সাফ কথা বলব? শিবুর যেন বলতে গিয়ে গলা ধরে এল দুঃখে। সাফ কথাটা হল, সুন্দরবন।
সুন্দরবন! আমরা সত্যিই হতভম্ব। সুন্দরবনে আবার কী?
সুন্দরবনের ব্যাঘ্র প্রকল্পের নাম শুনেছ! শিবু যেন আমাদের ওপরেই গরম হয়ে বলেছে, লাট-বেলাট হলেও সেখানে যাবার হুকুম মেলে না। এক কাঠুরে কি মধু-জোগাড়ে সেখানে যেতে পারে প্রাণ হাতে নিয়ে, গেলে অবশ্য প্রাণটি তার হাতেও বেশিক্ষণ থাকবে না। কাঠ কাটতে কি মধু জোগাড় করতে যারা যায় তারা যাবার আগে নিজেদের শ্রাদ্ধ-টাদ্ধ সেরেই যায় বলে শুনেছি। সরকারি বনবিভাগের তাই সেখানে কড়া পাহারা। অনুমতি না নিয়ে কেউ যেন সেখানে না যায়, আর অনুমতি কেউ যেন না পায় সেদিকেও কড়া নজর।
শিবুর নতুন চালটা এতক্ষণে কিছুটা বুঝে ফেলেছি। তাই সবজান্তার চালে বললাম, তা কড়া নজর তো হবেই। দুনিয়া থেকে বাঘ প্রাণীটা যাতে লোপ না পায় তাই জন্যেই এই ব্যবস্থা। বাঘ যেখানে গিজগিজ করত সেই সুন্দরবনে বাঘ মাত্র এখন এই কত—মানে বড় জোর কত হবে—এই ধরো হাজারখানেক।
এদিক থেকে নাসিকাধ্বনির মতো একটা যেন শব্দ শুনলাম, সেটা ঘনাদারই কি
তা বোঝবার আগেই শিবুর ভেংচিকাটা ঠাট্টা শোনা গেল—হাজার-হাজার! সুন্দরবনে হাজার দু-হাজার বাঘ! প্রমাণ করতে পারলে রয়্যাল জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সভ্যপদ তো বটেই, চাইকী প্রাণীতত্ত্বে নোবেল প্রাইজও পেয়ে যেতে পারিস।
মারটা এবার ইংরেজিতে যাকে বলে বিলো দ্য বেল্ট মানে কোমরের নীচে হয়ে যাচ্ছে না? চটে উঠেই বললাম, হাজার দু-হাজার না তো কত, তুই জানিস? ঠিক কি কেউ জানে, না জানতে পারে?
হ্যাঁ, পারে, আর পেরেছে। শিবু এবার আসর জমিয়ে বললে, বারো বছর আগে উনিশশো তিয়াত্তরে সুন্দরবনে বাঘ কত ছিল জানো? মাত্র একশো পঁয়ত্রিশ। হ্যাঁ, খুশি মতো অবাধ শিকার করার অত্যাচারে বাঘ তখন প্রায় লোপ পেতে বসেছে পৃথিবী থেকে। বাঘ তো শুধু এশিয়ারই প্রাণী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই সাইবেরিয়া থেকে এই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বর্মা মালয় থেকে সুমাত্রা ফিলিপাইন ইত্যাদি দ্বীপে। যা আছে তাও ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে এখানেও, যা তাদের আসল আস্তানা সেই ভারতবর্ষেই।
শিবুর বক্তৃতার দিকে কানটা রাখলেও আড়চোখের দৃষ্টিটা আছে ঘনাদার দিকে, কখন তিনি শিবুর মাতব্বরির মাপসই জবাবটা দেন।
কিন্তু কই? তিনি তো বেশ নির্বিকারভাবে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন।
শিবুর প্যাঁচটা কি তাহলে ভেস্তে গেল? না, তার পটকার বারুদ ভিজে। ভাল করে ধরতে চাইছে না।
শিবু তখন বলে যাচ্ছে, হ্যাঁ, এই ভারতবর্ষে বারো বছর আগে মোট মাত্র এক হাজার আটশোটি বাঘ ছিল। তা-ও সেই ১৯৫৫-র গোড়ায়। বন্দুক হাতে পেলেই ট্রিগার টানার আঙুল সুড়সুড় করা এক খ্যাপা শিকারির গুলিতে ত্রিশ-ত্রিশটা তাগড়া বাঘ মারা যাবার পর মধ্যপ্রদেশের অনেকটা জায়গা ন্যাশনাল পার্ক বলে ঘোষিত হবার পরও—
তা যা সব হবার তা তো হয়েছে, শিবুকে একটু থামিয়ে হুঁশিয়ার করবার জন্যই এবার বলতে হল, কিন্তু সুন্দরবনের কথা হঠাৎ এল কেন? আর নাম করতে গলাটা অমন করুণ হল কীসে?
করুণ হল কীসে? শিবু দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে বললে, হল যে মওকাটা মিলছিল সেট ফসকে গেল বলে।
মওকাটা কী? এবার শিবুর সঙ্গে সঙ্গত চলল আমাদের—ওই সুন্দরবনে যাওয়ার? সে তত ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায়। শুধু বনবিভাগ দপ্তর থেকে একটা পাশ জোগাড় করলেই হল।
হ্যাঁ, তাই হয় বটে? শিবু ভারিক্কি চালে বলল, কিন্তু পাশ দেওয়া এখন এক্কেবারে বন্ধ বললেই হয়।
কেন, হঠাৎ এত কড়াকড়ি কেন? আমাদের কৌতূহল।
কড়াকড়ি শুধু ওই কানকাটার জন্য! শিবু প্রায় কাঁপা গলায় জানাল।
কানকাটা? কানকাটা আবার কে?
কে বা কী তা ঠিক কেউ কি জানে? কেউ যে তাকে দেখেছে তাও জোর করে বলতে পারে না, শিবু গলাটা কেমন একটু নামিয়ে বললে, শুধু নানান সব আজগুবি কথা তাকে নিয়ে কানাকানি হয়। সোঁদরবনের জঙ্গলে সে কখন কোথায় হানা দেবে তার কোনও হদিস পাবার উপায় নেই। এই নাকি সেদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে হাঁসখালির চাষিগাঁয়ের মাইল দুয়েক মাত্র দূরে। চার কাঠুরে আর মধু-জোগাড়ে মিলে গাদা-বন্দুক আর কাস্তে বল্লম নিয়ে অতি হুশিয়ার হয়ে ছোট একটা খাল পেরিয়ে ওদিকের লাট অঞ্চলে যাচ্ছিল। খালটা নেহাত ছোট, হাঁটুজলও হবে না। সেইটুকু পার হয়ে ওদিকে শুকনো ডাঙায় উঠে সবাই একেবারে থ। ছিল তারা চারজন। চারজন একসঙ্গে খালে নেমেছিল, তা আর-একজন গেল কোথায়? তা খালে চোরাবালি কি গাঢ়াগর্ত নেই যে তলিয়ে যাবে। কুমির নেই যে টেনে নিয়ে যাবে। আর তা নিলেও ঝটপটানির আওয়াজ পাওয়া যেত! সাড়া নেই, শব্দ নেই, হঠাৎ একটা মানুষ হাওয়া হয়ে গেল কী করে?
এ সেই কানকাটা ছাড়া আর কেউ নয়। মুখ দিয়ে ভয়ে না বার হোক, সকলের মনে সেই এক কথা। কানকাটা মানে সোঁদরবনের সেই দুশমন শয়তান যাকে চোখে কেউ দেখেছে কি না ঠিক নেই। কিন্তু ওই কানকাটা বর্ণনাটাই কেমন করে তার সঙ্গে জুড়ে গেছে। কানকাটা বলতে যে ভয়ংকর এক প্রাণীর মুখের ইঙ্গিত দেওয়া হয় সেটার সঙ্গে নাকি বাঘেরই কিছু মিল আছে। মিল চেহারায় একটু থাকলেও আর-কিছুতে নয়। এ শয়তান দুশমন নাকি যেখানে যখন খুশি দেখা দিতে পারে। জমিতে নাকি তার থাবার দাগ পড়ে না। ছায়াও পড়ে না কোথাও তার শরীরের।