যে কোরিকাঞ্চার কথা বললাম কুজকোর একেবারে বুকের মাঝখানে হৃদপিণ্ডের মতো আর-এক সেই মন্দিরনগর চারিদিকে আবার যথেষ্ট উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। উৎসবের দিনেও এক ইংকা ছাড়া আর সকলকে সে নগরে ঢোকবার আগে দেওয়ালের বাইরে জুতো খুলে ঢুকতে হয়।
এ মন্দির-নগরের হর্তাকর্তা হলেন ভিলিয়াক ভমু, অর্থাৎ প্রধান পুরোহিত। পেরু সাম্রাজ্যে মর্যাদার দিক দিয়ে তাঁর স্থান ইংকার পরেই। ইংকা রাজরক্ত গায়ে না থাকলে কোরিকাঞ্চার ভিলিয়াক ভমু হওয়া যায় না। কোরিকাঞ্চাতেই তাঁর অধীনে চার হাজারের ওপর তাঁবেদার।
এ রকম একটি মন্দির-নগরের ভিড়ের মধ্যে অনায়াসেই নিপাত্তা হওয়া সম্ভব। গানাদোর দলের কিশোর চেহারার এক সোনাবরদার তা-ই হয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ হলেও নিশ্চিহ্ন সে হয়নি। কয়েকদিন বাদেই তাকে ওই কোরিকাঞ্চাতেই দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে।
মন্দির-নগরের একটি অতিথিশালায় গানাদো অন্যান্য সোনা বরদারদের সঙ্গে তখন আশ্রয় পেয়েছেন। ইতিপূর্বে সোনাবরদার হিসেবে যারা এসেছে, এই অতিথিশালাতেই আশ্রয় নিয়ে তারা আতাহুয়ালপার হুকুমনামা ভিলিয়াক ভমুর কাছে দাখিল করেছে। সে হুকুমনামা অনুযায়ী রাজপুরোহিত ভারে ভারে সোনা তাদেরই মারফত পাঠিয়েছেন কামালকায়।
এবারে কামালকা থেকে সোনাবরদারদের দল মন্দির-নগরে এসে আশ্রয় নেবার পর দিন কয়েক কেটে যাওয়া সত্ত্বেও আতাহুয়ালপার হুকুম নিয়ে কেউ তাঁর কাছে না আসায় রাজপুরোহিত বেশ একটু অবাক হয়েছেন।
কোরিকাঞ্চা উজাড় করে আতাহুয়ালপার হুকুম তামিল করতে যে তাঁর ভাল লাগে তা নয়, মনে মনে আতাহুয়ালপার এ অন্যায় আদেশ তাঁর কাছে বাতুলতার লক্ষণ বলেই মনে হয়। কিন্তু বিদেশি শত্রুর হাতে বন্দি হলেও আতাহুয়ালপা-ই এ রাজ্যের সর্বেসর্বা। ঘাড়ে একটা মাত্র মাথা নিয়ে তাঁর আদেশের প্রতিবাদ করা যায় না।
সোনাবরদারদের কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা না করতে আসায় রাজপুরোহিত প্রথমে অবাক এবং পরে তাই চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। পাছে সোনাবরদারদের আলস্য কি গাফিলতি তাঁর নিজের অবাধ্যতা বলে কেউ ধরে বসে এই ভয়ে অতিথিশালায় নিজেই তিনি সোনা বরদারদের খোঁজ নিতে পাঠিয়েছেন।
সেখান থেকে খবর যা পাওয়া গেছে তা দুর্ভাবনা করবার মতো নয়। সোনাবরদার দল রেইমি-র উৎসব না দেখে কুজকো থেকে রওনা হবে না। উৎসবের এখনও কয়েকদিন দেরি আছে। তাই তারা ভিলিয়াক ভমুকে এ কয়দিন বিরক্ত করেনি। তাদের হয়ে একজন সেইদিন আতাহুয়ালপার হুকুমনামা নিয়ে তাঁর কাছে যাচ্ছে।
সোনা বরদারদের প্রতিনিধি হয়ে এসেছে একজন ঠিকই কিন্তু তাকে দেখে রাজপুরোহিত একেবারে বিমূঢ়।
কামালকা থেকে সোনা-বরদারদের দলকে যারা কুজকো আসতে দেখেছে। তাদেরও সে মূর্তি একটু বিস্মিত, সন্দিগ্ধ কি করত না? সে দলের কিশোর গোছের একটি চেহারার সঙ্গে একটা রহস্যজনক সাদৃশ্য তাদেরও লক্ষ এড়াত না বোধহয়। তবু সাক্ষাৎ নক্ষত্রলোক থেকে নেমে আসা অপ্সরার মতো সুন্দরী মেয়েটিকে সেই সোনা-বরদারদের একজন বলে ভাবা বেশ কঠিন হত তাদের পক্ষে।
গানাদো যার নাম কয়া রেখেছিলেন সূর্যসেবিকাদের নিতান্ত বেঢপ পোশাকের বদলে কুজকোর সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের বেশে তার সৌন্দর্য সত্যিই যেন অপার্থিব হয়ে উঠেছে।
রাজপুরোহিতও সে মূর্তি দেখে প্রথমটা বিস্মিত বিহ্বল হয়েছেন সত্যিই, কিন্তু তারপরে জ্বলে উঠেছেন রাগে।
তাঁর সঙ্গে এটা কী ধরনের পরিহাস! নারীর সৌন্দর্য দেখবার চোখ থাকলেও তাতে মোহিত হয়ে বুদ্ধিশুদ্ধি হারাবার বয়স তাঁর নেই।
সোনাবরদারদের প্রতিনিধি হিসেবে একটি সুন্দরী মেয়েকে তাঁর কাছে পাঠানো তাই তাঁর ক্ষমার অযোগ্য রসিকতার স্পর্ধা বলে মনে হয়েছে।
কী করতে এসেছ তুমি এখানে? বজ্রস্বরে বলেছেন ভিলিয়াক ভমু, এসেছ কোন অধিকারে!
একটি মধুর সরল হাসি ফুটে উঠেছে কয়ার মুখে।
তাঁর অমন প্রচণ্ড ধমকের উত্তরে এ হাসিতে রাজপুরোহিত একটু অস্বস্তি বোধ করেছেন। তবু কঠিন স্বরে আবার বলেছেন, উৎসবে অনুষ্ঠানে ছাড়া কোরিকাঞ্চার এ সূর্যবেদিকার কক্ষে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ তুমি জানো না?
জানি। শান্ত চোখ তুলে স্নিগ্ধস্বরে বলেছে কয়া, তবে একথাও জানি যে এ নিষেধ কারও কারও জন্যে নয়।
হ্যাঁ, নয়। স্নিগ্ধ স্বরের কথাগুলিতে স্পর্ধার আভাস প্রচ্ছন্ন বলে সন্দেহ করে রাজপুরোহিত আরও রূঢ় হয়ে উঠেছেন, কিন্তু নয় শুধু কাদের জন্যে? শুধু ইংকা রাজঅন্তঃপুরিকা সূর্যসেবিকাদের কন্যাশ্রমের প্রধান মামাকোনার, আর মুইস্কা বংশের কুমারীদের জন্যে।
আমি মুইস্কা বংশেরই কুমারী, একটু যেন বিষণ্ণ সুরেই বলেছে কয়া। তুমি মুইস্কা!—সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করেছেন রাজপুরোহিত, তোমায় বিশ্বাস করব কেমন করে?
আমায় বিশ্বাস করতে হবে না। মৃদু একটু হেসে বলেছে কয়া, যাঁর কাছ থেকে আমি এসেছি সেই মহামহিম আতাহুয়ালপার আদেশবাহী কিপু থেকেই তাঁর যা নির্দেশ তার সঙ্গে আমার পরিচয়ও জানতে পারবেন।
রাজপুরোহিত ভ্রুকুটিভরে.কয়ার হাত থেকে আতাহুয়ালপার হুকুমনামা এবার নিয়েছেন।
সেটির ওপর চোখ বোলাতে গিয়ে তাঁর ভ্রুকুটি প্রথমে আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তারপর কেমন একটা সংশয়-বিহ্বলতার ছায়া ফুটে উঠেছে তাঁর দৃষ্টিতে।
কয়ার দিকে যেভাবে তিনি চেয়েছেন তাতে মনে হয়েছে আতাহুয়ালপার এ নির্দেশের কিপুই জাল বলে বুঝি তিনি ঘোষণা করবেন।