প্রভাত হইলে পিতার অনুমতি লইয়া শিকারী কুক্কুর, শিক্ষিত হস্তী, বেগগামী অশ্ব ও অসংখ্য অস্ত্রধারী বীরপুরুষ সমভিব্যাহারে করিয়া মৃগয়ার্থ বনে প্রবেশিলেন। দেখিলেন, উদারস্বভাব সিংহ সম্রাটের ন্যায় নির্ভয়ে গিরিগুহায় শয়ন করিয়া আছে। হিংস্র শার্দ্দূল ভয়ঙ্কর আকার স্বীকার পূর্ব্বক পশুদিগকে আক্রমণ করিতেছে। মৃগকুল ত্রস্ত ও শশব্যস্ত হইয়া ত্বরিত বেগে ইতস্ততঃ দৌড়িতেছে। বন্য হস্তী দলবদ্ধ হইয়া চলিতেছে। মহিষকুল রক্তবর্ণ চক্ষু দ্বারা ভয় প্রদর্শন করিয়া নির্ভয়ে বেড়াইতেছে। বরাহ, ভল্লূক, গণ্ডার প্রভৃতির ভীষণ আকার দেখিলে ও চীৎকার শব্দ শুনিলে কলেবর কম্পিত হয়। নিবিড় বন, তথায় সূর্য্যের কিরণ প্রায় প্রবেশ করিতে পারে না। রাজকুমার এতাদৃশ ভীষণ গহনে প্রবেশিয়া ভল্ল ও নারাচ দ্বারা ভল্লূক, সারঙ্গ, শূকর প্রভৃতি বহুবিধ বন্য পশু মারিয়া ফেলিলেন। কোন কোন পশুকে আঘাত না করিয়া কেবল কৌশলক্রমে ধরিলেন। মৃগয়াবিষয়ে এরূপ সুশিক্ষিত ছিলেন যে, উড্ডীন বিহগাবলীকেও অবলীলাক্রমে বাণবিদ্ধ করিতে লাগিলেন।
বেলা দুই প্রহর হইল। সূর্য্যমণ্ডল ঠিক্ মস্তকের উপরিভাগ হইতে অগ্নিময় কিরণ বিস্তার করিল। সূর্য্যের আতপে ও মৃগয়াজন্য শ্রমে একান্ত ক্লান্ত হওয়াতে রাজকুমারের সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ম্মবারিতে পরিপ্লুত হইল। স্বেদার্দ্র শরীরে কুসুমরেণু পতিত হওয়াতে ও বিন্দু বিন্দু রক্ত লাগাতে যেন অঙ্গে অঙ্গরাগ ও রক্তচন্দন লেপন করিয়াছেন, বোধ হইল। ইন্দ্রায়ুধের মুখে ফেনপুঞ্জ ও শরীরে স্বেদজল বহির্গত হইল। সেই রৌদ্রে স্বহস্তে নব পল্লবের ছত্র ধরিয়া সমভিব্যাহারী রাজগণের সহিত মৃগয়ার কথা কহিতে কহিতে বাটী প্রত্যাগমন করিলেন। দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া তুরঙ্গ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। তথায় মৃগয়াবেশ পরিত্যাগ ও ক্ষণকাল বিশ্রামের পর স্নান করিয়া অঙ্গে অঙ্গরাগলেপন ও পট্টবসন পরিধান পূর্ব্বক আহারমণ্ডপে গমন করিলেন। আপনি আহার করিয়া স্বহস্তে ইন্দ্রায়ুধের ভোজনসামগ্রী আনিয়া দিলেন। সে দিন এইরূপে অতিবাহিত হইল।
পর দিন প্রাতঃকালে আপন প্রাসাদে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কৈলাসনামক কঞ্চুকী স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা এক সুন্দরী কুমারীকে সঙ্গে করিয়া তথায় উপস্থিত হইল, বিনীত বচনে কহিল, কুমার দেবী আদেশ করিলেন, এই কন্যাকে আপনার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী করুন। ইনি কুলুতদেশীয় রাজার দুহিতা, নাম পত্রলেখা। মহারাজ কুলুতরাজধানী জয় করিয়া এই কন্যাকে বন্দী করিয়া আনেন ও অন্তঃপুরপরিচারিকার মধ্যে নিবেশিত করেন। রাণী পরিচয় পাইয়া আপন কন্যার ন্যায় লালন পালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়াছেন এবং অতিশয় ভাল বাসিয়া থাকেন, ইহাকে সামান্য পরিচারিকার ন্যায় জ্ঞান করিবেন না। সখী ও শিষ্যার ন্যায় বিশ্বাস করিবেন। রাজকন্যার সমুচিত সমাদর করিবেন। ইনি অতিশয় সুশীল ও সরলস্বভাব এবং এরূপ গুণবতী যে আপনাকে ইঁহার গুণে অবশ্য বশীভূত হইতে হইবেক। আপাততঃ ইঁহার কুল শীলের বিষয় কিছুই জানেন না বলিয়া কিঞ্চিৎ পরিচয় দিলাম। কঞ্চুকীর মুখে জননীর আজ্ঞা শুনিয়া নিমেষশূন্য লোচনে পত্রলেখাকে দেখিতে লাগিলেন। তাহার আকার দেখিয়াই বুঝিলেন ঐ কন্যা সামান্য কন্যা নহে। অনন্তর জননীর আদেশ গ্রহণ করিলাম বলিয়া কঞ্চুকীকে বিদায় দিলেন। পত্রলেখা তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী হইয়া ছায়ার ন্যায় রাজকুমারের অনুবর্ত্তিনী হইল। রাজকুমারও তাহার গুণে প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া দিন দিন নব নব অনুরাগ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।
২.০৩ রাজা চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষেক
কিছু দিন পরে রাজা চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষেক করিতে অভিলাষ করিলেন। রাজকুমার যুবরাজ হইবেন এই ঘোষণা সর্ব্বত্র প্রচারিত হইল। রাজবাটী মহোৎসবময় ও নগর আনন্দকোলাহলে পরিপূর্ণ হইল। অভিষেকের সামগ্রীসম্ভার সংগ্রহের নিমিত্ত লোক সকল দিগ্দিগন্তে গমন করিল।
একদা কার্য্যক্রমে চন্দ্রাপীড় অমাত্যের বাটীতে গিয়াছেন; তথায় শুকনাস তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া মধুর বচনে কহিলেন, কুমার! তুমি সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন ও সমুদায় বিদ্যা অভ্যাস করিয়াছ, সকল কলা শিখিয়াছ, ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া যাহা জ্ঞাতব্য সমুদায় জানিয়াছ। তোমার অজ্ঞাত ও উপদেষ্টব্য কিছুই নাই। তুমি যুবা, মহারাজ তোমাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত ও ধনসম্পত্তির অধিকারী করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। সুতরাং যৌবন, ধনসম্পত্তি, প্রভুত্ব, তিনেরই অধিকারী হইলে। কিন্তু যৌবন অতি বিষম কাল। যৌবনরূপ বনে প্রবেশিলে বন্য জন্তুর ন্যায় ব্যবহার হয়। যুবা পুরুষেরা কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি পশুধর্ম্মকে সুখের হেতু ও স্বর্গের সেতু জ্ঞান করে। যৌবনপ্রভাবে মনে একপ্রকার তমঃ উপস্থিত হয়, উহা কিছুতেই নিরস্ত হয় না। যৌবনের আরম্ভে অতি নির্ম্মল বুদ্ধিও বর্ষাকালীন নদীর ন্যায় কলুষিতা হয়। বিষয়তৃষ্ণা ইন্দ্রিয়দিগকে আক্রমণ করে। তখন অতিগর্হিত অসৎ কর্ম্মকেও দুষ্কর্ম্ম বলিয়া বোধ হয় না। তখন লোকের প্রতি অত্যাচার করিয়া স্বার্থসম্পাদন করিতেও লজ্জা বোধ হয় না। সুরাপান না করিলে ও চক্ষুর দোষ না থাকিলেও ধনমদে মত্ততা ও অন্ধতা জন্মে। ধনমদে উন্মত্ত হইলে হিতাহিত বা সদসদ্বিবেচনা থাকে না। অহঙ্কার ধনের অনুগামী। অহঙ্কৃত পুরুষেরা মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না। আপনাকেই সর্ব্বাপেক্ষা গুণবান্, বিদ্বান্, ও প্রধান বলিয়া ভাবে; অন্যের নিকটেও সেইরূপ প্রকাশ করে। তাহার স্বভাব এরূপ উদ্ধত হয় যে, আপনার মতের বিপরীত কথা শুনিলে তৎক্ষণাৎ খড়্গহস্ত হইয়া উঠে। প্রভুত্বরূপ হলাহলের ঔষধ নাই। প্রভুজনেরা অধীন লোকদিগকে দাসের ন্যায় জ্ঞান করে। আপন সুখে সন্তুষ্ট থাকিয়া পরের দুঃখ সন্তাপ কিছুই দেখিতে পায় না। তাহারা প্রায় স্বার্থপর ও অন্যের অনিষ্টকারক হইয়া উঠে। যৌবরাজ্যে, যৌবন, প্রভুত্ব ও অতুল ঐশ্বর্য্য, এ সকল কেবল অনর্থপরম্পরা। অসামান্যধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই ইহার তরঙ্গ হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধিরূপ দৃঢ় নৌকা না থাকিলে উহার প্রবল প্রবাহে মগ্ন হইতে হয়। একবার মগ্ন হইলে আর উঠিবার সামর্থ্য থাকে না।