কতক দূর যাইয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বে যুবরাজ এক রমণীয় প্রদেশে উপস্থিত হইলেন। সেই দিন তথায় বাসস্থান নিরূপিত হইল! সেনাগণ আহারাদি করিয়া পটগৃহে নিদ্রা গেল। রাজকুমারও শয়ন করিলেন। প্রত্যূষে সেনাগণ পুনর্ব্বার শ্রেণীবদ্ধ হইয়া চলিল। যাইতে যাইতে বৈশম্পায়ন রাজকুমারকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, যুবরাজ! মহারাজ যে দেশ জয় করেন নাই, যে দুর্গ আক্রমণ করেন নাই এরূপ দেশ ও দুর্গই দেখিতে পাই না। আমরা যে দিকে যাইতেছি, দেখিতেছি সকলই তাঁহার রাজ্যের অন্তর্গত। মহারাজের বিক্রম ও ঐশ্বর্য্য দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। তিনি সমুদায় দেশ জয় করিয়াছেন, সকল রাজাকে আপন অধীনে রাখিয়াছেন, সমুদায় রত্ন সংগ্রহ করিয়াছেন।
অনন্তর যুবরাজ পরাক্রান্ত ও বলশালী সৈন্য দ্বারা পূর্ব্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর ক্রমে ক্রমে অবশিষ্ট সকল দেশ জয় করিয়া কৈলাসপর্ব্বতের নিকটবর্ত্তী হেমজটনামক কিরাতদিগের সুবর্ণপুরনাম্নী নগরীতে উপস্থিত হইলেন। সংগ্রামে কিরাতদিগকে পরাজিত করিয়া পরিশ্রান্ত ও একান্ত ক্লান্ত সেনাগণকে কিঞ্চিৎ কাল বিশ্রাম করিতে আদেশ দিলেন। আপনিও তথায় আরাম করিতে লাগিলেন।
একদা তথা হইতে মৃগয়ার্থ নির্গত হইয়া একটী কিন্নর ও একটী কিন্নরী বনে ভ্রমণ করিতেছে দেখিলেন। অদৃষ্টপূর্ব্ব কিন্নরমিথুন দর্শনে অত্যন্ত কৌতুকাক্রান্ত হইয়া ধরিবার আশয়ে সেই দিকে অশ্ব চালনা করিলেন। অশ্ব বায়ুবেগে ধাবিত হইল। কিন্নরমিথুনও মানুষ দর্শনে ভীত হইয়া দ্রুত বেগে পলায়ন করিতে লাগিল। শীঘ্র গমনে কেহই অপারগ নহে। ঘোটক এরূপ দ্রুতবেগে দৌড়িল যে, কিন্নরমিথুন এই ধরিলাম বলিয়া রাজকুমারের ক্ষণে ক্ষণে বোধ হইতে লাগিল। এ দিকে কিন্নরমিথুনও প্রাণপণে দৌড়িয়া গিয়া এক পর্ব্বতের উপরি আরোহণ করিল। ঘোটক তথায় উঠিতে পারিল না। রাজকুমার পর্ব্বতের উপত্যকা হইতে ঊর্দ্ধ দৃষ্টে দেখিতে লাগিলেন। উহারা পর্ব্বতের শৃঙ্গে আরোহণ পূর্ব্বক ক্রমে ক্রমে দৃষ্টিপথের অগোচর হইল।
কিন্নরমিথুনগ্রহণে হতাশ হইয়া মনে মনে কহিলেন, কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি; কিন্নরমিথুন কিরূপে ধরিব, ধরিয়াই বা কি হইবে, একবারও বিবেচনা হয় নাই। বোধ হয় সেনানিবেশ হইতে অধিক দূর আসিয়াছি। এক্ষণে কি করি, কিরূপে পুনর্ব্বার তথায় যাই। এ দিকে কখন আসি নাই, কোন্ পথ দিয়া যাইতে হয় কিছুই জানি না। এই নির্জ্জন গহনে মানবের সমাগম নাই। কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিয়া যে, পথের নিদর্শন পাইব তাহারও উপায় নাই। শুনিয়াছি সুবর্ণপুরের উত্তরে নিবিড় বন, বন পার হইলেই কৈলাসপর্ব্বত। কিন্নরমিথুন যে পর্ব্বতে আরোহণ করিল বোধ হয়, উহা কৈলাসপর্ব্বত। দক্ষিণ দিকে ক্রমাগত প্রতিগমন করিলে স্কন্ধাবারে পঁহুছিবার সম্ভাবনা। অদৃষ্টে কত কষ্ট আছে বলিতে পারি না। আপনি কুকর্ম্ম করিয়াছি, কাহার দোষ দিব? কেই বা ইহার ফলভোগ করিবে, যে রূপে হউক যাইতে হইবেক। এই স্থির করিয়া ঘোটককে দক্ষিণ দিকে ফিরাইলেন। তখন বেলা দুই প্রহর। দিনকর গগনমণ্ডলের মধ্যবর্ত্তী হইয়া অতিশয় উত্তাপ দিতেছেন। পক্ষিগণ নীরব, বন নিস্তব্ধ, ঘোটক অতিশয় পরিশ্রান্ত ও ঘর্ম্মাক্তকলেবর। আপনিও তৃষ্ণাতুর হইয়াছেন দেখিয়া তরুতলের ছায়ায় অশ্ব বাঁধিলেন এবং হরিদ্বর্ণ দুর্ব্বাদলের আসনে উপবেশন পূর্ব্বক ক্ষণকাল বিশ্রামের পর জলপ্রাপ্তির আশয়ে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। এক পথে হস্তীর পদচিহ্ন ও মদচিহ্ন রহিয়াছে এবং কুমুদ, কহ্লার ও মৃণাল ছিন্ন ভিন্ন হইয়া পতিত আছে দেখিয়া স্থির করিলেন, গিরিচর করিযূথ এই পথে জলপান করিতে যায়, সন্দেহ নাই। এই পথ দিয়া যাইলে অবশ্য জলাশয় পাইতে পারিব।
অনন্তর সেই পথে চলিলেন। পথের ধারে উন্নত পাদপ সকল বিস্তৃত শাখা প্রশাখা দ্বারা গগন আকীর্ণ করিয়া রহিয়াছে। বোধ হয় যেন, বাহু প্রসারণ পূর্ব্বক অঙ্গুলি সঙ্কেত দ্বারা তৃষ্ণার্ত্ত পথিকদিগকে জল পান করিবার নিমিত্ত ডাকিতেছে। স্থানে স্থানে কুঞ্জবন ও লতামণ্ডপ, মধ্যে মধ্যে মসৃণ ও উজ্জ্বলশিলা পতিত রহিয়াছে। নানাবিধ রমণীয় প্রদেশ ও বিচিত্র উপবন দেখিতে দেখিতে কতক দূর যাইয়া বারিশীকরসম্পৃক্ত সুশীতল সমীরণস্পর্শে বিগতক্লম হইলেন। বোধ হইল যেন, তুষারে অবগাহন করিতেছেন। সরোবর নিকটবর্ত্তী হওয়াতে মনে মনে অতিশয় আহ্লাদ জন্মিল। অনন্তর মধুপানমত্ত মধুকর ও কেলিপর কলহংসের কোলাহলে আহূত হইয়া সরোবরের সমীপবর্ত্তী হইলেন। চতুর্দ্দিকে শ্রেণীবদ্ধ তরুমধ্যে ত্রৈলোক্যলক্ষ্মীর দর্পণস্বরূপ বসুন্ধরাদেবীর স্ফটিকগৃহস্বরূপ, অচ্ছোদননামক সরোবর নেত্রগোচর করিলেন। সরোবরের জল অতি নির্ম্মল। জলে কমল, কুমুদ, কহ্লার প্রভৃতি নানাবিধ কুসুম বিকসিত হইয়াছে। মধুকর গুন্ গুন্ ধ্বনি করিয়া এক পুষ্প হইতে অন্য পুষ্পে বসিয়া মধুপান করিতেছে। কলহংস সকল কলরব করিয়া কেলি করিতেছে। কুসুমের সুরভিরেণু হরণ করিয়া শীতল সমীরণ নানা দিকে সুগন্ধ বিস্তার করিতেছে। সরোবরের শোভা দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, কিন্নরমিথুনের অনুসরণ নিষ্ফল হইলেও এই মনোহর সরোবর দেখিয়া আমার নেত্রযুগল সফল ও চিত্ত সফল হইল। এতাদৃশ রমণীয় বস্তু কখন দেখিও নাই, দেখিবও না; বোধ হয়, ভগবান্ ভবানীপতি এই সরোবরের শোভায় মোহিত হইয়া কৈলাসনিবাস পরিত্যাগ করিতে পারেন না। অনন্তর সরোবরের দক্ষিণ তীরে উপস্থিত হইয়া অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন। পৃষ্ঠ হইতে পর্য্যাণ উপনীত হইলে ইন্দ্রায়ুধ এক বার ক্ষিতিতলে বিলুণ্ঠিত হইল। পরে ইচ্ছাক্রমে স্নান ও জলপান করিয়া তীরে উঠিলে রাজকুমার উহার পশ্চাদ্ভাগের পদদ্বয় পাশ দ্বারা আবদ্ধ করিয়া দিলেন। সে তীরপ্ররূঢ় নবীন দূর্ব্বা ভক্ষণ করিতে লাগিল। রাজকুমারও সরোবরে অবগাহন পূর্ব্বক মৃণাল ভক্ষণ ও জল পান করিয়া তীরে উঠিলেন। এক লতামণ্ডপমধ্যবর্ত্তী শিলাতলে নলিনীপত্রের শয্যা ও উত্তরীয় বস্ত্রের উপাধান প্রস্তুত করিয়া শয়ন করিলেন।