অনন্তর স্বেদসলিলের সহিত লজ্জা গলিত হইল। মকরধ্বজের নিশিত শরপাতভয়ে ভীত হইয়াই যেন, কলেবর কম্পিত হইল। মুনিকুমারকে আলিঙ্গন করিবার আশয়েই যেন, শরীর রোমাঞ্চরূপ কর প্রসারণ করিল। তখন মনে মনে চিন্তা করিলাম, শান্তপ্রকৃতি তাপসজনের প্রতি আমাকে অনুরাগিণী করিয়া দুরাত্মা মন্মথ কি বিসদৃশ কর্ম্ম করিল। অঙ্গনাজনের অন্তঃকরণ কি বিমূঢ়! অনুরাগের পাত্রাপাত্র কিছুই বিবেচনা করিতে পারে না। তেজঃপুঞ্জ তপোরাশি, মুনিকুমারই বা কোথায়? সামান্য জনসুলভ চিত্তবিকারই বা কোথায়? বোধ হয় ইনি আমার ভাবভঙ্গি দেখিয়া মনে মনে কত উপহাস করিয়াছেন। কি আশ্চর্য্য! চিত্ত বিকৃত হইয়াছে বুঝিতে পারিয়াও বিকার নিবারণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। দুরাত্মা কন্দর্পের কি প্রভাব! ইহার প্রভাবে কত শত কন্যা লজ্জা ও কুলে জলাঞ্জলি দিয়া স্বয়ং প্রিয়তমের অনুগামিনী হয়। অনঙ্গ কেবল আমাকেই এইরূপ করিতেছে এমন নহে, কত শত কুলবালাকে এইরূপ অপথে পদার্পণ করায়। যাহা হউক, মদনদুশ্চেষ্টিত পরিস্ফুটরূপে প্রকাশ না হইতে হইতে এখান হইতে প্রস্থান করাই শ্রেয়ঃ। কি জানি পাছে ইনি কুপিত হইয়া শাপ দেন। শুনিয়াছি মুনিজনের প্রকৃতি অতিশয় রোষপরবশ। সামান্য অপরাধেও তাঁহারা ক্রোধান্বিত হইয়া উঠেন ও অভিসম্পাত করেন। অতএব এখানে আর আমার থাকা বিধেয় নয়। এই স্থির করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিবার অভিপ্রায় করিলাম। মুনিজনেরা সকলের পূজনীয় ও নমস্য বিবেচনা করিয়া প্রণাম করিলাম। আমি প্রণাম করিলে পর কুসুমশরশাসনের অলঙ্ঘ্যতা, বসন্ত কালের ও সেই সেই প্রদেশের রমণীয়তা, ইন্দ্রিয়গণের অবাধ্যতা, সেই সেই ঘটনার ভবিতব্যতা এবং আমার ঈদৃশ ক্লেশ ও দৌর্ভাগ্যের অবশ্যম্ভাবিতা প্রযুক্ত আমার ন্যায় সেই মুনিকুমারও মোহিত ও অভিভূত হইলেন। স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, বেপথু প্রভৃতি সাত্ত্বিক ভাবের লক্ষণ সকল তাঁহার শরীরে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ পাইল। তাঁহার অন্তঃকরণের তদানীন্তন ভাব বুঝিতে পারিয়া তাঁহার সহচর দ্বিতীয় ঋষিকুমারের নিকট গমন ও ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসিলাম, ভগবন! ইঁহার নাম কি? ইনি কোন্ তপোধনের পুত্ত্র? ইঁহার কর্ণে যে কুসুমমঞ্জরী দেখিতেছি উহা কোন্ তরুর সম্পত্তি। আহা উহার কি সৌরভ! আমি কখন ঐরূপ সৌরভ আঘ্রাণ করি নাই। আমার কথায় তিনি ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, বালে! তোমার উহা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন কি? যদি শুনিতে নিতান্ত কৌতুক জন্মিয়া থাকে শ্রবণ কর।
শ্বেতকেতু নামে মহাতপা মহর্ষি দিব্য লোকে বাস করেন। তাঁহার রূপ জগদ্বিখ্যাত। তিনি একদা দেবার্চ্চনার নিমিত্ত কমল কুসুম তুলিতে মন্দাকিনীপ্রবাহে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। কমলাসনা লক্ষ্মী তাঁহার রূপ লাবণ্য দেখিয়া মোহিত হন। তথায় পরস্পর সমাগমে এক কুমার জন্মে। ইনি তোমার পুত্ত্র হইলেন গ্রহণ কর বলিয়া লক্ষ্মী শ্বেতকেতুকে সেই পুত্ত্র সন্তান সমর্পণ করেন। মহর্ষি পুত্ত্রের সমুদায় সংস্কার সম্পন্ন করিয়া পুণ্ডরীকে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া পুণ্ডরীক নাম রাখেন। যাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ, ইনি সেই পুণ্ডরীক। পূর্ব্বে অসুর ও সুরগণ যখন ক্ষীরসাগর মন্থন করেন, তৎকালে পারিজাত বৃক্ষ তথা হইতে উদ্গত হয়। এই কুসুমমঞ্জরী সেই পারিজাত বৃক্ষের সম্পত্তি। ইহা যেরূপে ইঁহার শ্রবণগত হইয়াছে তাহাও শ্রবণ কর। অদ্য চতুর্দ্দশী, ইনি ও আমি ভগবান্ ভবানীপতির অর্চ্চনার নিমিত্ত নন্দনবনের নিকট দিয়া কৈলাসপর্ব্বতে আসিতেছিলাম। পথিমধ্যে নন্দনবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এই পারিজাতকুসুমমঞ্জরী হস্তে লইয়া আমাদের নিকটবর্ত্তিনী হইলেন; প্রণাম করিয়া ইঁহাকে বিনীত বচনে কহিলেন, ভগবন্! আপনার যেরূপ আকার তাহার সদৃশ এই অলঙ্কার, আপনি এই কুসুমমঞ্জরীকে শ্রবণমণ্ডলে স্থান দান করিলে আমি চরিতার্থ হই। বনদেবতার কথায় অনাদর করিয়া ইনি চলিয়া যাইতেছিলেন, আমি তাঁহার হস্ত হইতে মঞ্জরী লইয়া কহিলাম, সখে! দোষ কি! বনদেবতার প্রণয় পরিগ্রহ করা উচিত, এই বলিয়া ইঁহার কর্ণে পরাইয়া দিলাম।
তিনি এইরূপ পরিচয় দিতেছিলেন এমন সময়ে সেই তপোধনযুবা কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, অয়ি কুতূহলাক্রান্তে! তোমার এত অনুসন্ধানে প্রয়োজন কি? যদি কুসুমমঞ্জরী লইবার বাসনা হইয়া থাকে, গ্রহণ কর এই বলিয়া আমার নিকটবর্ত্তী হইলেন এবং আপনার কর্ণদেশ হইতে উন্মোচন করিয়া আমার শ্রবণপুটে পরাইয়া দিলেন। আমার গণ্ডস্থলে তাঁহার হস্তস্পর্শ হইবামাত্র অন্তঃকরণে কোন অনির্ব্বচনীয় ভাবোদয় হওয়াতে তিনি অবশেন্দ্রিয় হইলেন। করতলস্থিত অক্ষমালা হৃদয়স্থিত লজ্জার সহিত গলিত হইল জানিতে পারিলেন না। অক্ষমালা তাঁহার পাণিতল হইতে ভূতলে পড়িতে না পড়িতেই আমি ধরিলাম ও আপন কণ্ঠের আভরণ করিলাম। এই সময়ে ছত্রধারিণী আসিয়া বলিল, ভর্ত্তৃদারিকে! দেবী স্নান করিয়া তোমার অপেক্ষা করিতেছেন, তোমার আর বিলম্ব করা বিধেয় নয়। নবধৃতা করিণী অঙ্কুশের আঘাতে যেরূপ কুপিত ও বিরক্ত হয়, আমি সেই দাসীর বাক্যে বিরক্ত হইয়া, কি করি, মাতা অপেক্ষা করিতেছেন শুনিয়া, সেই যুবা পুরুষের মুখমণ্ডল হইতে অতিকষ্টে আপনার অনুরাগাকৃষ্ট নেত্রযুগল আকর্ষণ করিয়া স্নানার্থ গমন করিলাম।