সদ্বংশে জন্মিলেই যে, সৎ ও বিনীত হয় একথা অগ্রাহ্য। উর্ব্বরা ভূমিতে কি কণ্টকবৃক্ষ জন্মে না? চন্দনকাষ্ঠের ঘর্ষণে যে অগ্নি নির্গত হয় উহার কি দাহশক্তি থাকে না? ভবাদৃশ বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরাই উপদেশের যথার্থ পাত্র। মূর্খকে উপদেশ দিলে কোন ফল হয় না। দিবাকরের কিরণ কি স্ফটিকমণির ন্যায় মৃৎপিণ্ডে প্রতিফলিত হইতে পারে? সদুপদেশ অমূল্য ও অসমুদ্রসম্ভূত রত্ন। উহা শরীরের বৈরূপ্য প্রভৃতি জরার কার্য্য প্রকাশ না করিয়াও বৃদ্ধত্ব সম্পাদন করে। ঐশ্বর্য্যশালীকে উপদেশ দেয় এমন লোক অতি বিরল। যেমন গিরিগুহার নিকটে শব্দ করিলে প্রতিশব্দ হয়, সেইরূপ পার্শ্ববর্ত্তী লোকের মুখে প্রভুবাক্যের প্রতিধ্বনি হইতে থাকে; অর্থাৎ প্রভু যাহা কহেন, পারিষদেরা তাহাই যুক্তিযুক্ত বলিয়া অঙ্গীকার করে। প্রভুর নিতান্ত অসঙ্গত ও অন্যায় কথাও পারিষদদিগের নিকট সুসঙ্গত ও ন্যায়ানুগত হয় এবং সেই কথার পুনঃপুনঃ উল্লেখ করিয়া তাহারা প্রভুর কতই প্রশংসা করিতে থাকে। তাঁহার কথার বিপরীত কথা বলিতে কাহারও সাহস হয় না। যদি কোন সাহসিক পুরুষ ভয় পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার কথা অন্যায় ও অযুক্ত বলিয়া বুঝাইয়া দেন, তথাপি তাহা গ্রাহ্য হয় না। প্রভু সে সময় বধির হন অথবা ক্রোধান্ধ হইয়া আত্মমতের বিপরীতবাদীর অপমান করেন। অর্থ অনর্থের মূল। মিথ্যা অভিমান, অকিঞ্চিৎকর অহঙ্কার ও বৃথা ঔদ্ধত্য প্রায় অর্থ হইতে উৎপন্ন হয়।
প্রথমতঃ লক্ষ্মীর প্রকৃতি বিবেচনা করিয়া দেখ। ইনি অতিদুঃখে লব্ধ ও অতিযত্নে রক্ষিত হইলেও কখন একস্থানে স্থির হইয়া থাকেন না। রূপ, গুণ, বৈদগ্ধ, কুল, শীল কিছুই বিবেচনা করেন না। রূপবান্, গুণবান্, বিদ্বান্, সদ্বংশজাত, সুশীল ব্যক্তিকেও পরিত্যাগ করিয়া জঘন্য পুরুষাধমের আশ্রয় লন। দুরাচার লক্ষ্মী যাহাকে আশ্রয় করে, সে স্বার্থনিষ্পাদনপর ও লুব্ধপ্রকৃতি হইয়া দ্যূতক্রীড়াকে বিনোদ, পশুধর্ম্মকে রসিকতা, যথেষ্টাচারকে প্রভুত্ব ও মৃগয়াকে ব্যায়াম বলিয়া গণনা করে। মিথ্যা স্তুতিবাদ করিতে না পারিলে ধনিদিগের নিকট জীবিকালাভ করা কঠিন। যাহারা অন্যকার্য্যপরাঙ্মুখ ও কার্য্যাকার্য্যবিবেকশূন্য হয় এবং সর্ব্বদা বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ধনেশ্বরকে জগদীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করে, তাহারাই ধনিগণের সন্নিধানে বসিতে পায় ও প্রশংসাভাজন হয়। প্রভু স্তুতিবাদককে যথার্থবাদী বলিয়া জ্ঞান করেন, তাহার সহিতই আলাপ করেন, তাহাকেই সদ্বিবেচক ও বুদ্ধিমান্ বলিয়া ভাবেন, তাহার পরামর্শক্রমেই কার্য্য করিয়া থাকেন। স্পষ্টবক্তা উপদেষ্টাকে নিন্দুক বলিয়া অবজ্ঞা করেন, নিকটেও বসিতে দেন না। তুমি দুরবগাহ নীতিপ্রয়োগ ও দুর্ব্বোধ রাজ্যতন্ত্রের ভারগ্রহণে প্রবৃত্ত হইয়াছ; সাবধান, যেন সাধুদিগের উপহাসাস্পদ ও চাটুকারের প্রতারণাস্পদ হইও না। চাটুকারের প্রিয় বচনে তোমার যেন ভ্রান্তি জন্মে না। যথার্থবাদীকে নিন্দুক বলিয়া যেন অবজ্ঞা করিও না। রাজারা আপন চক্ষে কিছুই দেখিতে পান না এবং এরূপ হতভাগ্য লোক দ্বারা পরিবৃত থাকেন, প্রতারণা করাই যাহাদিগের সম্পূর্ণ মানস। তাহারা প্রভুকে প্রতারণা করিয়া আপন অভিপ্রায় সিদ্ধ করিতে পারিলেই চরিতার্থ হয় ও সর্ব্বদা উহারই চেষ্টা পায়। বাহ্য ভক্তি প্রদর্শন পূর্ব্বক আপনাদিগের দুষ্ট অভিপ্রায় গোপন করিয়া রাখে, সময় পাইলেই চাটুবচনে প্রভুকে প্রতারিত করিয়া লোকের সর্ব্বনাশ করে। তুমি স্বভাবতঃ ধীর; তথাপি তোমাকে বারংবার উপদেশ দিতেছি, সাবধান, যেন ধন ও যৌবনমদে উন্মত্ত হইয়া কর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ ও অসদাচরণে প্রবৃত্ত হইও না। এক্ষণে মহারাজের ইচ্ছাক্রমে অভিনব যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া কুলক্রমাগত ভূভার বহন কর, অরাতিমণ্ডলের মস্তক অবনত কর, এবং সমুদায় দেশ জয় করিয়া অখণ্ড ভূমণ্ডলে আপন আধিপত্য স্থাপন পূর্ব্বক প্রজাদিগের প্রতিপালন কর। এইরূপ উপদেশ দিয়া অমাত্য ক্ষান্ত হইলেন। চন্দ্রাপীড় শুকনাসের গভীর অর্থযুক্ত উপদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে উহারই আন্দোলন করিতে করিতে বাটী গমন করিলেন।
অভিষেকসামগ্রী সমাহৃত হইলে, অমাত্য ও পুরোহিতের সহিত রাজা শুভ দিনে ও শুভ লগ্নে তীর্থ, নদী ও সাগর হইতে আনীত মন্ত্রপূত বারি দ্বারা রাজকুমারের অভিষেক করিলেন। লতা যেরূপ এক বৃক্ষ হইতে শাখা দ্বারা বৃক্ষান্তর আশ্রয় করে, সেরূপ রাজসংক্রান্ত রাজলক্ষ্মী অংশক্রমে যুবরাজকে অবলম্বন করিলেন। পবিত্র তীর্থজলে স্নান করিয়া রাজকুমার উজ্জ্বল শ্রী প্রাপ্ত হইলেন। অভিষেকানন্তর ধবল বসন, উজ্জ্বল ভূষণ ও মনোহর মাল্য ধারণ পূর্ব্বক অঙ্গে সুগন্ধি গন্ধদ্রব্য লেপন করিলেন। অনন্তর সভামণ্ডপে প্রবেশপূর্ব্বক শশধর যেরূপ সুমেরুশৃঙ্গে আরোহণ করিলে শোভা হয়, যুবরাজ সেইরূপ রত্নসিংহাসনে উপবেশন করিয়া সভার পরম শোভা সম্পাদন করিলেন। নব নব উপায় দ্বারা প্রজাদিগের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি ও রাজ্যের সুনিয়ম সংস্থাপন করিয়া পরম সুখে যৌবরাজ্য সম্ভোগ করিতে লাগিলেন। রাজাও পুত্ত্রকে রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।
২.০৪ যুবরাজ দিগ্বিজয়ের নিমিত্ত যাত্রা করিলেন
কিছু দিনের পর যুবরাজ দিগ্বিজয়ের নিমিত্ত যাত্রা করিলেন। ঘনঘটার ঘোর ঘর্ঘর ঘোষের ন্যায় দুন্দুভিধ্বনি হইল। সৈন্যগণের কলরবে চতুর্দ্দিক্ ব্যাপ্ত হইল। রাজকুমার স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত করেণুকায় আরোহণ করিলেন। পত্রলেখাও ঐ হস্তিনীর উপর উঠিয়া বসিল। বৈশম্পায়ন আর এক করিণীপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া রাজকুমারের পার্শ্ববর্ত্তী হইলেন। ক্ষণ কালের মধ্যে মহীতল তুরঙ্গময়, দিঙ্মণ্ডল মাতঙ্গময়, অন্তরীক্ষ আতপত্রময়, সমীরণ মদগন্ধময়, পথ সৈন্যময় ও নগর জয়শব্দময় হইল। সেনাগণ সুসজ্জিত হইয়া বহির্গত হইলে তাহাদিগের পাদবিক্ষেপে মেদিনী কাঁপিতে লাগিল। শাণিত অস্ত্র শস্ত্রে দিনকরের করপ্রভা প্রতিবিম্বিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, শিখিকুল গগনমণ্ডলে শিখাকলাপ বিস্তীর্ণ করিয়া রহিয়াছে, সৌদামিনী প্রকাশ পাইতেছে, ইন্দ্রধনু উদিত হইয়াছে। করীদিগের বৃংহিত, অশ্বদিগের হেষারব, দুন্দুভির ভীষণ শব্দ, সৈন্যদিগের কলরবে বোধ হইল যেন, প্রলয়কাল উপস্থিত। ধূলি উত্থিত হইয়া গগনমণ্ডল অন্ধকারাবৃত করিল। আকাশ ও ভূমির কিছুই বিশেষ রহিল না। বোধ হইল যেন, সৈন্যভার সহ্য করিতে না পারিয়া ধরা উপরে উঠিতেছে। এক এক বার এরূপ কলরব হয় যে কিছুই শুনা যায় না।