ক্ষণ কাল বিশ্রামের পর সরসীর উত্তর তীরে বীণাতন্ত্রীঝঙ্কারমিশ্রিত সঙ্গীত শুনিলেন। ইন্দ্রায়ুধ শব্দ শুনিবামাত্র কবল পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই দিকে কর্ণপাত করিল। এই জনশূন্য অরণ্যে কোথায় সঙ্গীত হইতেছে জানিবার নিমিত্ত রাজকুমার যে দিকে শব্দ হইতেছিল সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলেন না। কেবল অস্ফুট মধুর শব্দ কর্ণকুহরে অমৃত বর্ষণ করিতে লাগিল। সঙ্গীতশ্রবণে কুতূহলাক্রান্ত হইয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক সরসীর পশ্চিম তীর দিয়া শব্দানুসারে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। কতক দূর গিয়া, চতুর্দ্দিকে পরমরমণীয় উপবনমধ্যে কৈলাসাচলের এক প্রত্যন্ত পর্ব্বত দেখিতে পাইলেন। ঐ পর্ব্বতের নাম চন্দ্রপ্রভা; উহার নিম্নে এক মন্দিরের অভ্যন্তরে চরাচরগুরু ভগবান্ শূলপাণির প্রতিমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। ঐ প্রতিমার সম্মুখে পাশুপতব্রতধারিণী নির্ম্মমা, নিরহঙ্কারা, নির্ম্মৎসরা অমানুষাকৃতি, অষ্টাদশবর্ষদেশীয়া এক কন্যা বীণাবাদন পূর্ব্বক তানলয়বিশুদ্ধ মধুরস্বরে মহাদেবের স্তুতিবাদ করিয়া গান করিতেছেন। কন্যার দেহপ্রভায় উপবন উজ্জ্বল ও মন্দির আলোকময় হইয়াছে। তাঁহার স্কন্ধে জটাভার, গলে রুদ্রাক্ষমালা ও গাত্রে ভস্মলেপ। দেখিবামাত্র বোধ হয় যেন, পার্ব্বতী শিবের আরাধনায় ভক্তিমতী হইয়াছেন।
রাজকুমার তরুশাখায় ঘোটক বাঁধিয়া ভক্তিপূর্ব্বক ভগবান্ ত্রিলোচনকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। নিমেষশূন্য লোচনে সেই অঙ্গনাকে নিরীক্ষণ করিয়া মনে মনে ভাবিলেন, কি আশ্চর্য্য? কত অসম্ভাবিত ও অচিন্তিত বিষয় স্বপ্নকল্পিতের ন্যায় সহসা উপস্থিত হয়, তাহা নিরূপণ করা যায় না। আমি মৃগয়ায় নির্গত ও যদৃচ্ছাক্রমে কিন্নরমিথুনের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়া কত ভয়ঙ্কর ও কত রমণীয় প্রদেশ দেখিলাম। পরিশেষে গীতধ্বনিরব অনুসারে এই স্থানে উপস্থিত হইয়া এই এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখিতেছি। কন্যার যেরূপ মনোহর আকার ও মধুর স্বর, তাহাতে কোন ক্রমে মানুষী বোধ হয় না, দেবকন্যা সন্দেহ নাই। ধরণীতলে কি সৌদামিনীর উদ্ভব হইতে পারে? যাহা হউক, যদি আমার দর্শনপথ হইতে সহসা অন্তর্হিত না হন, যদি কৈলাসশিখরে অথবা গগনমণ্ডলে হঠাৎ আরোহণ না করেন, তাহা হইলে, আমি ইঁহার নাম, ধাম ও তপস্যায় অভিনিবেশের কারণ, সমুদায় জিজ্ঞাসা করিয়া জানিব। এই স্থির করিয়া সেই মন্দিরের এক পার্শ্বে উপবেশন পূর্ব্বক সঙ্গীতসমাপ্তির অবসর প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন।
সঙ্গীত সমাপ্ত হইলে বীণা নিস্তব্ধ হইল। কন্যা গাত্রোত্থান পূর্ব্বক ভক্তিভাবে ভগবান্ ত্রিলোচনকে প্রদক্ষিণ করিয়া প্রণাম করিলেন। অনন্তর পবিত্র নেত্রপাত দ্বারা রাজকুমারকে পরিতৃপ্ত করিয়া সাদর সম্ভাষণে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলেন ও বিনীত ভাবে কহিলেন, মহাশয়! আশ্রমে চলুন ও অতিথিসৎকার গ্রহণ করিয়া চরিতার্থ করুন। রাজকুমার সম্ভাষণমাত্রেই আপনাকে পরিগৃহীত ও চরিতার্থ বোধ করিয়া ভক্তি পূর্ব্বক তাপসীকে প্রণাম করিলেন ও শিষ্যের ন্যায় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। যাইতে যাইতে চিন্তা করিলেন, তাপসী আমাকে দেখিয়া অন্তর্হিত হইলেন না; প্রত্যুত দাক্ষিণ্য প্রকাশ করিয়া অতিথিসৎকার গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিলেন। বোধ হয়, জিজ্ঞাসা করিলে আত্মবৃত্তান্তও বলিতে পারেন।
কতক দূর যাইয়া এক গিরিগুহা দেখিলেন। উহার পুরোভাগ তমালবনে আবৃত, তথায় দিনমণি দৃষ্টিগোচর হয় না। পার্শ্বে নির্ঝরবারি ঝর্ঝর শব্দে পতিত হইতেছে। দূর হইতে উহার শব্দ কি মনোহর! অভ্যন্তরে বল্কল, কমণ্ডলু ও ভিক্ষাকপাল রহিয়াছে। দেখিবামাত্র মনে শান্তিরসের সঞ্চার হয়। তাপসী তথায় প্রবেশিয়া অর্ঘ্যসামগ্রী আহরণ পূর্ব্বক অর্ঘ্য আনয়ন করিলেন। রাজকুমার মৃদু মধুর সম্ভাষণে কহিলেন, ভগবতি! প্রসন্ন হউন, আপনকার দর্শনমাত্রেই আমি পবিত্র হইয়াছি এবং অর্ঘ্যও প্রদত্ত হইয়াছে। অত্যাদর প্রকাশ করার প্রয়োজন নাই। আপনি উপবেশন করুন। পরিশেষে তাপসীর অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া রাজকুমার যথাবিহিত অর্ঘ্য গ্রহণ করিলেন। দুই জন শিলাতলে উপবিষ্ট হইলেন। তাপসী রাজকুমারের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি আপনার নাম, ধাম ও দিগ্বিজয়ের কথা বিশেষ করিয়া কহিলেন এবং কিন্নরমিথুনের অনুসরণক্রমে আপন আগমনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণনা করিলেন।
অনন্তর তাপসী ভিক্ষাকপাল গ্রহণ করিয়া আশ্রমস্থিত তরুতলে ভ্রমণ করাতে তাঁহার ভিক্ষাভাজন, বৃক্ষ হইতে পতিত নানাবিধ সুস্বাদু ফলে পরিপূর্ণ হইল। চন্দ্রাপীড়কে সেই সকল ফল ভক্ষণ করিতে অনুরোধ করিলেন। চন্দ্রাপীড় ফল ভক্ষণ করিবেন কি, এই আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার অতিশয় বিস্ময় জন্মিল। মনে মনে চিন্তা করিলেন, কি আশ্চর্য্য! এরূপ বিস্ময়কর ব্যাপার ত কখন দেখি নাই। অথবা তপস্যার অসাধ্য কি আছে! তপস্যাপ্রভাবে বশীভূত হইয়া অচেতনেরাও কামনা সফল করে, সন্দেহ নাই। অনন্তর তাপসীর অনুরোধে সুস্বাদু নানাবিধ ফল ভক্ষণ ও শীতল জল পান করিয়া পরিতৃপ্ত হইলেন। তাপসীও আহার করিলেন ও সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে যথাবিধ সন্ধ্যার উপাসনা করিয়া এক শিলাতলে উপবেশন পূর্ব্বক বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।