চন্দ্রাপীড় অবসর বুঝিয়া বিনয় বাক্যে কহিলেন, ভগবতি! মানুষদিগের প্রকৃতি অতি চঞ্চল, প্রভুর কিঞ্চিৎ প্রসন্নতা দেখিলেই অমনি অধীর ও গর্ব্বিত হইয়া উঠে। আপনার অনুগ্রহ ও প্রসন্নতা দর্শনে উৎসাহিত হইয়া আমার অন্তঃকরণ কিছু জিজ্ঞাসা করিতে অভিলাষ করিতেছে। যদি আপনার ক্লেশকর না হয়, তাহা হইলে, আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা আমার কৌতুকাক্রান্ত চিত্তকে পরিতৃপ্ত করুন। কি দেবতাদিগের কুল, কি মহর্ষিদিগের কুল, কি গন্ধর্ব্বদিগের কুল, কি অপ্সরাদিগের কুল—আপনি জন্মপরিগ্রহ দ্বারা কোন্ কুল উজ্জ্বল করিয়াছেন? কি নিমিত্ত কুসুমসুকুমার নবীন বয়সে আয়াসসাধ্য তপস্যায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন? কি নিমিত্তই বা দিব্য আশ্রম পরিত্যাগ করিয়া এই নির্জ্জন বনে একাকিনী অবস্থিতি করিতেছেন? তাপসী কিঞ্চিৎ কাল নিস্তব্ধ থাকিয়া পরে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন। চন্দ্রাপীড় তাঁহাকে অশ্রুমুখী দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, এ আবার কি! শোক, তাপ কি সকল শরীরকেই আশ্রয় করিয়াছে? যাহা হউক, ইঁহার বাস্পসলিলপাতে আমার আরও কৌতুক জন্মিল। বোধ হয়, শোকের কোন মহৎ কারণ থাকিবেক। সামান্য শোক এতাদৃশ পবিত্র মূর্ত্তিকে কখন কলুষিত ও অভিভূত করিতে পারে না। বায়ুর আঘাতে কি বসুধা চালিত হয়? চন্দ্রাপীড় আপনাকে শোকোদ্দীপনহেতু ও তজ্জন্য অপরাধী বোধ করিয়া মুখপ্রক্ষালনের নিমিত্ত প্রস্রবণ হইতে জল আনিয়া দিলেন ও সান্ত্বনাবাক্যে নানাপ্রকার বুঝাইলেন। তাপসী চন্দ্রাপীড়ের সান্ত্বনাবাক্যে রোদনে ক্ষান্ত হইয়া মুখপ্রক্ষালন পূর্ব্বক কহিলেন, রাজপুত্ত্র! এই পাপীয়সী হতভাগিনীর অশ্রোতব্য বৈরাগ্যবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কি হইবে? উহা কেবল শোকানল ও দুঃখার্ণব। যদি শুনিতে নিতান্ত অভিলাষ হইয়া থাকে, শ্রবণ করুন।
২.০৫ দেবলোকে অপ্সরাগণ বাস করে
দেবলোকে অপ্সরাগণ বাস করে শুনিয়া থাকিবেন। ইহাদিগের চতুর্দ্দশ কুল। ভগবান্ কমলযোনির মানস হইতে এক কুল উৎপন্ন হয়। দেব, অনল, জল, ভূতল, পবন, সূর্য্যরশ্মি, চন্দ্রকিরণ, সৌদামিনী, মৃত্যু ও মকরকেতু এই একাদশ হইতে একাদশ কুল। দক্ষপ্রজাপতির কন্যা মুনি ও অরিষ্টার সহিত গন্ধর্ব্বদিগের সমাগমে আর দুই কুল উৎপন্ন হয়। এই সমুদায়ে চতুর্দ্দশ কুল। মুনির গর্ভে চিত্ররথ জন্মগ্রহণ করেন। দেবরাজ ইন্দ্র আপন সুহৃন্মধ্যে পরিগণিত করিয়া প্রভাব ও কীর্ত্তিবর্দ্ধন পূর্ব্বক তাঁহাকে গন্ধর্ব্বলোকের অধিপতি করিয়া দেন। ভারতবর্ষের উত্তরে কিম্পুরুষবর্ষে হেমকূট নামে বর্ষপর্ব্বত তাঁহার বাসস্থান। তথায় তাঁহার অধীনে সহস্র সহস্র গন্ধর্ব্বলোক বাস করে। তিনিই চৈত্ররথ নামে এই রমণীয় কানন, অচ্ছোদননামক ঐ সরোবর ও ভবানীপতির এই প্রতিমূর্ত্তি প্রস্তুত করিয়াছেন। অরিষ্টার গর্ভে হংস নামে জগদ্বিখ্যাত গন্ধর্ব্ব জন্মগ্রহণ করেন। গন্ধর্ব্বরাজ চৈত্ররথ ঔদার্য্য ও মহত্ত্ব প্রকাশ পূর্ব্বক আপন রাজ্যের কিঞ্চিৎ অংশ প্রদান করিয়া তাঁহাকে রাজ্যাভিষিক্ত করেন। তাঁহার বাসস্থান হেমকূট। গৌরী নামে এক পরম সুন্দরী অপ্সরা তাঁহার সহধর্ম্মিণী! এই হতভাগিনী ও চিরদুঃখিনী তাঁহাদিগের একমাত্র কন্যা। আমার নাম মহাশ্বেতা। পিতা মাতার অন্য সন্তান সন্ততি ছিল না। আমিই একমাত্র অবলম্বন ছিলাম। শৈশবকালে বীণার ন্যায় এক অঙ্ক হইতে অঙ্কান্তরে যাইতাম ও অপরিস্ফুট মধুর বচনে সকলের মন হরণ করিতাম। সকলের স্নেহপাত্র হইয়া পরমপবিত্র বাল্যকাল বাল্যক্রীড়ায় অতিক্রান্ত হইল। যেরূপ বসন্তকালে নব পল্লবের ও নব পল্লবে কুসুমের উদয় হয় সেইরূপ আমার শরীরে যৌবনের উদয় হইল।
একদা মধুমাসের সমাগমে কমলবন বিকসিত হইলে, চূতকলিকা অঙ্কুরিত হইলে, মলয়মারুতের মন্দ মন্দ হিল্লোলে আহ্লাদিত হইয়া কোকিল সহকারশাখায় উপবেশন পূর্ব্বক সুস্বরে কুহুরব করিলে, অশোক কিংশুক প্রস্ফুটিত হইলে, আমি মাতার সহিত এই আচ্ছোদ সরোবরে স্নান করিতে আসিয়াছিলাম! এখানে আসিয়া মনোহর তীর, বিচিত্র তরু ও রমণীয় লতাকুঞ্জ অবলোকন করিয়া ভ্রমণ করিতে ছিলাম। ভ্রমণ করিতে করিতে সহসা বনানিলের সহিত সমাগত অতি সুরভি পরিমল আঘ্রাণ করিলাম; মধুকরের ন্যায় সেই সুরভি গন্ধে অন্ধ হইয়া তদনুসরণ ক্রমে কিঞ্চিৎ দূর গমন করিয়া দেখিলাম, অতি তেজস্বী, পরমরূপবান, সুকুমার, এক মুনিকুমার সরোবরে স্নান করিতে আসিতেছেন। তাঁহার সমভিব্যাহারে আর এক জন তাপসকুমার আছেন। উভয়েরই এরূপ সৌন্দর্য্য ও সৌকুমার্য্য বোধ হইল যেন, রতিপতি প্রিয় সহচর বসন্তের সহিত মিলিত হইয়া ক্রোধান্ধ চন্দ্রশেখরকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত তপস্বিবেশ ধারণ করিয়াছেন। প্রথম মুনিকুমারের কর্ণে অমৃতনিস্যন্দিনী ও পরিমলবাহিনী এক কুসুমমঞ্জরী ছিল। ঐরূপ আশ্চর্য্য কুসুমমঞ্জরী কেহ কখন দেখে নাই। উহার গন্ধ আঘ্রাণ করিয়া স্থির করিলাম, উহার গন্ধে বন আমোদিত হইয়াছে। অনন্তর অনিমিষ লোচনে মুনিকুমারের মোহিনী মূর্ত্তি নেত্রগোচর করিয়া বিস্মিত হইলাম। ভাবিলাম, বিধাতা বুঝি কমল ও চন্দ্রমণ্ডল সৃষ্টি করিয়া ইঁহার বদনারবিন্দ নির্ম্মাণের কৌশল অভ্যাস করিয়া থাকিবেন। ঊরু ও বাহুযুগ সৃষ্টি করিবার পূর্ব্বে রম্ভাতরু ও মৃণালের সৃষ্টি করিয়া নির্ম্মাণকৌশল শিখিয়া থাকিবেন। নতুবা সমানাকার দুই তিন বস্তু সৃষ্টি করিবার প্রয়োজন কি? ফলতঃ মুনিকুমারের রূপ যতবার দেখি তত বারই অভিনব বোধ হয়। এইরূপ তাঁহার রমণীয় রূপের পক্ষপাতিনী হইয়া ক্রমে ক্রমে কুসুমশরের শরসন্ধানের পথবর্ত্তিনী হইলাম। কি মুনিকুমারের রূপসম্পত্তি, কি যৌবনকাল, কি বসন্তকাল, কি সেই সেই প্রদেশ, কি অনুরাগ, জানি না কে আমাকে উন্মাদিনী করিল। বারংবার মুনিকুমারকে সস্পৃহ লোচনে দেখিতে লাগিলাম। বোধ হইল যেন, আমার হৃদয়কে রজ্জুবদ্ধ করিয়া কেহ আকর্ষণ করিতেছে।