কিঞ্চিৎ দূর গমন করিলে দ্বিতীয় ঋষিকুমার সেই তপোধনযুবার এরূপ চিত্তবিকার দেখিয়া প্রণয়কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন, সখে পুণ্ডরীক! এ কি! তোমার অন্তঃকরণ এরূপ বিকৃত হইল কেন? ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র লোকেরাই অপথে পদার্পণ করে। নির্ব্বোধেরাই সদসদ্বিবেচনা করিতে পারে না। মূঢ় ব্যক্তিরাই চঞ্চল চিত্তকে স্থির করিতে অসমর্থ। তুমি কি তাহাদিগের ন্যায় বিবেচনাশূন্য হইয়া দুষ্কর্ম্মে অনুরক্ত হইলে? তোমার আজি অভূতপূর্ব্ব এরূপ ইন্দ্রিয়বিকার কেন হইল? ধৈর্য্য, গাম্ভীর্য্য, বিনয়, লজ্জা, জিতেন্দ্রিয়তা প্রভৃতি তোমার স্বাভাবিক সদ্গুণ সকল কোথায় গেল? কুলক্রমাগত ব্রহ্মচর্য্য, বিষয়বৈরাগ্য, গুরুদিগের উপদেশ, তপস্যায় অভিনিবেশ, শাস্ত্রের আলোচনা, যৌবনের শাসন, মনের বশীকরণ, সমুদায় একেবারে বিস্মৃত হইলে? তোমার বুদ্ধি কি এইরূপে পরিণত হইল? ধর্ম্মশাস্ত্রাভ্যাসের কি এই গুণ দর্শিল? গুরুজনের উপদেশে কি উপকার হইল? এত দিনে বুঝিলাম বিবেকশক্তি ও নীতিশিক্ষা নিষ্ফল, জ্ঞানাভ্যাস ও সদুপদেশে কোন ফল নাই, জিতেন্দ্রিয়তা কেবল কথামাত্র, যেহেতুক ভবাদৃশ ব্যক্তিকেও অনুরাগে কলুষিত ও অজ্ঞানে অভিভূত দেখিতেছি। তোমার অক্ষমালা কোথায়? উহা করতল হইতে গলিত ও অপহৃত হইয়াছে দেখিতে পাও নাই? কি আশ্চর্য্য! একেবারে জ্ঞানশূন্য ও চৈতন্যশূন্য হইয়াছ! ঐ অনার্য্যা বালা অক্ষমালা হরণ করিয়া পলায়ন করিতেছে এবং মন হরণ করিবার উদ্যোগে আছে এই বেলা সাবধান হও। তপোধনযুবা কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া, সখে! কি হেতু আমাকে অন্যরূপ সম্ভাবনা করিতেছ? আমি ঐ দুর্ব্বিনীত কন্যার অক্ষমালাহরণাপরাধ ক্ষমা করিব না বলিয়া ভ্রূকুটিভঙ্গি দ্বারা অলীক কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক আমাকে কহিলেন, চপলে! আমার অক্ষমালা না দিয়া এখান হইতে যাইতে পাইবে না। আমি তাঁহার নিরূপম রূপলাবণ্যের অনুরাগিণী ও ভাবভঙ্গির পক্ষপাতিনী হইয়া এরূপ শূন্যহৃদয় হইয়াছিলাম যে, অক্ষমালা ভ্রমে কণ্ঠ হইতে উন্মোচন করিয়া আমার একাবলীমালা তাঁহার করে প্রদান করিলাম। তিনিও এরূপ অন্যমনস্ক হইয়া আমার মুখপানে চাহিয়াছিলেন যে উহা অক্ষমালা বলিয়াই গ্রহণ করিলেন। মুনিকুমারের সন্নিধানে স্বেদজলে বারংবার স্নান করিয়া পরে সরোবরে স্নান করিতে গেলাম। স্নানানন্তর মুনিকুমারের মনোহারিণী মূর্ত্তি মনে মনে চিন্তা করিতে করিতে বাটী গমন করিলাম।
অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া যে দিকে নেত্রপাত করি, পুণ্ডরীকের মুখপুণ্ডরীক ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাই না। মুনিকুমারের অদর্শনে এরূপ অধীর হইলাম যে, তৎকালে জাগরিত কি নিদ্রিত, একাকিনী কি অনেকের নিকটবর্ত্তিনী ছিলাম, সুখের অবস্থা কি দুঃখের দশা ঘটিয়াছিল, উৎকণ্ঠা কি ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিলাম, কিছুই বুঝিতে পারি নাই। ফলতঃ কোন জ্ঞান ছিল না। একবারে চৈতন্যশূন্য হইয়াছিলাম। তৎকালে কি কর্ত্তব্য কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, কেহ যেন আমার নিকট না যায়, পরিচারিকাদিগকে এইমাত্র আদেশ দিয়া, প্রাসাদের উপরিভাগে উঠিলাম। যে স্থানে সেই ঋষিকুমারের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল সেই প্রদেশকে মহারত্নাধিষ্ঠিত, অমৃতরসাভিষিক্ত, চন্দ্রোদয়ালঙ্কৃত বোধ করিয়া বারংবার দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলাম। দেখিতে দেখিতে এরূপ উন্মত্ত ও ভ্রান্ত হইলাম যে, সেই দিক্ হইতে যে অনিল ও পক্ষী সকল আসিতেছিল তাহাদিগকেও প্রিয়তমের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা জন্মিল। আমার অন্তঃকরণ তাঁহার প্রতি এরূপ অনুরক্ত হইল যে, তিনি যে যে কর্ম্ম করিতেন, তাহাতেও পক্ষপাতী হইয়া উঠিল। তিনি তপস্বী ছিলেন বলিয়া তপস্যায় আর বিদ্বেষ থাকিল না। তিনি মুনিবেশ ধারণ করিতেন সুতরাং মুনিবেশে আর গ্রাম্যতা রহিল না। পারিজাতকুসুম তাঁহার কর্ণে ছিল বলিয়াই মনোহর হইল। সুরলোক তাঁহার বাসস্থান বলিয়াই রমণীয় বোধ হইতে লাগিল। ফলতঃ নলিনী যেরূপ রবির পক্ষপাতিনী, আমিও সেইরূপ ঋষিকুমারের পক্ষপাতিনী হইয়া নিমেষশূন্য দৃষ্টিতে সেই দিক্ দেখিতে লাগিলাম।
আমার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী তরলিকাও স্নান করিতে গিয়াছিল। সে অনেক ক্ষণের পর বাটী আসিয়া আমাকে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আমরা সরোবরের তীরে যে দুই জন তাপসকুমার দেখিয়াছিলাম, তাঁহাদিগের এক জন, যিনি তোমার কর্ণে কল্পপাদপের কুসুমমঞ্জরী পরাইয়া দেন, তিনি গুপ্ত ভাবে আমার নিকটে আসিয়া সুমধুর বচনে জিজ্ঞাসা করিলেন, বালে! যাঁহার কর্ণে আমি পুষ্প মঞ্জরী পরাইয়া দিলাম ইনি কে? ইঁহার নাম কি? কাহার অপত্য? কোথায় বা গমন করিলেন? আমি বিনীত বচনে কহিলাম, ভগবন্! ইনি গন্ধর্ব্বের অধিপতি হংসের দুহিতা, নাম মহাশ্বেতা। হেমকূট পর্ব্বতে গন্ধর্ব্বলোকে বাস করেন, তথায় গমন করিলেন। অনন্তর অনিমিষ লোচনে ক্ষণ কাল অনুধ্যান করিয়া পুনর্ব্বার বলিলেন, ভদ্রে! তুমি বালিকা বট; কিন্তু তোমার আকৃতি দেখিয়া বোধ হইতেছে চঞ্চলপ্রকৃতি নও। একটী কথা বলি শুন। আমি কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইয়া সমাদর প্রদর্শন পূর্ব্বক সবিনয়ে নিবেদন করিলাম, মহাভাগ! আদেশ দ্বারা এই ক্ষুদ্র জনের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিবেন ইহার পর আর সৌভাগ্য কি? ভবাদৃশ মহাত্মারা মদ্বিধ ক্ষুদ্র জনের প্রতি কটাক্ষপাত করিলেই তাহারা চরিতার্থ হয়। আপনি বিশ্বাস পূর্ব্বক কোন বিষয়ে আদেশ করিলে আমি চিরক্রীত ও অনুগৃহীত হইব, সন্দেহ নাই। আমার বিনয়গর্ভ বাক্য শুনিয়া সখীর ন্যায়, উপকারিণীর ন্যায় ও প্রাণদায়িনীর ন্যায় আমাকে জ্ঞান করিলেন। স্নিগ্ধ দৃষ্টি দ্বারা প্রসন্নতা প্রকাশ পূর্ব্বক নিকটবর্ত্তী এক তমালতরুর পল্লব গ্রহণ করিয়া পল্লবের রসে আপন পরিধেয় বল্কলের এক খণ্ডে নখ দ্বারা এই পত্রিকা লিখিয়া আমাকে দিলেন। কহিলেন, আর কেহ যেন জানিতে না পারে, মহাশ্বেতা যখন একাকিনী থাকিবেন তাঁহার করে সমর্পণ করিও।