১. উপক্রমণিকা
প্রথম বারের বিজ্ঞাপন
সংস্কৃত ভাষায় মহাকবি বাণভট্টবিরচিত কাদম্বরী নামে যে মনোহর গদ্য গ্রন্থ প্রসিদ্ধ আছে, তাহা অবলম্বন করিয়া এই পুস্তক লিখিত হইল। ইহা ঐ গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ নহে। গল্পটি মাত্র অবিকল পরিগৃহীত হইয়াছে, বর্ণনার অনেক অংশ পরিত্যাগ করা গিয়াছে। সংস্কৃত কাদম্বরী পাঠে অনির্ব্বচনীয় প্রীতি লাভ হইয়া থাকে এবং তাহার বর্ণনা শুনিলে অথবা পাঠ করিলে সাতিশয় চমৎকৃত হইতে হয়। এই বাঙ্গলা অনুবাদ যে সেই রূপ প্রীতিদায়ক ও চমৎকারজনক হইবেক ইহা কোন রূপেই সম্ভাবিত নহে। যাহা হউক, যে সকল মহাশয়েরা বাঙ্গলা ভাষায় অনুরাগ প্রদর্শন করিয়া থাকেন তাঁহারা পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক এক এক বার পাঠ করিলেই সমুদায় শ্রম সফল জ্ঞান করিব।
শ্রীতারাশঙ্কর শর্ম্মা
কলিকাতা, সংস্কৃত কালেজ
৩রা আশ্বিন সংবৎ ১৯১১
দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন
কাদম্বরী দ্বিতীয় বার মুদ্রিত ও প্রচারিত হইল। এই বারে কোন কোন স্থান পরিত্যক্ত ও কোন কোন স্থান পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। যে সকল স্থান অসংলগ্ন অথবা দুরূহ বোধ হইয়াছিল, ঐ সকল স্থান সংলগ্ন ও সহজ করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইয়াছি; কিন্তু কত দূর পর্য্যন্ত কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারি না।
শ্রীতারাশঙ্কর শর্ম্মা
১৫ বৈশাখ
সংবৎ ১৯১৩
————–
উপক্রমণিকা
শূদ্রকনামে অসাধারণধীশক্তিসম্পন্ন অতিবদান্য মহাবল পরাক্রান্ত প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। বিদিশানাম্নী নগরী তাঁহার রাজধানী ছিল। যে স্থানে বেত্রবতী নদী বেগবতী হইয়া প্রবাহিত হইতেছে। রাজা নিজ বাহুবলে ও পরাক্রমে ক্রমে ক্রমে অশেষ দেশ জয় করিয়া সসাগরা ধরায় আপন আধিপত্য স্থাপন পূর্ব্বক সুখে ও নিরুদ্বেগচিত্তে সাম্রাজ্য ভোগ করেন। একদা প্রাতঃকালে আপন অমাত্য কুমারপালিত ও অন্যান্য রাজকুমারের সহিত সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে প্রতীহারী আসিয়া প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল মহারাজ! দক্ষিণাপথ হইতে এক চণ্ডালকন্যা আসিয়াছে। তাহার সমভিব্যাহারে এক শুকপক্ষী আছে। কহিল, “মহারাজ সকল রত্নের আকর, এই নিমিত্ত এই পক্ষীরত্ন তদীয় পাদপদ্মে সমর্পণ করিতে আসিয়াছি।” দ্বারে দণ্ডায়মান আছে অনুমতি হইলে আসিয়া পাদপদ্ম দর্শন করে।
রাজা প্রতিহারীর বাক্য শুনিয়া সাতিশয় কৌতুকাবিষ্ট হইলেন এবং সমীপবর্ত্তী সভাসদগণের মুখাবলোকন পূর্ব্বক কহিলেন কি হানি আছে লইয়া আইস। প্রতিহারী যে আজ্ঞা বলিয়া চণ্ডালকন্যাকে সঙ্গে করিয়া আনিল। চণ্ডালকন্যা সভামণ্ডপে প্রবেশিয়া দেখিল উপরে মনোহর চন্দ্রাতপ, চন্দ্রাতপের চতুর্দ্দিকে মুক্তাকলাপ, মালার ন্যায় শোভা পাইতেছে; নিম্নে রাজা স্বর্ণময় অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া মণিময় সিংহাসনে বসিয়া আছেন; সমাগত রাজগণ চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন। অন্যান্য পর্ব্বতের মধ্যগত হইলে সুমেরুর যেরূপ শোভা হয়, রাজা সেইরূপ অপূর্ব্ব শ্রী ধারণ করিয়া সভামণ্ডপ উজ্জ্বল করিতেছেন। চণ্ডালকন্যা সভার শোভা দেখিয়া অতিশয় চমৎকৃত হইল এবং নৃপতিকে অনন্যমনা করিবার আশয়ে করস্থিত বেণুযষ্টি দ্বারা সভাকুট্টিমে এক বার আঘাত করিল। তালফল পতিত হইলে অরণ্যচারী হস্তিযূথ যেরূপ সেই দিকে দৃষ্টিপাত করে, বেণুযষ্টির শব্দ শুনিবামাত্র সেইরূপ সকলের চক্ষু রাজার মুখমণ্ডল হইতে অপসৃত হইয়া সেই দিকে ধাবমান হইল।
রাজাও সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন অগ্রে এক জন বৃদ্ধ, পশ্চাতে পিঞ্জরহস্ত একটী বালক এবং মধ্যে এক পরমসুন্দরী কুমারী আসিতেছে। কন্যার এরূপ রূপ লাবণ্য, যে কোন ক্রমেই তাহাকে চণ্ডালকন্যা বলিয়া বোধ হয় না। রাজা তাহার নিরুপম সৌন্দর্য্য ও অসামান্য সৌকুমার্য্য অনিমিষলোচনে অবলোকন করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। ভাবিলেন, বিধাতা বুঝি হীনজাতি বলিয়া ইহাকে স্পর্শ করেন নাই, মনে মনে কল্পনা করিয়াই ইহার রূপ লাবণ্য নির্ম্মাণ করিয়া থাকিবেন। তাহা না হইলে এরূপ রমণীয় কান্তি ও এরূপ অলৌকিক সৌন্দর্য্য কি রূপে হইতে পারে। যাহা হউক, চণ্ডালের গৃহে এরূপ সুন্দরী কুমারীর সমুদ্ভব নিতান্ত অসম্ভব ও আশ্চর্য্যের বিষয়। এইরূপ ভাবিতেছিলেন এমন সময়ে কন্যা সম্মুখে আসিয়া বিনীত ভাবে প্রণাম করিল। বৃদ্ধ পিঞ্জর লইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া বিনয়বচনে নিবেদন করিল মহারাজ! পিঞ্জরস্থিত এই শুক সকল শাস্ত্রের পারদর্শী, রাজনীতিপ্রয়োগ বিষয়ে বিলক্ষণ নিপুণ, সদ্বক্তা, চতুর, সকলকালাভিজ্ঞ; কাব্য নাটক ইতিহাসের মর্ম্মজ্ঞ ও গুণগ্রাহী। যে সকল বিদ্যা মনুষ্যেরাও অবগত নহেন সমুদয় ইহার কণ্ঠস্থ। ইহার নাম বৈশম্পায়ন। ভূমণ্ডলস্থ সমস্ত নরপতি অপেক্ষা আপনি বিদ্বান্ ও গুণগ্রাহী। এই নিমিত্ত আমাদিগের স্বামিদুহিতা আপনকার নিকট এই শুকপক্ষী আনয়ন করিয়াছেন। অনুগ্রহ পূর্ব্বক গ্রহণ করিলে ইনি আপনাকে চরিতার্থ বোধ করেন। এই বলিয়া সম্মুখে পিঞ্জর রাখিয়া কিঞ্চিদ্দূরে দণ্ডায়মান হইল।
পিঞ্জরমধ্যবর্ত্তী শুক দক্ষিণ চরণ উন্নত করিয়া মহারাজের জয় হউক বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিল। রাজা শুকের মুখ হইতে অর্থযুক্ত সুস্পষ্ট বাক্য শ্রবণ করিয়া বিস্মিত ও চমৎকৃত হইলেন। অনন্তর কুমারপালিতকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন দেখ অমাত্য! পক্ষিজাতীও সুস্পষ্ট রূপে বর্ণোচ্চারণ করিতে ও মধুরস্বরে কথা কহিতে পারে। আমি জানিতাম পক্ষী ও পশুজাতি কেবল আহার, নিদ্রা, ভয় প্রভৃতিরই পরতন্ত্র, ইহাদিগের বুদ্ধিশক্তি অথবা বাক্শক্তি কিছুই নাই। কিন্তু শুকের এই ব্যাপার দেখিয়া অতি আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। প্রথমতঃ ইহাই আশ্চর্য্য যে, পক্ষী মনুষ্যের মত কথা কহিতে পারে; দ্বিতীয়তঃ আশীর্ব্বাদ প্রয়োগের সময় ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া আশীর্ব্বাদ করেন, শুক পক্ষীও সেইরূপ দক্ষিণ চরণ উন্নত করিয়া যথাবিহিত আশীর্ব্বাদ করিল। কি আশ্চর্য্য! ইহার বুদ্ধি ও মনোবৃত্তিও মনুষ্যের মত দেখিতেছি।