ক্রমে দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া ঘোটক হইতে অবতীর্ণ হইলেন। বলাহক অগ্রে অগ্রে পথ দেখাইয়া চলিল। রাজকুমার বৈশম্পায়নের হস্তধারণপূর্ব্বক রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, শত শত বলবান দ্বারপাল অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া দ্বারে দণ্ডায়মান আছে। দ্বারদেশ অতিক্রম করিয়া দেখিলেন, কোন স্থানে ধনু, বাণ, তরবারি প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্র শস্ত্রে পরিপূর্ণ অস্ত্রশালা; কোন স্থানে সিংহ, গণ্ডার, করী, করভ, ব্যাঘ্র ভল্লূক প্রভৃতি ভয়ঙ্করপশুসমাকীর্ণ পশুশালা; কোন স্থানে নানা দেশীয়, সুলক্ষণসম্পন্ন, নানাপ্রকার অশ্বে বেষ্টিত মন্দুরা; কোন স্থানে কুররী, কোকিল, রাজহংস, চাতক, শিখণ্ডী, শুক, শারিকা প্রভৃতি পক্ষিগণের মধুর কোলাহলে পরিপূর্ণ পক্ষিশালা; কোন স্থানে বেণু, বীণা, মুরজ, মৃদঙ্গ প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রে বিভূষিত সঙ্গীতশালা; কোন স্থানে বিচিত্রচিত্রশোভিত চিত্রশালিকা শোভা পাইতেছে। কৃত্রিম ক্রীড়াপর্ব্বত, মনোহর সরোবর, সুরম্য জলযন্ত্র, রমণীয় উপবন স্থানে স্থানে রহিয়াছে। অশেষদেশভাষাজ্ঞ নীতিপরায়ণ ধার্ম্মিক পুরুষেরা ধর্ম্মাধিকরণমন্দিরে উপবেশন পূর্ব্বক ধর্ম্মশাস্ত্রের মর্ম্মানুসারে বিচার করিতেছেন। সমাগত পুরুষেরা বিবিধরত্নাসনভূষিত সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন। কোন স্থানে নর্ত্তকীরা নৃত্য, গায়কেরা সঙ্গীত ও বন্দিগণ স্তুতিপাঠ করিতেছে। জলচর পক্ষী সকল কেলি করিয়া বেড়াইতেছে। বালকবালিকাগণ ময়ূর ও ময়ূরীর সহিত ক্রীড়া করিতেছে। হরিণ ও হরিণীগণ মানুষসমাগমে ত্রস্ত হইয়া ভয়চকিতলোচনে বাটীর চতুর্দ্দিকে দৌড়িতেছে।
অনন্তর ছয় প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিয়া সপ্তম প্রকোষ্ঠের অভ্যন্তরে প্রবেশিয়া মহারাজের আবাসগৃহের নিকটবর্ত্তী হইলেন। অন্তঃপুরপুরন্ধ্রীরা রাজকুমারকে দেখিবামাত্র আনন্দিত মনে মঙ্গলাচরণ করিতে লাগিল। মহারাজ পরিষ্কৃত শয্যামণ্ডিত পর্য্যঙ্কে নিষণ্ণ আছেন, শরীররক্ষাধিকৃত অস্ত্রধারী দ্বারপালেরা সতর্কতা পূর্ব্বক প্রহরীর কার্য্য করিতেছে; এমন সময়ে চন্দ্রাপীড় পিতার নিকটে উপস্থিত হইলেন। “মহারাজ! অবলোকন করুন” দ্বারপাল এই কথা কহিলে, রাজা দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক বৈশম্পায়ন সমভিব্যাহারী চন্দ্রাপীড়কে সমাগত দেখিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। করপ্রসারণ পূর্ব্বক প্রণত পুত্ত্রকে আলিঙ্গন করিলেন। তাঁহার স্নেহবিকসিত লোচন হইতে আনন্দাশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। বৈশম্পায়নকেও সমাদরে আলিঙ্গন করিয়া আসনে উপবেশন করিতে কহিলেন। ক্ষণকাল তথায় বসিয়া রাজকুমার জননীর নিকট গমন করিলেন। পুত্ত্রবৎসলা বিলাসবতী স্নিগ্ধ ও প্রীতিপ্রফুল্ল নয়নে পুত্ত্রকে পুনঃ পুনঃ নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার মস্তক আঘ্রাণ ও হস্ত দ্বারা গাত্রস্পর্শ পূর্ব্বক আপন উৎসঙ্গ দেশে বসাইলেন ও স্নেহসংবলিত মধুর বচনে বলিলেন, বৎস! তোমাকে নানা বিদ্যায় বিভূষিত দেখিয়া নয়ন ও মন পরিতৃপ্ত হইল। এক্ষণে বধূসহচারী দেখিলে সকল মনোরথ পূর্ণ হয়। এই কথা কহিয়া লজ্জাবনত পুত্ত্রের কপোলদেশে চুম্বন করিতে লাগিলেন।
রাজকুমার এই রূপে সমস্ত অন্তঃপুরবাসিনীদিগকে দর্শন দিয়া আহ্লাদিত করিলেন। পরিশেষে শুকনাসের ভবনে উপস্থিত হইলেন। অমাত্যের ভবনও এরূপ সমৃদ্ধিসম্পন্ন যে, রাজবাটী হইতে বিভিন্ন বোধ হয় না। শুকনাস সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন। সমাগত সামন্ত ও ভূপতিগণ চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন, এমন সময়ে চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়ন তথায় প্রবেশিলেন। সকলে সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সমাদরে সম্ভাষণ করিল। শুকনাস প্রণত পুত্ত্র ও রাজকুমারকে যুগপৎ আলিঙ্গন করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। পরে রাজনন্দনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস চন্দ্রাপীড়! অদ্য তোমাকে কৃতবিদ্য দেখিয়া মহারাজ যেরূপ সন্তুষ্ট হইয়াছেন, শত শত সাম্রাজ্যলাভেও তাদৃশ সন্তোষের সম্ভাবনা নাই। আজি গুরুজনের আশীর্ব্বাদ ও মহারাজের পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত সুকৃতি ফলিল। আজি কুলদেবতা প্রসন্ন হইলেন। প্রজাগণ কি ধন্য ও পুণ্যবান্! যাহাদিগের প্রতিপালনের নিমিত্ত তুমি ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছ। বসুমতী কি সৌভাগ্যবতী! যিনি পতিভাবে তোমার আরাধনা করিবেন। ভগবান্ যেরূপ নানা অবতার হইয়া ভূভার বহন করিয়া থাকেন, তুমিও সেইরূপ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া ভূভার বহন ও প্রজাদিগের প্রতিপালন কর। রাজকুমার শুকনাসের সভায় ক্ষণকাল অবস্থিতি করিয়া মনোরমার নিকট গমন ও ভক্তিপূর্ব্বক তাঁহাকে নমস্কার করিলেন। তথা হইতে বাটী আসিয়া স্নান ভোজন প্রভৃতি সমুদায় কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়া মহারাজের আজ্ঞানুসারে শ্রীমণ্ডপনামক প্রাসাদে গিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। শ্রীমণ্ডপের নিকটে ইন্দ্রায়ুধের বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইল।
দিবাবসানে দিঙ্মণ্ডল লোহিত বর্ণ হইল। সন্ধ্যারাগে রক্তবর্ণ হইয়া চক্রবাকমিথুন ভিন্ন ভিন্ন দিকে উৎপতিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, বিরহবেদনা স্মৃতিপথারূঢ় হওয়াতে তাহাদিগের হৃদয় বিদীর্ণ হইয়াছে ও গাত্র হইতে রক্তধারা পড়িতেছে। সম্মানিত ব্যক্তিরা বিপদ্কালেও নীচ পদবীতে পদার্পণ করেন না, ইহাই জানাইবার নিমিত্ত রবি অস্তগমনকালেও পশ্চিমাচলের উন্নত শিখর আশ্রয় করিলেন। দিনকর অস্তগত হইলেন, কিন্তু রজনী সমাগতা হয় নাই। এই সময়ে তাপের বিগম ও অন্ধকারের অনুদয় প্রযুক্ত লোকের অন্তঃকরণ আনন্দে প্রফুল্ল হইল। সূর্য্যরূপ সিংহ অস্তাচলের গুহাশায়ী হইলে ধ্বান্তরূপ দন্তিযূথ নির্ভয়ে জগৎ আক্রমণ করিল। নলিনী দিনমণির বিরহে অলিরূপ অশ্রুজল পরিত্যাগ পূর্ব্বক কমলরূপ নেত্র নিমীলন করিল। বিহঙ্গমকুল কোলাহল করিয়া উঠিল। অনন্তর প্রজ্বলিত প্রদীপশিখা ও উজ্জ্বল মণির আলোকে রাজবাটীর তিমির নিরস্ত হইয়া গেল। চন্দ্রাপীড় পিতা মাতার নিকটে নানা কথা প্রসঙ্গে ক্ষণকাল ক্ষেপ করিয়া আহারাদি করিলেন। পরে আপন প্রাসাদে আগমন পূর্ব্বক কোমলশয্যামণ্ডিত পর্য্যঙ্কে সুখে নিদ্রা গেলেন।