্রব্য পাইতেন আমাকে আনিয়া দিতেন, আমার আহারাবশিষ্ট যাহা থাকিত আপনি ভোজন করিয়া যথাকথঞ্চিৎ জীবন ধারণ করিতেন।
একদা প্রভাতকালে চন্দ্রমা অস্তগত হইলে, পক্ষিগণের কলরবে অরণ্যানী কোলাহলময় হইলে, নবোদিত রবির আতপে গগনমণ্ডল লোহিতবর্ণ হইলে, গগনাঙ্গনবিক্ষিপ্ত অন্ধকার রূপ ভস্মরাশি দিনকরের কিরণরূপ সম্মার্জ্জনী দ্বারা দূরীকৃত হইলে, সপ্তর্ষিমণ্ডল অবগাহন মানসে মানসসরোবরতীরে অবতীর্ণ হইলে শাল্মলীবৃক্ষস্থিত পক্ষিগণ আহারের অন্বেষণে অভিমত প্রদেশে প্রস্থান করিল। পক্ষিশাবকেরা নিঃশব্দে কোটরে রহিয়াছে ও আমি পিতার নিকটে বসিয়া আছি এমন সময়ে, ভয়াবহ মৃগয়াকোলাহল শুনিতে পাইলাম। কোন দিকে সিংহ সকল গভীর স্বরে গর্জ্জন করিতে লাগিল; কোন প্রদেশে তুরঙ্গ, কুরঙ্গ, মাতঙ্গ প্রভৃতি বনচর পশু সকল বন আন্দোলন করিয়া বেড়াইতে লাগিল; কোন স্থানে ব্যাঘ্র, ভল্লুক, বরাহ প্রভৃতি ভীষণাকার জন্তু সকল ছুটাছুটী করিতে লাগিল, কোন স্থানে মহিষ, গণ্ডার প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ জন্তুগণ অতিবেগে দৌড়িতে লাগিল ও তাহাদিগের গাত্রঘর্ষণে বৃক্ষ সকল ভগ্ন হইতে আরম্ভ হইল। মাতঙ্গের চীৎকারে, তুরঙ্গের হেষারবে, সিংহের গর্জ্জনে ও পক্ষীদিগের কলরবে বন আকুল হইয়া উঠিল এবং তরুগণও ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। আমি সেই কোলাহল শ্রবণে ভয়বিহ্বল ও কম্পিতকলেবর হইয়া পিতার জীর্ণ পক্ষপুটের অন্তরালে লুকাইলাম। তথা হইতে ব্যাধদিগের ঐ বরাহ যাইতেছে, ঐ হরিণ দৌড়িতেছে, ঐ করভ পলাইতেছে ইত্যাদি নানাপ্রকার কোলাহল শুনিতে লাগিলাম।