Site icon BnBoi.Com

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

প্রেমের প্রান্তে পরাশর - প্রেমেন্দ্র মিত্র

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০১

প্রেমের প্রান্তে পরাশর

প্রেমেন্দ্র মিত্র

[প্রেমেন্দ্র মিত্রঃ জন্ম ১৯০৪; মৃত্যু ১৯৮৮। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্রকার । ১৪-টি চলচ্চিত্রের পরিচালক, চিত্রনাট্য লিখেছেন অজস্র। ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থ লিখে পান আকাদেমি পুরস্কার ও রবীন্দ্রপুরস্কার। বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনকে সাহিত্যের মর্যাদা তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন ঘনাদাকে সৃষ্টি করে। গোয়েন্দা সাহিত্যর ওঁর অবদান পরাশর বর্মা। পরাশর বর্মার বই মূলতঃ বড়দের জন্যে লেখা, তাই কিশোরদের গোয়েন্দাকাহিনী সংগ্রহে পরাশর বর্মাকে চোখে পড়ে না। ‘প্রেমের প্রান্তে পরাশর’ উপন্যাসটি এ. মুখার্জী এণ্ড কোং প্রকাশিত ‘পরাশর সমগ্র’ থেকে নেওয়া। এটি এখানে ছাপানোর অনুমতি দিয়ে তার কর্ণধার রঞ্জন সেনগুপ্ত আমাদের বাধিত করেছেন।]

এক

“চন্দ্রগোমীর ব্যাকরণের কোনো খণ্ডিত পুঁথি কি এখন পাওয়া যায়?
বৈয়াকরণ শাকটায়ন যে চান্দ্র ব্যাকরণের কাছে ঋণী, সে-ব্যাকরণ কি চন্দ্রগোমীরই রচিত ‘সংজ্ঞক ব্যাকরণ’
চদ্রগোমী কি সত্যিই নাগার্জুন শূন্যবাদের অনুগামী চন্দ্রকীর্তির শিষ্য?”

ওপরে যা লেখা হয়েছে তা পড়তে পড়তে মাথা যদি কারুর একটু গুলিয়ে যায় তাহলে তাকে দোষ দেবার কিছু নেই। গোয়েন্দা গল্প পড়তে বসে ভুল করে পুরাতত্ত্ব গবেষণার কোনো সন্দর্ভের পাতা খুলে ফেলা হয়েছে বলে যদি সন্দেহ হয়, সেটাও সহজেই মার্জনীয়। ওরকম সন্দেহ হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। আমারও হয়েছিল। আর কাগজে ছাপার অক্ষরে ঐ কথাগুলি পাঠ করে নয়, ভারতবর্ষের সর্বজনবিদিত বিখ্যাত এক আচার্য পণ্ডিতের পাঠাগারে মেঝের ওপর পাতা বিচিত্র নকসার চৈনিক মাদুরে বসে নিজের কানে পরাশর বর্মা আর আমি ছাড়া ও-কক্ষের তৃতীয় ব্যক্তির মধ্যে প্রশ্নোত্তরে ঐ জাতীয় আলোচনা শুনে।

আচার্যদেব তখনও এ ঘরে আসেননি। তাঁরই অপেক্ষায় আমরা তিনজন তাঁর পাঠাগারে বসে আছি। কিন্তু আমি ঠিক আচার্যদেবের অপেক্ষায় বসে আছি বললে সত্যের একান্ত অপলাপ হবে। আমি তাঁর জন্যে এখানে অপেক্ষা করে নেই, তাঁর দেখা পাওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নিয়ে এখানে আসিও নি।। তবু কেন যে এই সমাবেশে আমি উপস্থিত তা আশা করি ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না। হ্যাঁ, পরাশরের জন্যেই আমার এই বিড়ম্বনা। সে নাছোড়বান্দা হয়ে একরকম জোরজুলুম করে আমায় ধরে নিয়ে এসেছে। আসবার আগে অবশ্য প্রলোভন দেখিয়েছে অনেক। তার সঙ্গে গেলে নাকি এমন কিছু জানতে শুনতে পারব যা আমার সমস্ত অভিজ্ঞতার বাইরে। যেন সে আশ্বাসের গ্যারান্টি হিসেবেই আমার পকেটে একটা ছোট খাম গুঁজে দিয়ে বলেছে, – এখন থাক। সময় পেলে আজ রাত্রে পড়ে দেখো। তবে এসব ভুজুং ভাজুং-এ অনায়াসে আমি বশ হতে পারতাম, কিন্তু হাতের একটা জিনিষ দেখে আমার টনক গোড়াতেই নড়ে গেছে। সন্ত্রস্ত হয়ে তার সব সাধাসাধি আর লোভ দেখানো তাই ঠেকাতে চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য।

পরাশরের হাতে যে জিনিষটি দেখেছিলাম সেটি একটি বই। ছোটখাটো চটি পকেট বই নয়। রঙিন মন-মাতানো ছবির দেশি কি বিদেশী উপন্যাস টুপন্যাসও নয়। দাঁতভাঙানামের ভাষাতত্ত্বের একটা থান ইঁটের আকারের বই। পরাশরের হাতে কবিতার বইটা তবু কিছুটা গা সোয়া হয়ে গেছে, কিন্তু ভাষাতত্ত্বের কেতাবটা গোড়াতেই রীতিমত সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। পরাশর যেখানকার একেবারে সৃষ্টিছাড়া যে অভিজ্ঞতার লোভ দেখাচ্ছে ঐ ভাষাতত্ত্বের সঙ্গে তার কোন সংস্রব থাকলে আমার আর এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়। কিন্তু কে কার কথা শোনে। পরাশরের অনুরোধ কাটাবার সমস্ত চেষ্টা যে বিফল হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে যাঁর বাড়িতে এসে একাধারে তাঁর পাঠাগার ও বসবার ঘরে মেঝের মূল্যবান মাদুরের আসনে বসে আছি, পুরাতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের অদ্বিতীয় পণ্ডিত হিসাবে তাঁর খ্যাতি ভারতের বাইরে সারা বিশ্বে ছড়ানো। নাম না করলেও অনেকেই হয়ত বুঝতে পারবেন বলে নামটা আর করলাম না। আচার্যদেবের পাঠাগারে বসে আছি খুব কমক্ষণ নয়। পরাশরের তার পণ্ডিতি আলোচনায় মগ্ন হয়ে সময়ের খেয়াল হয়ত নেই, আমি কিন্তু ঘরে ঢোকবার পর থেকে দরজার মাথায় দেয়াল ঘড়িটার ওপর আগাগোড়াই নজর রেখেছি। তাতে এক মিনিট দু মিনিট করে পুরো সাতাশ মিনিট এ পর্যন্ত কেটেছে। শুধু ঘড়ির কাঁটার দিকে অবশ্য নয়, পরাশরের সঙ্গে যিনি এইসব দাঁতভাঙা আলোচনা চালাচ্ছেন ঘরের সেই তৃতীয় ব্যক্তিটির দিকেও মনোযোগ না দিয়ে পারি নি। মনোযোগ দেবার মতই ব্যক্তি অবশ্য। শুধু মনোযোগ দেবারই নয়, বেশ একটু বিস্মিত কৌতূহল অনুভব করবারও। ব্যক্তিটি পুরুষ নয় নারী, এবং বাঙালী বা ভারতীয় নয়, বিদেশী যুবতী।

বিদেশ বলতে কোন দেশের তা অবশ্য তাঁকে দেখে বলা সম্ভব নয়। তাঁর পোষাকটা আর একটু বেখাপ্পা হলে তাঁকে বিশ্ব নাগরিক হিপি ভাবা যেত। কিন্তু দেশী-বিদেশীর অদ্ভুত সংমিশ্রণ হলেও সে পোষাকে সযত্ন অযত্নের ছাপ নেই। একটু যেন জীর্ণ পুরোনো মনে হলেও নিম্নাঙ্গের ঢলঢলে সায়ার মত আবরণ আর উর্দ্ধাঙ্গের বেদিয়ানী কোর্তার ধরণের পোষাক দুটি নোংরা ময়না নয় বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মাঠায় চুড়ো বাঁধা সাদাটে যাকে বলে প্ল্যাটিনাম চুলে পারিপাট্য না থাকলেও একটু ছিরি ছাঁদ আছে আর প্রসাধন বিহীন মুখখানাও শ্রীহীন নয়। কোন দিক দিয়েই নিখুঁত না হলেও গড়ন পেটন সবশুদ্ধ জড়িয়ে যত ক্ষীণই হোক কেমন একটু মোহিনীভাবই মেয়েটির আছে বলে মনে হয়।
এ সব দিযে আর যাই হোক তাঁর জাতি কুলশীল ত’ জানা যায় না। পোষাক চেহারা দিয়ে যা সম্ভব নয় তার ভাষা দিয়ে তা বুঝব তারও উপায় নেই। বিদেশী মেয়েটি ইউরোপীয় কোনো ভাষায় নয়, কথা বলছে আমাদেরই বাংলা ভাষায়। এবং বলছে একেবারেই স্বচ্ছন্দে। উচ্চারণে সামান্য একটু আধটু আড়ষ্টতা আর টান অবশ্য আছে। কিন্তু তা থেকে তার মাতৃভাষা অনুমান করবার মত ক্ষমতা আমার অন্তত নেই। দেয়াল ঘড়িতে সাতাশ মিনিট আধ ঘণ্টায় গিয়ে পৌঁছেছে ইতিমধ্যে। আচার্যদেব আজ আর কখন আসবেন। তার এত দেরী করার কারণ কি।

ঘরের বাইরের করিডর দিয়ে যে দু’ একজন পরিচারককে মাঝে মাঝে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করাটা এখন অন্যায় হবে না। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে কে? আমার পক্ষে সেটা কি শোভন হবে না। আর পরাশর যেরকম তন্ময় হয়ে আলোচনা চালাচ্ছে তাতে আচার্যদেবের আসতে দেরী হওয়ার জন্যে কোনো অস্থিরতা তার আছে বলে মনে হয় না। হঠাৎ কথাটা মাথার মধ্যে একটা ঝিলিক খেলে গেল। পরাশরের হঠাৎ পুরাতত্ত্ব নিয়ে এত মত্ত হবার সহজ ব্যাখ্যাই কি আমার সামনে মূর্তিমতী হয়ে বসে আছে? কিন্তু কে ইনি? এঁর সঙ্গে পরাশরের আলাপ পরিচয় হল কোথায়? আর এতদিন বাদে হৃদয় ঘটিত ব্যাপার যদি পরাশরের একটা ঘটেই থাকে তার জন্যে সৃষ্টিছাড়া অভিজ্ঞতার লোভ দেখিয়ে আমায় সঙ্গে আনবার দরকারটা কি? আমায় কি সাক্ষী হিসেবে রাখা? কিসের সাক্ষী?

এক একজন মানুষ অবশ্য একটু বেশী মাত্রায় যাকে বলে লোক দেখানো স্বভাবের থাকে। প্রেমের জাগরণের মত নিভৃত গভীর ব্যাপারও তারা কাউকে না জনিয়ে না শুনিয়ে সুখ পায় না। কিন্তু পরাশর অমন সস্তা একজিবিশনিষ্ট ত’ কোনো কালেই নয়। বিশেষত প্রণয় ঘটিত ব্যাপার এতকাল বাদে তার জীবনে যদি ঘটেই থাকে সেটাকে সে পারতপক্ষে গোপন রাখতেই চাইবে। তাহলে কিছু না জানিয়ে শুনিয়ে আমার দেখবার সুযোগ দিয়ে আমার অনুমোদনটা নেওয়াই কি তার উদ্দেশ্য? সেটা হওয়া অসম্ভব নয়। পরাশর নেহাৎ ছেলে ছোকরা ত আর নয়। প্রথম যৌবন পার হতেই চলেছে বলা যায়। এ বয়সে এরকম একটা কিছু ঘটলে একটু সাবধানে পা বাড়ানোই ভালো। এর ওপর মেয়েটি যখন বিদেশী তখন নিজের পছন্দ অপছন্দ ছাড়া পাকা বুদ্ধির দারুর সমর্থন চাওয়াটা পরাশরের পক্ষে উচিতই হয়েছে।

নিজের দায়িত্বটা বুঝে মেয়েটিকে বেশ একটু খুঁটিয়েই এবার লক্ষ করলাম। ফিল্মে নামবার মত সুন্দরী না হলেও একটা চটক যে চেহারায় আছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চটকটা একটু নয়, আছে বেশ বেশী মাত্রাতেই। আর সেটা শুধু মুখ চোখের নয় সমস্ত শরীরের। পোষাকের বর্ণনা আগেই করেছি। সেই কিছুটা ইরাণী বেদিয়ানীদের ধরণের গায়ের ঝোলাকুর্তা আর তার তলায় সায়া আর লুঙ্গির মিশ্রণের জেল্লাহীন বিনা বাহারের বেশবাসের ভেতর দিয়েই দেহ সৌষ্ঠবের মাদকতা কেমন করে ফুটে বেরুচ্ছে তা বলা শক্ত। হয়ত মেঝের ওপর বসার অনভ্যস্ত ভঙ্গির দরুণ দেহে প্রচ্ছন্ন রেখার এখানে ওখানে একটু ইঙ্গিতই তার জন্যে যথেষ্ট।

এ রকম মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া পরাশরের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর শুধু চেহারায় চটকই নয়। মেয়েটির মুখ চোখে বুদ্ধির দীপ্তিটাও বেশ স্পষ্ট। তার কাছে যা সম্পূর্ণ বেদেশী সেই ভাষায় বেশ একটু কষ্ট করে কথা বলতে হলেও অবাধে এতক্ষণ ধরে সে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে সেইটেই ত আশ্চর্য। কথা যা বলছে ভাষাটা বাংলা বলেও তা আমার কাছে অব্শ্য পুরোপুরি গ্রীক। সব কথায় কানই দিচ্ছি না। মাঝে মাঝে দু-একটা যা কানে আটকে যাচ্ছে সেই কটিই মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। যেমন পরাশরের কি একটা প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটিকে বলতে শুনেছি, “না আমি আচার্যদেবের কাছে ‘কাশিকা বৃত্তি’ সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।”এ কথার উত্তরে পরাশর যা বলেছে তাতেও অবশ্য আমার চক্ষু স্থির।
পরাশর বলেছে, “কাশিকাবৃত্তি ত বামন আর জয়াদিত্য দুজনের এক সঙ্গে লেখা।”
মেয়েটি মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে।
পরাশর তাতে আবার বলেছে, “কিন্তু কাশিকা বৃত্তিতে না বলে অন্কে কিছু চুরি করে দুই পণ্ডিত চ্দ্রগোমী কি চান্ত্র ব্যাকরণের নাম পর্যন্ত করেন নি।…”
এতখানি শোনবার পর আমার কনের ফুটো আপনা থেকেই যেন বুজে গেছে।

মাথাটা গুলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে একবার এমন সন্দেহও জেগেছে যে ব্যাপারটা আগাগোড়া আমায় বোকা বানাবার ফিকির না ত? দুজনে মিলে আগে থাকতে ষড় করে রেখে এই সব হিংটিং ছট আউড়ে আমায় হকচকিয়ে দেওয়াই এদের মজা।এ সন্দেহটা অবশ্য মনের মধ্য উঠতে না উঠতেই সকৌতুকে উড়িয়ে দিয়েছি। পরাশর ও মেয়েটি বৌদ্ধ যুগের গুরু-গম্ভীর বিষয় নিয়েই আলোচনা করছে সন্দেহ নেই। কিন্তু পরাশর হঠাৎ এ বিষয়ে কবে থেকে উৎসাহী হয়ে উঠল? এ মেয়েটির সঙ্গে তার কি আগে থাকতেই আলাপ হয়েছিল? সে রকম কোনো লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। দুজন দাঁত ভাঙ্গা তত্ত্ব নিয়ে আলাপ চালাচ্ছে কিন্তু কেউ কাউকে একবার নাম বা পদবী ধরেও সম্বোধন করে নি। তাতে দুজনেই দুজনের অজানা বলেই ধরে নিতে হয়। কিন্তু সে রকম হলে শিষ্টাচার মত আলাপের আগে পরাশরের পরিচয়টা দেওয়া নেওয়াই উচিত ছিল। তার বদলে খানিকটা বসে থাকবার পর কোন রকম ভূমিকা না করেই দুজন কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে। কথা আগে বলেছে অবশ্য মেয়েটি। আমাদের আগে থাকতে সেই ঘরের মেঝেয় বসেছিল। মেয়েতি আগে কথা বলতে পরাশরের পক্ষে সুবিধে হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু মেয়েতি অচেনা অজানা একজনের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলল কি করে? এটা কি তার আধা হিপি হওয়ার লাইসেন্স! না আচার্যদেবের পাঠাগারের আবহাওয়ারই ওটা গুণ? এর ভেতর এসে বসলে ও সব ভুয়ো আদব-কায়দার কোনো মানে থাকে না। পরাশর আর মেয়েটির সোজাসুজি আলাপ শুরু করতে তাই বাধেনি।

মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও সে যে পরাশরের অচেনা নয় তা অবশ্য কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই বোঝ শক্ত হয় নি। পরাশর কোথাও না কোথাও মেয়েটিকে দেখেছে আর তারপর তার সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ খুঁজে আচার্যদেবের বাড়িতে আজ এসে হাজির হয়েছে। আগে থাকতে মেয়েটিকে না চিনলে আমাকেও আজ সঙ্গে করে ধরে আনার মান থাকত না। নিজের পছন্দটা পরাশর আমাকে দিয়ে একটু যাচাই করাতেই চায়।

তা করবার জন্যে তা তোড়জোড়টা দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নেহাৎ ভাসাভাসা সাময়িক কিছু নয়। পঞ্চশরের তীরটা আচমকা একটু গভীরভাবেই বিঁধেছে। একটু দেখা পাওয়া যায় আলাপ করবার সুযোগের জন্যে তাকে আমায় নিয়ে পণ্ডিত শিরোমণি এই আচার্যদেবের বাড়িতে ছুটে আসতে হয়েছে তাই। পরাশরের হঠাৎ পুরাতত্ত্ব নিয়ে মেতে ওঠার পেছনে কি আছে এখন আর বোঝা শক্ত নয়। এখানে এসে আর কিছু না হোক কাছাকাছি বসে একটু কথা বলার সৌভাগ্য পরাশরের হয়েছে। তারপরে অবশ্য অনেক ধাপ বাকি। পরস্পরের নাম ধাম জানা থেকে, দেখা শোনার সুযোগ করে নেওয়া ইত্যাদি ধাপগুলো ত আগে না পেরুলে নয়। তাতে আমার কাছে কোনো সাহায্যের আশা কি পরাশর করে? করা তার পক্ষে স্বাভাবিক কিন্তু মেয়েটির নাম পর্যন্ত না জেনে কি-ই বা করতে পারি আমি?

মেয়েটি এতক্ষণের মধ্যে বেশ কয়েকবার আমায় লক্ষ অবশ্য করেছে। আমার আগাগোড়া চুপ কে থাকে দেখে খুব একটা সম্ভ্রম মেশানো ধারণা নিশ্চয় আমার সম্বন্ধে হয় নি। তা না হোক। এতক্ষণের ধারণাটা একটু শুধরে দেবার ব্যবস্থা এবার করলাম। সেই সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় যাতে জানা যেতে পারে সে রকম একটা চেষ্টাও। ঘরের দেয়াল ঘড়িটার দিকে এ পর্যন্ত বহুবারই তাকিয়েছি। এখন তকানোটা সরব করে তুলে বেশ অধৈর্যের সঙ্গে নিজেকেই যেন বললাম, “দশটা ত বাজতে চলল। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়?

পরাশর ও মেয়েটি তাদের আলোচনা থামিয়ে তখন আমার দিকে তাকিয়েছে। পরাশরের দিকে সোজা তাকাইনি। তার চোখে হয়ত একটু ভ্রুকুটি থাকতে পারে। কিন্তু মেয়েটির মুখে ইষৎ হাসির আভাস। সেইটেকেই সহানুভূতি বলে ধরে নিয়ে সোজাসুজি বললাম,, “আমরা ত প্রায় চল্লিশ মিনিট এসেছি। আপনি ত তারো আগে এসেছেন। অপেক্ষা করে আছেন কতক্ষণ!”
আগের অধৈর্য প্রকাশটা বাংলায় করে থাকলেও এবার ইচ্ছা ক্রেই ইংরেজি ব্যবহার করেছি। কথাগুলো সোজা। প্রশ্নটার মধ্যেও জটিল কিছু নেই। কিন্তু মেয়েটি তাতেই অমন হতভম্ব হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবে ভাবতে পারিনি। আমার কথাটা হয়ত একটু ভুল বুঝেছে ভেবে বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে মাফ চাইবার ভঙ্গিতে বললাম, “আমি শুধু আপনি আমাদের চেয়েও আরো কতক্ষণ অপেক্ষা করছেন তাই জানতে চেয়েছি।”
মেয়েটির মুখ তাতেও কিন্তু যেমন বিমূঢ় বিব্রত ছিল তেমনিই রইল। সেই সঙ্গে একটু কেমন যেন অসহায় ও করুণ।
কি এমন অন্যায় অশোভন কথা বলে ফেলেছি কিছুই না বুঝতে পেরে, এবার নিজেই রীতিমত ঘাবড়ে গিয়ে সাহায্যের জন্যে পরাশরের দিকে ফিরে তার শরণ নিতে যচ্ছিলাম, হঠাৎ কথায় চমকে তার দিকে তাকালাম।
মেয়েটি বেশ একটু সঙ্কোচের সঙ্গে পরিষ্কার বাংলায় তখন বলছে, “অনুগ্রহ করে আমায মাপ করবেন। আমি ঐ ইংরেজিটা জানি না।”
ইংরেজি জানেন না! প্রথম বিস্ময়ে কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবার পরই নিজের মূর্খতার লজ্জা পেলাম। বিদেশী ইউরোপীয় মেয়ে হলেই ইংরেজি অবশ্যই জানবে বলে ধরে নেওয়াটা যে কতখানি নির্বুদ্ধিতা তা তখন ভালো ভাবেই বুঝে মর্জনা চাইতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার সুযোগ মিলল না।
মেয়েটি তখন নিজেই কুণ্ঠিতভাবে কৈফিয়ত দিয়ে চলেছে, “দেখুন অমি আর্জেণ্টিনার মেযে। স্প্যানিশের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, এমন কি ইতালিয়ানও একটু আধটু বলতে পারলেও ইংরেজিটা আর শেখা হয় নি। আপনাদের বাংলা ভাষাটা অবশ্য আমি আমার প্রাচ্য পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্যে সংস্কৃত পালির সঙ্গে সামান্য একটু শিখেছি। আপনি ইংরেজিতে কি বললেন বুঝতে না পেরে ওরকম চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। আপনি নিশ্চয়ই তাতে আমায় অসভ্য ভেবেছেন। আমার সে অনিচ্ছাকৃত অভদ্রতার জন্যে মাপ চাইছি আবার।”
অনিচ্ছাকৃত আর অভদ্রতা এই দুটি শব্দে সামান্য একটু হোঁচোট খেলেও মেয়েটি গড়গড় করে এতখানি বাংলা বলে যাওয়ায় তখন আমি অবাক আর অভিভূত।
যে পরাশর এতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নীরব শ্রোতা হয়েই ছিল সে এবার একটু গম্ভীর ভাবেই মন্তব্য করলে, “শুনুন,, মাপ চাইলে আমার বন্ধুরই চাওয়া উচিত। পৃথিবীটা যে ইংরেজদের খাস তালুক নয় এ খবরটা এখনও ও জানে না।”
মেয়েটির সঙ্গে আমিও এ কথায় হাসলাম।
কিন্তু সেই সঙ্গে পরাশরের ওপর একটু রাগও হল। এমন একটা সুযোগ পেয়েও নষ্ট করতে হয়। আমাকে খোঁচা দেবার ছুতোয় আমার নামটা বলে দিলে ক্ষতি কি ছিল? শেষ কথাটায় আমার বন্ধু জানেনা-র মধ্যে কৃত্তিবাস নামটা অনায়াসে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত, আর তাহলে কথার পিঠে কথা এসে মেয়েটির নাম ধাম জানার একটা সুবিধে কি হত না?
এত কাণ্ডের পর নামটাই যে অজানা হয়ে রইল।

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০২

দুই

শেষ পর্যন্ত তা কিন্তু রইল না।
সেই দিনই সকালে এক সঙ্গে অতগুলো সুযোগ হয়ে যাবে তা ভাবতে পারিনি। আচার্যদেবের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য অবশ্য হয় নি। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পর আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করবার পর জানা গেল, আচার্যদেব একটা জরুরী মিটিং-এ কোথায় আটকে পড়েছিলেন। বাড়ি ফিরতে তাঁর দেরী হবে। বাড়িতে ফোন করে তাই দর্শনপ্রার্থী কাউকে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে বারণ করার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির একজন ওপরের সে ফোনের সংবাদ আমাদের জানিয়ে গেলেন।

খবরটা শুনে পরাশর আর মেয়েটি রীতিমত হতাশ। এক সঙ্গেই বাইরে যেতে যেতে মেয়েটি তার সমস্যার কথা জানালে। আচার্যদেবের কাছে কয়েকটা জরুরী বিষয় জেনে না নিলে যে জন্যে সে ভারতবর্ষে এসেছে সে কাজই সে শেষ করতে পারবে না। অথচ আজ নিয়ে দুদিন নাকি তার বসবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আচার্যদেব শেষ পর্যন্ত এমনি ভাবেই অন্য কিছুতে আটকে পড়ে কথা রাখতে পারেন নি।

কথা বলতে বলতে আচার্যদেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা তখন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। এরপর বিদায় নমস্কার জানিয়ে যে যার পথে যাবার পালা। পরাশরের এখনো পর্যন্ত এই মুহূর্তটাকে কাজে লাগাবার কোনো লক্ষণ নেই দেখে নিজেকেই গায়ে পড়া হয়ে কথাটা তুলতে হল।
“আপনি যাবেন কোন দিকে?” মেয়েটিকে বাংলাতেই জিজ্ঞাসা করলাম।
“আমি!” মেয়েটি যেন এ প্রশ্নে একটু বিচলিত, “আমি – আমি উত্তর দিকেই যাব।”
সেই সঙ্গে আর একটা যা প্রশ্ন করলে তা আমি তার মুখ থেকে আসতে পারে বলে ভাবিনি।
মেয়েটির জিজ্ঞাসা হল, “আচ্ছা এখান থেকে আপনাদের ঐ কি বলে মিনি বাস পাওয়া যায় না?”
“পাওয়া যাবে না কেন!” মেয়েটির মিনিবাসে যেতে চাওয়ায় অবাক হলেও বিস্ময়টা গোপন করে বললাম, “কিন্তু এখন অফিসের সময়। উত্তরমুখো কোনো বাস ট্রামই ত খালি পাওয়া যাবে না। তা আপনি যাবেন কতদূর?”
“তা যাব একটু দূর।” মেয়েটি কুণ্ঠিত ভাবে জানালে, “সেই দমদমের কাছে।”

দমদমের কাছে শুনে সত্যিই একটু দমে গিয়ে যখন এই ভিড়ের সময়ে সেখানে পৌঁছোবার একটু সুলভ ও সুবিধাজনক বাস রুটের কথা ভাবছি, পরাশর ততক্ষণে বেপরোয়া হয়ে একটা চলতি ট্যাকসি ডেকে থামিয়ে ফেলেছে।
কাজটা বীরোচিতই হয়েছে সন্দেহ নেই, সিভ্যালরির পরিচয় দিতে এটুকু না করে উপায় ছিল না। কিন্তু আমি থখন নিজের পকেটের অবস্থা জেনে দমদম পর্যন্ত ট্যাকসির মিটারের নির্দেশ অনুমান করে শঙ্কিত না হয়ে পারি নি।
যে মেয়ে দমদমে যাবার জন্যে মিনি বাসের খোঁজ করে তাকে ট্যাকসি ডেকে দেওয়াটা সত্যিই উপকার করা কি না তাও ভাববার বিষয়।
ট্যাকসি দাঁড়াতে দেখে সেই জন্যেই মেয়েটিকে কেমন একটু ইতস্ততঃ করতে বোধ হয় দেখলাম।
পরাশর অবশ্য ততক্ষণে ট্যাকসির দরজা খুলে ধরে ডাকছে, “আসুন।”
মেয়েটি একটু দ্বিধাভরে যতক্ষণে ট্যাকসিতে গিয়ে উঠল ততক্ষণ আমি পরাশর এরপর কি করবে ভেবে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে রইলাম। পরাশর কি মেয়েটিকে ট্যাকসিতে উঠিয়ে ছেড়ে দেবে?
না, তা পরাশর দিলে না। মেয়েটি ভেতরে গিয়ে ওঠবার পর আমার গড়িমসিতে যে অধৈর্য দেখিয়ে বললে, “কই, এসো কৃত্তিবাস?”
“আমি!” অকপট বিস্ময়ের সঙ্গে একটু ভীত ভাবেই পরাশরের দিকে চাইলাম, “আমায় ডাকছ কেন? আমার এখন অতদূর দমদমে যাওয়ার একটু অসুবিধে আছে।”
“অসুবিধে আবার কি?” পরাশর এবার হাত ধরেই আমায় ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে পাশে এসে বসে ড্রাইভারকে দমদম যাবার নির্দেশ দিলে।
পরাশর এমনভাবে আমাকে নিয়ে ট্যাকসিতে ওঠায়, ভাড়ার ভাবনাটা থেকে তখন মুক্তি পেয়েছি। মেয়েটির ফেরবার সমস্যা মেটাবার সঙ্গে তার ঠিকানাটাও জেনে আসার এ সুযোগ ছেড়ে দেওয়াই তার পক্ষে আহাম্মকি হত।
কিন্তু যার জন্যে এত করা সে মেয়েটির প্রতিক্রিয়াটা কি সেইটেই ত বোঝা যাচ্ছে না।

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৩

তিন

গড়িয়াহাট রোড ধরে গাড়িটা তখন উত্তরের দিকে চলেছে। সেই দক্ষিণ কলকাতায় ট্যাকসিতে ওঠবার পর থেকে মেয়েটি কেমন একটু অন্যমন্স্ক হয়ে সমানে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে। বপুটি আমার নেহাত শীর্ণ নয়। পেছনের সীটে তিনজন পাশাপাশি বসার জন্যে একটু ঘেঁষাঘেঁষিই হয়েছে। মেয়েটির সুগঠিত দেহের কিছু কিছু অংশের স্পর্শ এড়াবার তাতে উপায় নেই। দেহের সে স্পর্শ দিয়ে মনের কথা ত আর বোঝা যায় না। গেলে হয়ত তাতে খুশি হবার মত কিছু পেতাম না। পরাশর তার পরিবহন সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ সমাধান তার ঠিক মনঃপুত না হওয়ারই কথা। মেয়েটি থাকে সেই দমদমে সেখানে যাবার জন্যে নিজে থেকে সে মিনিবাসের খোঁজ করেছে। তার মানে তার আর্থিক সঙ্গতি তেমন যথেষ্ট নয় বলেই ত মনে হয়। পরাশর নিজে থেকে ট্যাকসি ডেকে তাকে পৌঁছে দেবার জন্যে সঙ্গী হওয়ায় মেয়েটির সে দিক দিয়ে এখন অবশ্য বিব্রত হতে হবে না, কিন্তু কোথায় সে থাকে তা জানাবার উৎসাহ তার নেই এমনও হতে পারে।

দমদমে কোথায় থাকবার আস্তানা সে পেয়েছে ত অবশ্য জানি না, তবে তার পোষাক-আশাক দেখে জায়গাটা ডেকে দেখাবার মত নয় বলেই ত মেন হয়।

ঠিক হিপিদের পর্যায়ে মেয়েটি পড়ে না বটে, কিন্তু হিপিরা যেখানে সেখানে যদি থাকতে পারে, মেয়েটির পক্ষে নিতান্ত সাধারণ কোনো আশ্রয়ে থাকা ত থাহলে অসম্ভব নয়। আপত্তি না করলেও তার সেই ঠিকানাটুকু বাধ্য হয়ে জানাতে হচ্ছে বলেই হয়ত মেয়েটির হঠাৎ এই মনমরা আনমনা ভাব। তাতে লোকসান অবশ্য আমাদেরই। আমাদেরই মানে আসলে পরাশরেরই। এতক্ষণ একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়ে পরিচয়টা গভীর করা পরাশরের আর হয়ে উঠল না। মেয়েটির থাকবার জায়গাটা সে দেখে আসবে বটে, কিন্তু গোড়াতেই এমনভাবে সুর কেটে যাবার পর আবার নতুন করে জমানো আর কিছু না হোক সহজ নিশ্চয় হবে ন। এ ব্যাপারে বন্ধু হিসেবে আমিই বা কি করতে পারি ভেবে পেলাম না। গায়ে পড়ে আলাপ যে না করা যায় তা নয়। তাতে আমাকে বেশ খেলো হতে হলেও বন্ধুর খাতিরে তা আমি হতে প্রস্তুত। কিন্তু আলাপটা শুরু করব কি নিয়ে? পরাশরের মত পুরাতত্ত্ব কি ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে ছিটেফোঁটা জানাশোনা থাকলেও তাই নিয়ে আলাপটা শুরু করতে পারতাম। কিন্তু এসব বিষয়ে আমার যা বিদ্যে তাতে দন্তস্ফুট করলে শুধু হাসির খোরাকই যোগাবে। আলাপ শুরু করার ও পথ সুতরাং বন্ধ। মেয়েটি বলেছে সে আর্জেণ্টিনার মেয়ে। ঐ আর্জেণ্টিনা দিয়েই কথাটা শুরু করব নাকি? আর্জেণ্টিনা সম্বন্ধেও বেশী কিছু যে জানি তা নয়, তবে তার রাজধানীর নামটা আর দু-একটা খবর জানা আছে। তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ব বলে একটু নড়েচড়ে বসতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম। প্রথমে নিজের কানটাকে বিশ্বাস করতেই একটু বাধল। তারপর বিস্ময়ের আর শেষ রইল না। যা শুনছি তা মিথ্যে নয়। মেয়েটিই নিজে থেকে কথা বলছে আর ক্ষোভ কি বিরক্তি নয় বেশ একটু কৌতুক মেশানো গলায়।
“কৃত্তিবাসবাবুর বড় বেশী শাস্তি হচ্ছে বুঝতে পারছি।”
মেয়েটি শুধু নিজে থেকে কথাই বলে নি, আমার নামটাও ঠিক মত উচ্চারন করে টিপ্পনী করেছে।
নামটা সেই একবার পরাশর বলেছিল ট্যাকসিতে ওঠবার সময়। তাতেই এতক্ষণ মনে রাখাই ত যথেষ্ট। তার ওপর ঐ কৌতুকের সুরটুকু।

এরপর আর আমায় পায় কে? অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে নামটাম সবই বার করে ফেললাম। মেয়েটির নাম এলসা। আর্জের্ণ্টিনায় বাড়ি। সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে ভারতবর্ষের গুপ্তযুগের কয়েকজন বৌদ্ধ আচার্য পণ্ডিতদের সব্মন্ধে গবেষণা করে থিসিস লিখতে এখানে এসেছে। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের কয়েকটি জায়গায় ঘুরে সেখানকার কাজ শেষ করেছে। এখন বাংলাদেশের কাজই তার বাকি। এখানকার কাজ শেষ করতে নানা কারণে দেরী হচ্ছে। তবু আশা করছে, সপ্তাহ দু-একের মধ্যেই কাজ শেষ কের ফিরে যেতে পারবে। এলসার পরিচয় যেতুকু পেলাম তা এমন কিছু নতুন কি আশ্চর্য নয়। আজকালকার দিন বিদেশ থেকে যে সব ছেলে মেয়ে ভারতবর্ষে পড়তে শুনতে কি বেড়িয়ে যেতে আসে তাদের অনেকের কাহিনীই এই ধরণের।

কিন্তু এরপর যা জানলাম তা সত্যই চমকে একেবারে বিমূঢ় করবার মত। ট্যাকসি এরোড্রোমের রাস্তায় অনেক দূর তখন চলে এসেছে। ড্রাইভার টার্মিন্যালের দিকেই গাড়ি চালাতে যাচ্ছিল, হঠাৎ এলসা বারণ করে বললে, “না, ওদিকে নয়।” ওদিকে নয় তা আগেই জানতাম, কিন্তু সত্যিই যাবে কোথায়? এরোড্রোমের এলাকা ছাড়লে অবশ্য কিছু বাগানবাড়ি গোছের কলকাতার সম্পন্ন মানুষের বিশ্রামকুঞ্জ গোছের আছে। তারই একটিতে আশ্রয় যোগাড় করেছে নাকি এলসা? না, সে রকম কোথাও নয়। নিজেই নির্দেশ দিয়ে এলসা যেখানে ট্যাকসি নিয়ে গিয়ে থামলে তার সামনের দোকানটা দেখে আমার অন্ততঃ চক্ষুস্থির।

 প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৪

চার

এতো যাকে বলে পাঁচতারা মার্কা। আমীর ওমরাহদের থাকবার হোটেল। এলসা এখানে থাকে? নেহাৎ সাধারণ কমদানী কাপড়ের আধা-হিপি যার বেশবাস খানিক আগে এখানে আসবার জন্যে যে মিনিবাসের খোঁজ করছিল সেই পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে আসা মেয়ের আস্তানা হল এই হোটেল।
পরাশর ট্যাকসির মিটার দেখে ভাড়া চুকিয়ে দিলে। দেবার সময় ভেবেছিলাম মেয়েটি আপত্তি করবে। তা সে করলে না। কিন্তু আমাদের নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিতে দিলে না। তাদের কফিবারে কয়েক মিনিটের জন্যে একবার অন্তত পা দিয়ে একটু কফি যেতে নিমন্ত্রণ জানালে।
নিজের পোষাক-আশাকের কথা ভেবে এই বাদশাহী হোটেলে সে নিমন্ত্রণ রাখবার খুব ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু পরাশরের দেখলাম একেবারে ভাত খাবি না আঁচাব কোথা গোছের অবস্থা।
বলতে না বলতে রাজী হযে সে প্রায় আমাদের সকলের আগে যেভাবে হোটেলে গিযে ঢুকল সেটা তখন আমাদের একটু খারাপই লেগেছিল।
কিন্তু পরে মনে হয়েছে যে তখন অমন করে না গেলে সেনর বারোহার সঙ্গে আলাপই হত না। আর সেটা এক দিক দিয়ে লোকসানই হত। কারণ সেনর বারোহা এমন একজন মানুষ আজকের দুনিয়ায় যাদের একতা নতুন যুগের প্রতিনিধি বলা যায়। এ কাহিনী লিখতে লিখতে তাঁর পরিচয়টা ধীরে ধীরে সবই প্রকাশ পাবে। আপাততঃ এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে প্রথম দেখাতেই দেশ বা বিদেশের কোন মানুষ আমার মনে এমন কৌতুহল জাগায়নি।

সেনর বরোহার সঙ্গে হোটেলে ঢোকবার দেউড়িতেই প্রায় দেখা। তিনি হোটেল থেকে বেড়িয়ে কোথায় যচ্ছিলেন। আমাদের ঠিক নয়, এলসা কে দেখেই এক মুখ হেসে বিদেশী যে ভাষায় তাকে সম্ভাষণ করলেন সেটা স্প্যানিশ বলেই মনে হল। এলসা হেসে দাঁড়িযে তখনই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলে। পরিচয় কি যে দিলে তা অবশ্য বুঝলাম না। হয়ত, পরাশরের পরিচয় দিলে বাঙ্গালী একজন বড় পণ্ডিত গবেষক বলে আর আমাকে পরাশরের বন্ধু ও কলকাতায় একজন গণ্যমান্য কেউ হবার গৌরব দিলে। পরিচয় যাই দিক,, বারোহার দিক দিয়ে হৃদ্যতার তাতে অভাব হল না। বাইরে যাওয়া তার মাথায় উঠল, আমাদের সঙ্গে করমর্দন করে কফিবারেই সঙ্গী হল আমাদের। বারোহা অবশ্য ইংরেজী ভালো রকমই জানে। সত্যি কথা বলতে গেলে, নামটা না বলে প্রথেমেই আলাপ কারলে তার ইংরেজি শুনে সে যে ইংরেজ বা মার্কিনী নয়, তা বুঝতেই পারতাম না।

মানুষটা অবশ্য অনেক দিক দিযেই লক্ষ্য করবার মত। এলসা হোটেলের দরজায় তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই আমাদের ঢোকবার মুখে আর সকলের মধ্যে তার চেহারাটা চোখে পড়েছিল। না পড়াটাই আশ্চর্য। ইস্পাত তীক্ষ্ণ। চাবুকের মত চেহারা যাকে বলে বারোহার ঠিক তাই। নামটা জানবার পর সে চেহারায় একট হদিসও পেয়েছি। বরোহা স্পেনের মানুষ। সে দেশের বুনো ক্ষেপিয়ে দেওয়া ষাঁড়ের সঙ্গে প্রাণ তুচ্ছ করে শুধু একটা লাল কাপড় আর নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে পা চালানোর কৌশল আর ক্ষিপ্রতায় যারা লড়ে বারোহা-র শিরায় সেই টোরিয়াডরদের রক্তই নিশ্চয় বইছে। তাই সাদাসিধে প্যাণ্ট সার্ট ও তার চলা ফেরায় যেন চিতার মত সুঠাম প্রাণীর সংহত বলিষ্ঠতা ফুটে বার হচ্ছে। পোষাক আশাক বা চেহারায় তেমন জৌলুস না থাক, ইংরাজি না জেনেই এলসা এখানে বেশ জনপ্রিয় দেখলাম।

কফিবারে কফি খাবার সময় অনেকেই তাকে প্রীতি সম্ভাষণ জানিয়ে গেল। মঁসিযে রেনোয়া নামে একজন ফরাসী প্রৌঢ় তার ভাগনীকে নিয়ে খানিকক্ষণ ত আমাদের টেবিলে বসে এক পাত্র করে কফিই খেয়ে গেলেন। এঁদের সকলের সঙ্গেই এলসা তাঁদের ভাষাতেই আলাপ চালালে। বারোহার সঙ্গে যেমন স্প্যানিশ, রেনোয়া আর তার ভাগনীর সঙ্গে তেমন ফরাসীতে। শুধু ইংরাজিটা সে কেন যে শেখেনি সেইটা আশ্চর্য। কফি খাওয়া পর্ব শেষ করে হোটেল থেকে কলকাতা ফেরবার সময় বারোহাও সেই কথা বলে দুঃখ করলে।

হোটেল থেকে আমরা তার গাড়িতেই কলকাতায় ফিরছিলাম। কফি খাওয়ার পর এলসার কাছে বিদায় নেবার সময় সে নিজে থেকেই আমাদের কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার কথা বলেছে। এটা তার অতিরিক্ত কিছু সৌজন্য নয়। এলসা আর আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার আগে সে কলকাতায় যাবার জন্যেই বেরিয়ে আসছিল। এলসাকে দেখে ও আমাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় যাওয়াটা কিছুক্ষণ স্থগিত থেকেছে মাত্র। বারোহার গাড়িটা রীতিমত খানদানি ও বিরাট। কোন আপত্তি না শুনে সে তার সংগে সামনের সীটেই আমাদের বসিযে নিয়েছে। গাড়িটা যা ঢাউস তাতে জায়গায় অকুলান কিছু হয় নি।

হোটেল থেকে কলকাতার দিকে আসতে আসতে বারোহার মোটামুটি পরিচয় পেয়েছি। বারোহা নিজেই তা দিয়েছে। সে মূল স্পেনের লোক তবে স্পেনে নয় দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে থেকেই তার ব্যবসা চালায়। ব্যবসা তার জৈব সার গুয়ানো নিয়ে। পেরু ও চিলির পশ্চিম প্রান্তের কয়েকটা দ্বীপে হাজার হাজার বছর ধরে সামুদ্রিক পাখীদের দৌলতে সে জৈব সার রশি রশি জমা হয়ে আছে। এক কালে সে সারের চাহিদা আর কদর যা ছিল, ফার্টিলাইজারে কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার তৈরীর পদ্ধতি উদ্ভাবনের পর থেকে তা অনেকটা কমলেও গুয়ানোর ব্যবসায় এখনও লোকসান নেই। বারোহার কাছে অবশ্য তার ববসাই ধ্যান জ্ঞান নয়। বছরে ন’মাস সে মনপ্রাণ দিয়ে ব্যবসা করে। তারপর তিনমাস ছুটি নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। এই ঘুরে বেড়ানোই তার নেশা।

বারোহা মানুষটা সত্যিই বুঝলাম নিতান্ত সরল। নইলে মাত্র খানিকক্ষণের আলাপে আমাদের কাছে এত কথা বলে ফেলবে কেন? তার কথায় খেই ধরেই একবার জিজ্ঞাসা করলাম, সে আগে কখনো ভারতবর্ষে এসেছে কি না।
“না, আসি নি,” হেসে বললে বারোহা। “না এসে খুব ভুল করেছি।”
“তার মানে ভারতবর্ষ আপনার ভালো লাগছে?”
“ভালো লাগছে মানে!” বারোহা যেন অবাক হল, “এদেশ ভালো না লেগে পারে! আমার ত মনে হয় আমি আগের জন্মে এদেশেই কোথাও জন্মেছিলাম।”
“আগের জন্মে এদেশে জন্মেছিলেন, “আমি হেসে উঠলাম, তার মানে জন্মান্তরে আপনি বিশ্বাস করেন?”
“আগে করতাম না। এদেশে আসবার পর করি।” একটু থেমে বারোহা সামনের দুটো গাড়িকে নিপুণভাবে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে আবার বললে, “আপনার দেশ যত দেখছি তত যেন একটা অজানা আকর্ষণ আমায় টানছে মনে হচ্ছে।”
কিন্তু এবার আমি একটু উল্টো না গেয়ে পারলাম না, “এরকম হোটেল থেকে এরকম মোটরে চড়ে যা দেখেছেন তা ঠিক আসল ভারতবর্ষ নয়।”
“হ্যাঁ,” বারোহা গম্ভীর হয়ে বললে। “এলসাও তাই বলে, আসল ভারতবর্ষকে জানতে হলে ক্যাডিল্যাক চড়ে বড় বড় সদর রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে কিছু জানা যায় না। কিন্তু আমার উপায় কি বলুন। আমার ছুটির মাত্র এক মাস আর বাকি। এক মাসের মধ্যে এবারের মত ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে যতটা পারি আমার দেখে যেতে হবে। এ গাড়িটা তাই আমি আসার আগে থাকতে জাহাজে এখানে আনিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। এলসা এ গাড়ি নিয়ে ঠাট্টা করে। কিন্তু তার ঠাট্টা শুনলে আমার আর ভারতবর্ষ বেড়ানোই হয় না। আমি ত তার মত এই দেশ নিয়ে পড়াশোনা আর গবেষণা করতে আসি নি। শিকড় গজিয়ে কোথাও বসে থেকে আমি করব কি?”
একটু হেসে বললাম, “কিন্তু মিস এলসাও ত এখানে থাকছেন না। কদিন বাদেই ওঁকে আর্জেণ্টিনায় ফিরে যেতে হবে বললেন।”
“তাই বলেছে নাকি আপনাদের!” বারোহা একটু অবাক হয়ে বললে, “আমিও জানতাম এখান থেকে ওর এখন যাবার ইচ্ছে নেই।” একটু থেমে একটু যেন দুঃখের সঙ্গে বললে, “আর্জেণ্টিনায় কোনো ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপের টাকায় এখানে গবেষণা করতে এসেছে। সেই স্কলারশিপের মেয়াদ হয়তো শেষ হয়ে গেছে। তাই নিরুপায় হয়ে যেতে হচ্ছে।” অথচ বারোহার গলায় এবার হাল্কা কৌতুকের সুরের তলায় একটু যেন ক্ষোভের আবাস পেয়েছি, “আমি কত করে আমার সঙ্গী হয়ে দেশটা আমায় যথাসম্ভব চেনাতে বলি। বলি যে তাহলে আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক হই। এলসা ইংরেজী জানে না আর আমি জানিনা এদেশের কোন ভাষা। দুজনে এক সঙ্গে থাকলে এদেশের ওপর-মহল নিচের-মহল কোথাও আমাদের ঠেকাতে হবে না। তা আমার কথা হেসেই উঠিয়ে দেয়।”

বারোহা-র সরল উচ্ছ্বাসের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল করে ভেতরে ভেতরে একটু চঞ্চল না হয়ে পারলাম না।
আচার্যদেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাকসি নেবার পর থেকে পরাশর এ পর্যন্ত পয়সার কোনো কথা একরকম বলে নি বললেই হয়। সে মাঝে মাঝে তার কবিতার ভাবনায় কি কোনো সমস্যার জট খোলার জন্যে আনমনা হয়ে থাকে বটে কিন্তু এতক্ষণ ধরে এরকম নীরবতা ত তার পক্ষে স্বাভাবিক নয় মোটেই। এলসা সম্বন্ধে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে বেশী রকম দুর্বল হয়ে পড়ার জন্যেই কি তার এমন ভাবান্তর? কন্দর্প আর কার্তিকে মেশানো চেহারার এই বারোহাকে এলসার এত ঘনিষ্ট বন্ধু বলে জেনে মনের ভেতরে একটা ঘা খেয়ে সে এমন গুম হয়ে গেছে। আর কিছু না হোক তার উদাসীন ভাবটা একটু ভাঙবার চেষ্টায় বারোহা-র কথার জের টেনে বললাম, “মিস এলসার ইংরেজী না জানায় একটু অসুবিধে হয় নিশ্চয়ই।”
“না। অসুবিধা আর কি?” বারোহা এলসার হয়ে বললে, “আপনাদের এখানে ইংরাজির এখনো খুব চল, কিন্তু সারা দুনিয়ায় আমাদের স্প্যানিশ-এর প্রসার বড় কম নয়। গোটা দক্ষিণ আমেরিকাই স্প্যানিশের রাজত্ব বল্তে পারেন। আর স্প্যানিশের সঙ্গে ফরাসী জানলে ত সভ্য সমাজের কোথাও ঠেকবার কথা নয়।”
নিজের ভাষার গৌরব নিয়ে বারোহা-র অহঙ্কারে একটু আমোদই পেয়ে এবার জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, মিস এলসা আপনার কাছে আমাদের কি পরিচয় দিয়েছেন, বলুন ত।”
“কেন?” বারোহা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “ভুল কিছু দিয়েছে?”
“কি দিয়েছে না জানলে ভুল কিনা বুঝব কি করে?” হেসে বললাম, “স্প্যানিশে নিস এলসা কি বলেছেন তা’ত বুঝতে পারি নি।”
“হ্যাঁ, তা ত বটে।” বলে বারোহা একতু গম্ভীর হবাই ষর ভাব করে বললে, “আপনাদের পরিচয় যা দিয়েছে তা কিন্তু মোটেই সুবিধার নয়।”
“তাই নাকি?” আমিও গম্ভীর হলাম, “কি বলেছে, কি?”
“এলসা বলেছে,” বারোহা আর হাসি চাপতে পারলে না, “আপনারা দুজনে পুলিশের লোক, এলসার পেছনে লেগেছেন কিছু একটা ব্যাপারের সন্ধানে।”
কথাটা বলে বারোহা তখন হাসছে। এতক্ষণে পরাশরকে একবার যেন সজাগ হয়ে মুখ ফেরাতে দেখে আমি একটু ভরসা পেলাম। বারোহার হাসিতে যেন ক্ষুণ্ণ হবার ভান করে বললাম, “আশ্চর্য! একথা মিস এলসা জানলেন কি করে?”
“না, না।” হাসতে হাসতে বারোহা আমায় আশ্বস্ত করে বললে, “এলসা তা বলেনি। ও বলেছে আপনারা দুজন কোনোখানে বোধহয় অধ্যাপনা করেন। আপনি বোধহয় ইতিহাস ভূগোল গোছের কিছুর আর আপনার বন্ধু পুরাতত্ত্বের। ঠিক ও নাকি জানে না। আজই নাকি আপনাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছে।”
একটু থেমে বারোহা আবার জিজ্ঞাসা করলে, “ভুল কিছু বলেছে এলসা?”
“না, না ভুল কিছু বলে নি।” আমি হেসে জানালাম।
“আপনারা নিজে থেকে ওকে ট্যাকসি ডেকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছেন বলে ও যে কৃতজ্ঞ সে কথাও এলসা তখন জানিয়েছে। সুতরাং আমি একটু ঠাট্টা করলাম বলে ওকে ভুল বুঝবেন না।”
“না, ভুল বুঝব কেন?” ব্যস্ত হয়ে বারোহাকে আশ্বস্ত করলাম।

গাড়িটা তখন বেলেঘাটা হয়ে পার্ক-সার্কাসে এসে পৌঁছেছে। পরাশর এতক্ষণে তার নীরবতা ভঙ্গ করে গাড়িটা থামাতে অনুরোধ করলে। বারোহা গাড়ি থামাতে অনুরোধ করলে। বারোহা গাড়ি থামাবার পর বিদায় নিয়ে নেমে যেতে যেতে খুশি মনেই বললাম, “আপনার নামটা শুনে প্রথমেই আমার কার কথা মনে হয়েছিল জানেন?”
“কার কথা?” একটু অবাক হয় জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
“মনে হয়েছিল আপনাদের বিখ্যাত সেই লেখক পিও বারোহা-র কথা। আপনার সঙ্গে কোন সম্বন্ধ তম্বন্ধ আছে নাকি। পদবীতা এক কি না, তাই ভাবছিলাম।”
“পদবী এক।” একটু থেমে থাকার পর সজোরে হেসে উঠে বারোহা যেন আমাকেই লজ্জা দিলে। “পদবী এক হলেই সম্বন্ধ থাকবে কেন। না, না ও নামের কোনো লেখকের সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই।”

বারোহা গাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর পরাশরের দিকে ফিরলাম। সে তখনো যেন কেমন অন্যমনস্কভাবে দ্মাড়িয়ে আছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা,, হঠাৎ এখানে গাড়ি থামাতে বললে কেন? বারোহা ত শহরের মাঝখানেই যচ্ছে। সেখানে কোথাও ত নেমে যেতে পারতাম।”
“তা পারতাম। তবে এখানে একটু কাজ আছে।”
“এখানে কি কাজ?” একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
উত্তর যা শুনলাম তাতে নিজের শ্রবণ শক্তিতেই প্রথম সন্দেহ জাগল। “এখানে এক জায়গায় একটু হাত দেখাব।” বললে পরাশর।

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৫

পাঁচ

পরাশর হাত দেখাবার জন্যে এখানে নেমেছে। কথাটা প্রথমে বিশ্বাস করতেই পারি নি। হাত দেখাবে পরাশর! সব আজগুবি দুর্বলতা ত কোনদিন তার ছিল না। সে কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে! কিন্তু সত্যিই সে যখন মিনিট দশেক হাঁটিয়ে একটা গলি গোছের রাস্তার একটি দোতলা বাড়ির সামনে নিযে গিযে দাঁড়াল, তখন তার নতুন দুর্বলতা সম্বন্ধে আর সন্দেহ রইল না।

বাড়িটার পরিচয় ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত তার সর্বাঙ্গে লাগানো নানা বিচিত্র সাইনবোর্ডেই ঘোষিত। দুধারের দেয়ালে ষটচক্র সুষুম্মা কাণ্ড ইত্যাদি কি সমস্ত দেহরহস্যের ছবি আঁকা বোর্ড ঝোলানো। দরজার মাথায় প্রকাণ্ড সোনালী হরফে লেখা বোর্ড। তাতে উঁচু-করা জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা – নিখিল বরেণ্য যোগসিদ্ধ জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজ। বাংলার চেয়ে আরো বড় ও উঁচু হরফ ইংরাজি। তাতে অবশ্য আর একটু সংক্ষেপে প্রথম লাইনে লেখা ‘শঙ্কর মহারাজ, অ্যাষ্ট্রলজার সুপ্রিম অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড, আর তার নিচের লাইনে লেখা ‘রীডস ইওর লাইফ-লাইক এ বুক’।

শঙ্কর মহারাজের পসার কি রকম ও কাদের মধ্যে তা ঐ গলির ভেতরই দাঁড় করানো দুটি দামী মোটরেই বোঝা যায়। মক্কেলদের একজন আমরা ওপরে যাবার মুখেই নেমে এসে গাড়িতে উঠলেন। দুজনেই বর্ষয়সী বিদেশী মেম-সাহেব। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুনে এটুকু বোঝা গেল যে তাঁরা জ্যোতিষ চক্রবর্তীর কাছে নতুন আসছেন না। নাতি প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যাবার পর আরেক যে মক্কেলকে অত্যন্ত কৃতার্থভাবে বিদায় নিতে দেখলাম তিনিও শ্বেতাঙ্গ। তাতে এইটুকু অন্ততঃ বোঝাগেল যে শঙ্কর মহারাজের খ্যাতিটা দেশের চেয়ে বিদেশেই বেশী না হোক কম নয়।

জ্যোতিষ চক্রবর্তীর প্রণামী বেশ একটু বেশী বলে ওপরে সাধারণ প্রার্থীর ভিড় একেবারেই নেই। আমাদের আগের শ্বেতাঙ্গ মক্কেল চলে যাবার পর আমরাই শুধু সেখানে রইলাম। শঙ্কর মহারাজের কাছে পরাশর একেবারে অচেনা নয় দেখলাম। কাছে গিয়ে বসতেই একতু যেন সকৌতুক ভৎর্সনার সুরে মহারাজ বললেন, “আবার কি হল।”
“আজ্ঞে হাতটা এবার একটু দেখুন।” বলে পরাশর তার ডান হাতটা বাড়িযে দিল।
“হাত দেখতে হবে না।” জ্যোতিষ চক্রবর্তী হাত ঠেলে দিয়ে বললেন, “আমি তোমার মুখেই সব দেখতে পাচ্ছি। অপেক্ষা কর এক মিনিট।”

জ্যোতিষ চক্রবর্তী যতক্ষণ পরাশরের মুখ দেখলেন তাঁর মধ্যে আমিও তাঁকে তখন দেখে নিলাম। ভক্তি না হোক সম্ভ্রম জাগাবার মত চেহারা বটে। দামী গালচের ওপর পাতা জাজিমের আসনে দুধারে মখমলের তাকিয়া নিয়ে যেন ছোটখাটো পাহাড়ের মতো বসে আছেন। লোমশ বুকের ভাঁজ ভুঁড়ির ভাঁজ সবই দেখবার মত। এই দেহের অনুপাতে বিরল কেশ মুণ্ডটাও বিরাট। মুখটি পরিপাটি করে কামানো ও কপাল থেকে গাল, গলা ও বুক পর্যন্ত বিধিত্র সব তিলক চিহ্ন আঁকা। বিদেশীদের কাছে এই চেহারার এক উদ্ভট আকর্ষণ থাকতে পারে কিন্তু পরাশরের এখানে ভাগ্য গণনার জন্য আসা যে কল্পনাতীত। এরকম আজগুবী খেয়াল কেমন করে তার হতে পারে। জ্যোতিষ চক্রবর্তীর পরের কথায় তার কিছুটা হদিশ অবশ্য পেলাম।

মুখে ঈষৎ কৌতুকের কুঞ্চন নিয়ে শঙ্কর মহারাজ বললেন, “হুঁ, অবস্থা বেশ সঙ্গীন দেখছি। রোগটা একেবারে সাংঘাতিকভাবে চেপে ধরেছে। আশা ভরসা কিছু দিতে পারছি না। মঙ্গল আর কেতুর সংযোগ পেয়ে বিপক্ষ একেবারে অপরাজেয়। তবে …না না দাঁড়াও দাঁড়াও। বুধ আর শুক্রকে যদি বক্রী করা যায়! এমনিতেই দেখছি অবস্থানের শনির দৃষ্টি পড়েছে। স্থান-ত্যাগের ব্যাকুলতা দেখা যাচ্ছে তাই। সিদ্ধিলাভ ত্বরান্বিত করবার তাই চেষ্টা। শনির অপ্রসন্নতার সঙ্গে বুধ আর শুক্রকে যদি বক্রী করা যায় তাহলে – তাহলে তোমার অভিলাষ পূর্ণ হতেও পরে।”

পরাশরের মুখটা গোড়া থেকেই লক্ষ করছিলাম। শঙ্কর মহারাজ তাঁর গণনার সিদ্ধান্ত জানাতে শুরু করার পর থেকে বেশ একটু ম্লান থাকবার পর এতক্ষণে তা একটু যেন উজ্জ্বল হতে দেখলাম।
“স্থান ত্যাগের ত্বরাটা যথার্থই বলছেন?” বলে পরাশর এবার উৎসুকভাবে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর দিকে চাইল।
“আমার গণনা ত তাই বলে,” হেসে বললেন শঙ্কর মহারাজ। “বুধ আর শুক্রকে বক্রী করবার ব্যবস্থা যদি চাও ত করা যেতে পারে।”
“আজ্ঞে অনুগ্রহ করে তাই করবেন।” বলে ব্যাগ খুলে করকরে একটি একশ টাকার নোট বার করে জ্যোতিষ মহারাজের পায়ের কাছে নামিয়ে দিলে পরাশর।
তারপর ভক্তি ভরে প্রণাম করে আমার সঙ্গে নিচে নেমে আসবার সময় তার মুখের ভাব দেখে মনে হল এতক্ষণে সে যেন একটু বল ভরসা পেয়েছে।

ভেতরটা তখন আমার তেতো হয়ে গেছে। তবু রাস্তায় বেরিয়ে ট্যাকসি নেবার পর থেকে তার বাড়িতে পরাশরকে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত জোর করে নিজেকে চেপে রেখেছিলাম। তার বাড়িতে পৌঁছে ট্যাকসি ছেড়ে দিলে তার বাইরের ঘরে গিয়ে পা দেবার পর আর নিজেকে রুখতে পার্লাম না।
“তোমার এই অধঃপতন এখন হয়েছে।” গলাটা যতদূর সম্ভব রুক্ষ রেখেই বললাম, “প্রেমে কি আর কেউ কখনো পড়ে না!”
পরাশর তখনও তার সোফায় গিয়ে বসেনি। আমার কথায় আর গলার স্বরে বেশ একটু নাড়া খেলেও সব বুঝেও যেন না বোঝার ভান করে যেন অসহায়ভাবে আমার দিকে চাইল। সে চেহারা দেখে মায়া-দয়া কিন্তু আমার হল না।
আগের মতই ঝাঁঝের সঙ্গে বলে গেলাম, “তোমার এমন মতিভ্রম ধরেছে যে জ্যোতিষীদের কাছে ভালবাসায় জেতবার মন্তর নিতে গেছ!”
“আমি… আমি,” পরাশর একটু যেন থতমত খেয়ে দুর্বল প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করলে, “বললে… বললে — আমি প্রেমে পড়েছি।”
“দিনের আলোর মতো যা স্পষ্ট তা এখনো অস্বীকার করছ!” এবার একটু সহনুভূতির সঙ্গেই বললাম, “তোমার চেহারা চাল-চলন কতাবার্তা সব যে যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিচ্ছে।”
একটু থেমে তার প্রেমে পড়ার প্রত্যক্ষ প্রমাণগুলো তার সামনে ধরে দিলাম। তোমার আজকের সারা সকালের কাণ্ড-কারখানা দেখলেই তোমর আস্থা বুঝতে যে কারুর বাকি থাকে না। আচার্যদেবের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে সারা সকাল তুমি প্রায় একেবারে চুপ। যে মানুষের মুখে সারাক্ষণ কথার খই ফোটে সে হঠাৎ কিসে বোবা হয়ে যেতে পারে। পারে শুধু হঠাৎ ভালোবাসায় পড়লে।
ভালবাসায় খোঁড়া যেন পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ভীরু কাপুরুষ সাসসী বীর হয়ে ওঠে, তেমনি বাচাল বোবা হয়ে যায়, বুদ্ধিমান হয়ে যায় হাঁদা, যেমন তুমি হয়েছ। তা না হলে তুমি ভালোবাসায় কি হবে জানতে জ্যোতিষীর কাছে যাও। তাও আবার ঐ রকম ভণ্ড বুজরুক জ্যোতিষী নতুন নেশা ধরা সাহেব-মেমদের মাথায় হাত বুলিয়ে যে ফাঁকির ব্যবসা ফাঁপাচ্ছে। তার ঐ বুজরুকিতে বিশ্বাস করে তার সাহায্য নিতে তুমি আবার অতগুলো টাকা সঁপে দিয়ে এলে আহাম্মকের মত।”

এতক্ষণ এত যে কথা শোনালাম পরাশার তাতেও একেবারে চুপ। বুঝলাম মনে মনে সে নিজের অন্যায়টা বুঝে রীতিমতো লজ্জা পেয়েছে। এবারে তাই সহানুবূতির সঙ্গে ভালো কথাটাই তাকে জানালাম। বললাম, “শোনো, তোমার এই জ্যোতিষী যাই বলুক তার চেয়ে খাঁটি কথা আমি তোমায় শোনাচ্ছি। তোমার এমনভাবে হঠাৎ প্রেমে পড়ে যাওয়াটা একটু অদ্ভুত। তবে বয়স বাড়ার পর অসময়ে হলে রোগটা এমনি বেয়াড়াভাবেই চেপে ধরে বলে জানি। তোমার তাই কোন দোষ দিচ্ছি না। তার বদলে একটা ভরসা দিচ্ছি এই যে যতই কন্দর্পকান্তি হোক তোমার এলসার বারোহার ওপর একটুও টান নেই।
“তুমি তাই বলছ।” পরাশর যেন অবিশ্বাসের সঙ্গে বললে, “তুমি বুঝলে কি করে?”
“বোঝা ত জলের মত সোজা!” হেসে বললাম এবার, “ভালবাসার তোড়ে হঠাৎ হাত-পা মুখ থেকে বুদ্ধিশুদ্ধি অমন অবশ নাহয়ে গেলে তুমিও পারতে: বারোহার ওপর এলসার কোনো দুর্বলতা যদি থাকত তাহলে তার সঙ্গে ভারতবর্ষ টহল দেবার অমন সুযোগটা সে নয় না? এ যুগে তাদের জগতে তাতে লোকনিন্দার ভয়ও নেই। সুতরাং তোমার এই অসময়ের বেয়াড়া রোগ যদি কাটিয়ে না উঠতে পারো তাহলে বলব বারোহার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভয় করবার তোমার কিছু নেই।”
“এই তোমার মত?” পরাশর মনের খুশিটা মুখে আর লুকোতে না পেরে উৎসাহভরে জিজ্ঞাসা করলে।
“হ্যাঁ, এই আমার মত! তোমার জ্যোতিষীর কথায় তুমি গুলি মারতে পারো!” বলে পরাশরের কাছ থেকে বন্ধুকৃত্য করবার বেশ একটা তৃপ্তি আর গর্ব নিয়েই সেদিন নিজের বসায় ফিরলাম।

বেলা তখন দুপুর পার হয়ে গেছে। আমার পত্রিকার কয়েকটা দরকারী কাজের কাগজপত্র টেবিলের ওপর পড়ে আছে দেখলাম। কিন্তু সেগুলো এখন সারতে হলে স্নান খাওয়া-দাওয়া মাথায় উঠবে। সেগুলো তাই বিকেলের জন্যে স্থগিত রেখে স্নান করবার জ্ন্যে গায়ের জামাটা খুলতে গিয়ে পরাশরের সকালবেলা পকেটে গুঁজে দেওয়া কাগজটা হাতে ঠেকল। সেটা পকেট থেকে বার করে এনে প্রথমে তা আমাকে দেবার মানেটাই বুঝতে পারলাম না। খামে ভরা চিঠি-টিঠি নয়। কোন একটা ছাপানো পত্রিকা থেকে ছিঁঠে নিয়ে ভাঁজ করে মোড়া একটা পাতার টুকরো মনে হল প্রথমে। তারপর ছেঁড়া কাগজটার এক পিঠে ছাপা হরফের ওপরেই বড় বড় করে ধ্যাবড়া কলমে লেখা কটা কথা দেখতে পেলাম। অত্যন্ত তাড়াতাড়িতে হাতের কাছে অন্য কাগজ না পেয়েই পরাশর বোধহয় ছাপানো পত্রিকার পাতার এই ছেঁড়া ফালিটা তার কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু ও কাগজে আমার বাড়ি ফিরে পড়বার জন্যে যা লিখেছে তাতেই ত মেজাজটা ঠিক রাখা শক্ত হল।
পরাশর লিখেছে, – এলসা মেয়েটি ঠগ। ভালো করে লক্ষ করে থাকলে প্রমাণগুলো মনে করে রেখে আমায় জানিও।

এ লেখাটুকু পড়বার পর মেজাজ একেবারে খিঁচড়ে যায় কি না? আমি যে আহাম্মকের মত এতক্ষণ তার প্রেমে পড়াটা নিশ্চিত বলে ধরে নিয়ে তাকে ভৎর্সনা আর উপদেশ দিতে বক-বক করে মরেছি, বিন্দুমাত্র তার প্রতিবাদ না করে পরাশর তাহলে সেগুলো মজা করে উপভোগ করেছে! এর শোধ তাকে যেমন করে হোক দেবই প্র্রতিজ্ঞা করে ভালো করে পড়বার জন্যে ছেঁড়া কাগজটা আর একবার খুলে ধরলাম। কিন্তু পরশরের লেখা কথাগুলোর আগে আরেকটা জিনিষ যা সেখানে চোখে পড়ল তাতে কেমন একটু ধোঁকা লাগল মনে।

কাগজের ফালিটা যেভাবে তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে, তাতে একদিকে একটা ছবির খানিকটা অংশ কাটা অবস্থায় থেকে গেছে। ছবিটা একটি বিদেশী মেয়ের, ছবিটা শুধু নয় তার নিচের লেখা নামের অংশটুকুও মাথার মধ্যে কোথায় যেন অস্পষ্ট টনক নড়লো। নামটায় যতটুকু ওখানে পাওয়া গেছে তা হল, — বারবারা চেরিল … কোথায় দেখেছি এ ছবিটা? কোথায় পেয়েছি এ নাম? কোন পত্রিকা পাতাটা ছেঁড়া হয়েছে তাও যদি বুঝতে পারা যেত। সে পত্রিকা বা অন্য যেখানেই গোক ও ছবি আর নাম আমার যে চোখে পড়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। শুধু তাই নয় ছবিটা আর ঐ নামের সঙ্গে একটা কি খুব অসাধারণ ব্যাপারও জড়িত হয়ে অছে। সেটা কি মনে করবার চেষ্টায়, পরাশরের ওপর অভিমানটাও খানিক বাদে যেন চাপা পড়ে গেল। পরাশরকে কি তার বাসার কোন পত্রিকা থেকে ছবির অংশটা ছিঁড়েছে জিজ্ঞাসা করব? না, সেটা এখন আর সম্ভব নয়। সে কথা জিজ্ঞাসা করতে গেলে পরাশরের এই লেখাটুকুর শোধ আর নেওয়া হবে না। না, অমি নিজে নিজেই ও ছবিটা কি সূত্রে কোথায় দেহেছি তা ভেবে বার করব। যে পর্যন্ত তা না পারি নিজে থেকে পরাশরের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখব না।

বার করতে ঠিকই পারলাম শেষ পর্যন্ত। তবে সেদিন নয়। তার পরের দিন সকালবেলা আচমকা নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। সমাধানটা যখন হয তখন আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবনায় একেবারে অস্থির হয়ে আছি। কারণ তার কিছুক্ষণ আগে ভোরের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে পরাশরের কাছ থেকে অদ্ভুত বেয়াড়া এক ফোন পেয়েছি।

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৬

ছয়

ফোনে একেবার তড়িঘড়ি ডাক।
“কৃত্তিবাস! শোনো এখুনি একবার আমার সঙ্গে বেরুতে হবে। তৈরী হয়ে নাও।”
“এখুনি যেতে হবে মানে? কোথায় যেতে হবে? কেন?”
সে সব কথার কোন উত্তর নেই। শুধু আগের চেয়ে আরো একটু অস্থির গলায় পরাশর জানালে, “আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমার ওখানে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।”
“শোনো শোনো!” ফোনে যথাসাধ্য চিৎকার করলাম। কিন্তু শুনবে কে? নিজের কথাটুকু বলেই পরাশর ফোন নামিয়ে দিয়েছে।

এখন আমি করি কি? কেন, কি বৃত্তান্ত কিছুই না জেনে পরাশরের্ জন্যে তৈরী হয়ে বসে থাকব? সমস্ত মন বিদ্রোহ করে উঠতে পারে কিনা এতে! মানলাম ব্যাপারটা হয়ত দারুণ জরুরী। নষ্ট করার এতটুকু সময় নেই। কিন্তু কোথায় যেতে হবে এই দুটো কথার জন্যে দু সেকেণ্ড দেরী করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয় যেত! এ রকম অন্যায় আবদারে কিছুতেই সায় দেওয়া উচিত নয়। জামা-কাপড় বদলে বেরুবার জন্যে তৈরী হতে হতেই অবশ্য এসব কথা ভাবছিলাম। পরাশরের ওপর রাগ অভিমান যতই থাক নিজের একটু কৌতূহলও ছিল। হঠাৎ কি এমন ব্যাপার হল যাতে এক্ষুণি আমাদের ছুটে যাওয়া দরকার! সত্যিই গুরুতর কিছু না হলে পরাশর অত অস্থির হয় না। সে গুরুতর ব্যাপারটা কি নিয়ে কোথায় হওয়া সম্ভব? কাল আমরা সকালে যাদের সঙ্গে কাটিয়েছি ব্যাপারটা কি তাদের সঙ্গেই জড়িত? না, সম্পূর্ণ নতুন কিছু ঘটনা?

সত্যি কথা বলতে হলে স্বীকার করতেই হয় যে বেরুবার জন্যে তৈরী হতে হতে ক্রমশঃই ব্যাপারটা জানবার জন্যে আরো অধীর হয়ে উঠছিলাম। পরাশরের আসার জন্যে আর তর সইছিল না। সে আধঘণ্টার মধ্যে অসবে বলেছে। কিন্তু আধঘণ্টাটাই আমার কাছে বড় বেশী দেরী মনে হচ্ছে তখন। পরাশরের ওপর গোড়ায় রাগ অভিমান যা করেছি তা তখন সম্পূর্ণভাবেই কেটে গেছে। বরং পরাশর তার নিজমূর্তি ধরেছে বলে তখন খুশিই হয়েছি। কাল কেন কি মতলবে সে অমন চুপ মেরে ছিল এখনও জানি না। তবে সেটা তার প্রেমে গদগদ ভাব ভাবার মত আহাম্মক হবর জন্যে আমিই এখন লজ্জিত। সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লেও পরাশরের অমন অবস্থা হবে কেন? তার ঐ ভোম মেরে থাকার পেছনে অন্য কোনো একটা রহস্য নিশ্চয় আছে আর আজকের এই অস্থিরতা নিশ্চয় সেই রহস্যের সঙ্গে জড়িত। যাক হাতে পাঁজি মঙ্গলবার থাকতে মিছে এত জল্পনা কল্পনার দরকার কি? পরাশর আধঘণ্টার মধ্যে আসবে বলেছে। আধঘণ্টার পঁচিশ মিনিটই ত কেটে গেছে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!

কিন্তু কি হল কি! ঘড়ির কাঁটা পাঁচ মিনিট ছাড়িয়ে দশ মিনিটের দাগও যে পার হতে চলেছে। এখনো পরাশরের দেখা নেই কেন? পরাশর মাঝে মাঝে খেয়ালবশে ঘড়ি ধরা সময় রাখতে গাফিলতি করে বটে, কিন্তু সে রকম দরকারী কিছু হলে সে আবার সেকেণ্ডের কাঁটাকেও হার মানায়। যে উত্তেজনা আর অস্থিরতার সঙ্গে সে খানিক আগে ফোন করেছে তাতে তার ত একেবারে কাঁটায় কাঁটায় আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোবার কথা। কি হয়েছে কি তাহলে? ব্যস্ত হয়ে তার বাসাতেই এবার ফোন করলাম। না সে বাসায় নেই। তার অনুচরের কাছে জানা গেল আধঘণ্টারও আগে সে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার মানে আমায় ফোন করবার পর বাড়িতে সে আর এক মিনিটও সময় নষ্ট করে নি। কিন্তু তার বাসা থেকে আমার এখানে আসতে ত খুব বেশী হলে বিশ মিনিটের বেশী লাগবার কথা নয়। বিশেষ এই সকালবেলার ফাঁকা রাস্তায়। তাহলে কি গাড়ির ব্রেকডাউন? না দুর্ঘটনা কোনো! অশুভ ভাবনাটাকে দূরে ঠেলে রেখে আবার ফোন করলাম পরাশরের বাসায়।
জিজ্ঞেস করলাম তার অনুচরকে, “পরাশর কোথায় যাচ্ছে কিছু বলে গেছে কি?”
“না তা বলেন নি।” উত্তর পেলাম, “শুধু বলে গেছেন আজ দিনের বেলা আর বাড়িতে খাবেন না।”

পরশর নিজে গাড়ি রাখে না। সাধারণত দরকার হলে পাড়ার ট্যাকসি স্ট্যাণ্ড থেকে কোনো একটা গাড়ি আনিয়ে নেয়। পাড়ার গাড়ি সব তার চেনা। সেই জন্যে কার কোন ট্যাকসি নিয়েছে জানলে পরে খোঁজ-খবর নেবার সুবিধে হয়।
ফোনে এবার সেই কথাই জানতে চাইলাম, “কোন ট্যাকসি নিয়ে পরাশর বেরিয়েছে তা দেখেছ?”
“আজ্ঞে ট্যাকসিতে ত তিনি যান নি!”
“ট্যাকসিতে যান নি? তাহলে গেছেন কিসে?”
“আজ্ঞে বড় একখানা প্রাইভেট গাড়িতে। ভোরেই কাকে ফোন করে আনিয়ে রেখেছিলেন।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।” বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করলাম।

পরাশর মাঝে মাঝে তেমন দরকার হলে একটা গাড়ি ভাড়া দেওয়ার এজেন্সী থেকে ড্রাইভার সমেত প্রাইভেট ভালো গড়ি আনিয়ে ব্যবহার করে। আজও তাই করেছে। কিন্তু এই সাত সকালে ওরকম গাড়ি ভাড়া করার কারণটা কি? আর কারণ যাই হোক সে গাড়ি নিয়েও আমার কাছে এমন কথার খেলাপ করল কেন? আর কারণ যাই হোক আধঘণ্টার মধ্যে তুলে নিতে আসছে বলে আমায় তৈরী থাকতে বলাটা তার ঠাট্টা নিশ্চয় নয়!

রাস্তায় দুর্ঘটনা ছাড়া পরাশরের এই কথার খেলাপের আর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না ভেবে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমার বাড়ি থেকে তার বাসা পর্যন্ত ট্যাকসিতে খোঁজ করে আসব কিনা ভাবছি, এমন সময় টেবিলের ওপর ভাঁজ করা কাগজটা চোখে পড়ল। গত কাল পরাশর এইটেই আমার পকেটে গুঁজে দিয়েছিল আর সারা দিন সারা রাত চেষ্টা করেও আমি তার ছাপা ছবি আর নামের অংশটা আগে কোথায় দেখেছি স্মরণ করতে পারি নি।

মনের গতি বড় বিচিত্র। ধীর স্থির হয়ে অত ভেবে চিন্তেও যা বার করতে পারি নি এই উদ্বেগ অস্থিরতার মাঝে সেটা যেন মাথার ভেতর ঝিলিক দিয়ে ফুটে উঠল। ঐ মুখ আর বারবারা রেচিল নাম। ও ত আমার ভালরকম জানা। ভারতবর্ষের বড় বড় সব হোটেলে ট্যুরিস্ট সেজে যে দল অনেক সরল অন্য ট্যুরিস্টদের বিষ খাইয়ে বেহুঁশ করে সর্বস্ব চুরি করেছে মেয়েটি ত সেই দলের। পুরো নাম বারবারা রেচিল স্মিথ। বৃটেনে বাড়ি। চার্লস শোভরাজ নামে এক ধুরন্ধর শয়তানের সর্দারীতে আরো দুটি মেয়ের সঙ্গে বহুদেশে এ কাজ করে বেড়াবার পর ভারতবর্ষের দিল্লী শহরে এসে প্রথম ধরা পড়েছে। এদের সকলের ছবি ও শয়তানীর বিবরণ আমি এই কিছুদিন আগে পড়েছি। ঠিক এই বিবরণ ছপা কাগজের ফালিতে আমাকে পরাশরের চিঠিটি লেখার মধ্যে কোনো অস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে নাকি?

সেইটেই বোঝবার চেষ্টা করার মধ্যে ফোনটা বেজে উঠল।
বিদেশী মেয়ের যান্ত্রিক কণ্ঠ, “মিঃ ভদ্র আছেন?”
বুঝলাম কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের টেলিফোন অপারেটর আমায় খোঁজ করছে।
কেন করছে তা বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়েই বললাম, “হ্যাঁ, আছি। কোথা থেকে কে ফোন করছেন?”
“এইখানে কথা বলুন।” বলে অপারেটর ফোন ছেড়ে দিলে।
পর মুহূর্তেই পরাশরের গলা শুনলাম, কৃত্তিবাস! যা বলছি মন দিয়ে শোনো।”
পরাশরকে সুস্থ নিরাপদ জেনে তখন আমার আগেকার উদ্বেগ দুর্ভাবনাটা ক্ষোভ হয়ে উঠেছে।
“তার আগে আমার কথা শোনো!” রীতিমতো ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম, “আমাকে সাত সকালে ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে এমন মিছিমিছি তৈরী থাকতে বলার মানে কি? তুমি…”
আমার ঝাঁঝালো গলার জবাবে পরাশরের একটু বেশীরকম গম্ভীর শান্ত গলা — “সব পরে জানতে পারবে। এখন ভালো করে শুনে নাও যা বলছি। খানিকক্ষণ বাদে তোমার কাছে একটা বড় গাড়ি যাচ্ছে। তুমি যেন বিদেশে কোথাও যাচ্ছ এমনভাবে সাজ পোষাক সরঞ্জাম নিয়ে সে গাড়িতে চলে আসবে। বিদেশে যাবার লাগেজ তোমার আছেই। যা হোক কিছু ভরে সেগুলো সঙ্গে নেবে। পাসপোর্ট আনতেও ভুলো না।”
“তা না হয় ভুলব না।” হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু এ গাড়িতে করে যেতে হবে কোথায়?”
“যাবে, কাল যেখানে গিয়েছিলে সেই পাঁচতারা মার্কা হোটেলে। কোনো ভাবনা নেই। তোমার ঘর রিজার্ভ করা আছে। তুমি এসে লবির কাউণ্টারে দাঁড়ালেই হবে। আমি নিজে সেখানে থাকব। আর একটা কথা। আসবার সময় জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজের বাড়ির সামনে গাড়িটা একটু দাঁড় করাবে। তোমায় নামতে হবে না। শঙ্কর মহারাজেরই অনুচরদের কেউ তোমার হাতে একটা সীলকরা খাম দিয়ে যাবে। সেইটে নিয়ে আসবে।”
“শোনো পরাশর…”
শোনবার ওদিকে কেউ নেই। পরাশর যথারীতি কথা শেষ করেই ফোন নামিয়ে রেখেছে।

কিন্তু এ আমায় কি দারুণ সমস্যায় সে ফেললে। যেন বাইরে কোথাও যাচ্ছি এমন ভাবে সাজসরঞ্জাম নিয়ে পাঁচতারার হোটেলে গিয়ে ওঠা, সেখানে আবার আমার জন্যে আগে থাকতে ঘর রিজার্ভ হয়ে থাকা, তার সঙ্গে ঐ বুজরুক জ্যোতিষ চক্রবর্তীর দেওয়া গালা আঁটা এক চিঠির বাহক হওয়া, — এসব কিছুর মানে কি! কাল যাকে পরাশরের প্রেমাস্পদই বলে ভেবেছিলাম, সেই ভারতীয় পুরাতত্ত্বের ছাত্রী এলসা, এই খানদানী হোটেল, জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজ, আর – আর — এই ছেঁড়া কাগজের ছবি আর নামটার মধ্যে কোনো ভেতরের সম্পর্ক আছে কি?

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৭

সাত

ঠিক ঐ কথাই ভাবতে ভাবতে নয় কেমন একটু বিভ্রান্ত অবস্থায় মাঝপথে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে তাঁর পাঠিয়ে দেওয়া গালা-আঁটা খামটা নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে যখন গিয়ে পৌঁছ্হোলাম, তখন হোটেলের বাইরে বা ভেতরে অস্বাভাবিক কোনো কিছুই কিন্তু দেখতে পেলাম না। সকালের দিকে এ ধরণের বড় হোটেলে যে একটা প্রায় নিঃশব্দ ব্যস্ততা থাকে তার বেশী সেখানে কিছুর চিহ্ন নেই। লবির কাউণ্টারে পরাশর সত্যিই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে একা নয় তার সঙ্গে আরেকজনও আছেন।আমি গিয়ে দাঁড়াতেই পরাশর পরিচয় করিয়ে দিলে। “মিঃ ভদ্র, মিঃ সেঙ্গার – হোটেলের ম্যানেজার।”
ম্যানেজার সেঙ্গার ভারতীয় কিন্তু পোষাক-আশাক চাল-চলন এমনকি চেহারা দেখেও তা বোঝা খুব সহজ নয়। বছর চল্লিশের অত্যন্ত সুঠাম, আর যাকে বলা যায় ব্যায়াম-সাধা মজবুত চেহারা। রংটা ইউরোপীয়দের মতই প্রায় ফর্সা হওয়ার দরুণ ভুলটা সহজেই হতে পারে।
তিনি একটু হেসে করমর্দনের বদলে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ইংরেজীর বদলে হিন্দীতেই বললনে, “আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি মিঃ ভদ্র। আপনার কামরা ঠিক করাই আছে। আশা করি আপনার কোনো অসুবুধে হবে না।”

আমি পরাশরের পাঠানো গাড়ি থেকে নামবার পরেই হোটেলের ইউনিফর্ম-পরা পোর্টার আমার লাগেজ বয়ে এনে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমায় অভ্যর্থনা জানাবার জানাবার পরই ম্যানেজার পরই ম্যানেজার তাকে আমার রুম নম্বর জানিয়ে সেখানে আমার লাগেজ নিয়ে যেতে বললেন। কাউণ্টারের রিসেপশন ক্লার্কের কাছ থেকে কামরার চাবি নিয়ে সে এগিয়ে যেতে তার পিছু নিতে হল। কিন্তু পরাশর ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল কেন? সে আমার সঙ্গে আসবে না? কি কারণে এমন অদ্ভুত ছুতো করে আমায় এখানে আসতে হল তা বোঝাবে তাহলে কখন। আমার পকেটে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর গালা আঁটা চিঠিটাও ত তাকে দেওয়া হল না। পরাশর আমায় পরিচয় করিয়ে দেবার সময় পকেটে হাত দিয়ে একবার সেটা বার করতে গেছলাম, কিন্তু হঠাৎ পরাশরের চোখের ইঙ্গিতটা দেখে আর এগোই নি।পরাশর তাহলে এখানে আমার সঙ্গে পর পর ভাবই রাখবে নাকি? আমার জন্যে ঘর রিজার্ভ করা টরা সব ত সে- করেছে। সে সব কি করেছে কি অজুহাত দিয়ে? ট্রাভেল এজেণ্টের ভূমিকায়? একটু দূরত্ব রাখতেই সে যে চায় তা হোটেলের লবিতে ঢুকে তার পোষাক দেখেই একটু অবশ্য মনে হয়েছে। আজ আর ধুতি পাঞ্জাবী নয়, একেবারে টাই-ফাই বাঁধা পাক্কা দামী সাহেবী স্যুট। আমার পরিচয় করিয়ে দিলেও কথাবার্তা যা বলেছে একটু ছাড়া ছাড়া ভাবেই।এটা কি ম্যানেজারের কাছে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্কটা লুকোবার জন্যে? কিন্তু তাই বা কেন! এই অভিনয় করে কদিন এখন চালাতে হবে? ক’দিনের জন্যে আমার জন্যে কামরা বুক করা হয়েছে তাও ত কাউণ্টার থেকে জানবার সুযোগ পেলাম না। এই সব কিছুর জন্যে পরাশরের সঙ্গে একবার অন্ততঃ আলাপ করবার সুযোগ যে না পেলেই নয়।
হোটেল লিফটে পোর্টারের সঙ্গে ওপরে উঠতে উঠতে এইসব কথাই ভাবছিলাম। হোটেলের কামরগুলোর চাবি রীতিমত প্রকাণ্ড ও ভারী। বোর্ডারদের পকেটে করে চাবি বাইরে নিয়ে যাওয়ার উৎসাহটা দমাবার জন্যেই এই ব্যবস্থা। এ হোটেলের চাবিও যথরীতি প্রকাণ্ড। পোর্টারের হাতে সেটার ওপর বড় বড় খোদাই করা নম্বরটা ইতিমধ্যে চোখে পড়েছে একবার। তাতে সংখ্যা লেখা ৪ ২৬। তার মানে চারতলায় আমার ছাব্বিশ নম্বর ঘর।

চারতলায় লিফট থামতে ল্যাণ্ডিং-এ পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই একটু চমকে উঠতে হল। এই ল্যাণ্ডিং-এ নিচে নামবার জন্যে লিফটের অপেক্ষায় আর কেউ নয়, এলসাই দাঁড়িয়ে। আমি তাকে চিনলেও সে এই ইউরোপীয় পোষাকে আমাকে প্রথমে ঠিক বোধ হয় চিনতে পারেনি। হঠাৎ তাকে দেখে একটু থেমে সম্ভাষণ করবার ইচ্ছে হলেও অবস্থা বুঝে তা দমন করে আমি তখন পোর্টারের পেছনে এগিয়ে যচ্ছি। একটু আড়চোখে চেয়ে বুঝলুম, প্রথমে না পারলেও তার পরেই চিনতে এলসার ভুল হয় হয়নি। তবু আরো নিশ্চিত হবার জন্যে সে আমার পিছনেই কয়েক পা এসে কিন্তু দ্বিধভরে নেমে গেল। সে দ্বিধা কাটিয়ে দেবার চেষ্টা আমি আর করলাম না। হোটেল জ্যানিটর তখন চাবি কিয়ে আমার কামরার দরজা খুলে ভেতরে লাগেজ নিয়ে যচ্ছে। তার পিছু পিছু নিজের কামরায় ঢুকে দরজাটা ভেজিয়েই দিলাম যেন অন্যমনস্কভাবে।

অন্য সময় হলে শুধু কামরাটির সাজ-সজ্জা বাহার দেখে খানিক মুগ্ধ হয়ে থাকতে পারতাম। তারা চিহ্নগুলো যে অকারণে লাগান নয় ২৬নং ঘরটির সবকিছুতেই তার প্রমাণ সুস্পষ্ট। কিন্তু তখন আমার মন অস্থির হয়ে অছে অন্য চিন্তায়। পোর্টার জিনিষপত্র গুছিয়ে রাখবার পর তাকে একটু ভালো করে বখশিস দিয়ে বিদায় করে দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। এবার আমায় নিজের অবস্থাটা ঠিকমত বুঝে নিতে হবে। জ্যাকেটটা খুলে ওয়ার্ডরোবে রাখতে গিয়ে প্যাকেটে রাখা শঙ্কর মহারাজের চিঠিটা হাতে ঠেকল। আমার উপস্থিত ভেবে নেবার সমস্যার মধ্যে এটাও প্রধান একটা। পরাশরকে এ চিঠি দেওয়া যায়নি এখনো। তাকেই যে দিতে হবে এমন কোনো নির্দেশ অবশ্য চিঠির ওপর নেই! তাহলে ইচ্ছে করলে আমিও কি গালা-আঁটা খামের মধ্যে কি আছে তা খুলে পড়তে পারি? খোলবার ইচ্ছেটা প্রবল হলেও গালা-আঁটা থাকাটাই সে ইচ্ছার বাধা হয়ে দাঁড়াল। পরাশরের মত আমারও পড়বার হলে অত কষ্ট করে গালা লাগান থাকবে কেন? কিন্তু পরাশর সে চিঠি কখন কিভাবে নেবার ব্যবস্থা করবে? এই যে এলসার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলেও স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে আলাপ করতে পারলাম না, এ বিষয়েও ত পরাশরের পরামর্শ দরকার। যতক্ষণ তার সঙ্গে কথাবার্তার সুযোগ না হচ্ছে ততক্ষণ আমার করণীয় কি? এই কামরার মধ্যে বন্দী হয়ে বসে থাকব নাকি! আপাততঃ তাই অন্ততঃ থাকা ছাড়া উপায় নেই বুঝে হোটেলের ক্যাণ্টিন থেকে এক পট কফি আনিয়ে নেবার জন্যে রুম সার্ভিস-এ ফোন করতে যাচ্ছিলাম।

ফোনটা তোলার আগেই যন্ত্রটার তলায় লম্বা ভাঁজ করা কাগজটা চোখে পড়ল। কাগজটার সঙ্গে তার ওপরকার বড় বড় অক্ষরে বাংলা লেখাটা – খুলে পড়ো। তাই পড়লাম। কোনো সম্বোধন নেই। নিচে স্বাক্ষরও নয়। কিন্তু কাকে লেখা কে লিখেছে বুঝতে কোন অসুবিধে হল না ভেতরের চিঠির ভাষা পড়ে। চিঠিটা এই – পাজামা পাঞ্জাবী যদি সংগে এনে থাকো ভালো। নয়তো শুধু সার্ট-প্যাণ্ট পরে দোতলায় নেমে এসো এখুনি। লিফটে নেমো না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে তেরো নম্বর কামরায় একটু দেখেশুনে ঢুকবে। করিডরে কেউ নেই দেখলে দরজায় বেল-টেল না টিপে শুধে একটু ঠেলে ঢুকবে। গালা দেওয়া খামটা সঙ্গে নিয়ে এসো। এ চিঠিটাও।

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৮

আট

এ চিঠির কেন, কি বৃ্ত্তান্ত ভাবার জন্যে বৃথা সময় নষ্ট না করে তখনই নির্দেশ পালন করলাম । দোতলার তেরো নম্বর ঘরের দরজা সত্যিই ভেজানো ছিল মাত্র। একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ঘরে ঢুকে সত্যিই একটু থতমত খেয়ে দাঁড়াতে হল। এ কার ঘরে এসে ঢুকলাম। ওদিকের খাটের ওপর লম্বা হয়ে যে লোকটি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে, মুখ দেখতে না পেলেও চুল দেখে বোঝা যাচ্ছে – ভদ্রলোক ইউরোপীয়। পরাশরের চিঠির নির্দেশ মানতে গিয়ে এ কার ঘরে এসে ঢুকলাম? অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে সাবধানে দরজাটা আবার খুলতে থাকি এমন সময় বিছানায় শায়িত লোকটা পাশ ফিরতে গিয়ে আমায় দেখতে পেয়ে একটু যেন কষ্ট করে উঠে বসল।

এ কি এ তো বারোহা! এর মধ্যে তার বিছানার পাশের সাইড টেবিলে, ওষুধের শিশি ও জলের গ্লাস ইত্যাদি আমি দেখতে পেয়েছি। কি হয়েছে কি বারোহার? শুধু পাশের টেবিলের ওষুধপত্র নয়, তার চেহারা দেখেও ত অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে। তার গলার স্বরেও সেটা বোঝা গেল। আমায় দেখে বিস্মিত টিস্মিত নয় একটু কাতর আর ক্ষীণ হলেও স্বাভাবিক স্বরে সে বললে, “আসুন মিঃ ভদ্র। আমি আপনাদের অপেক্ষা করছি।” “আমাদেরই অপেক্ষা করছেন!” কাছে
গিয়ে দাঁড়িযে সবস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার হয়েছে কি?”
“বিশেষ কিছু নয়!” দুর্বল গলাতেই বারোহা নিজের অসুস্থতাটা অগ্রাহ্য করে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলে, “”কাল একটু বোধ হয় মাত্রা বেশী হয়ে গিয়েছিল তাই…”
“না … মাত্রা আপনার বেশী হয়নি মিঃ বারোহা!” বারোহার কথার ওপরই পরাশরের গলা শুনতে পেয়ে ফিরে তাকিয়ে শুধু পরাশর নয়, তার সঙ্গে ম্যানেজার মিঃ সেঙ্গারকে দেখতে পেলাম।
দরজাটা এবার ভালো করে বন্ধ করে পরাশর ম্যানেজারের সঙ্গে বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আগের কথারই জের টানলে, “মাত্রা বেশী হয়েছে ভাবাটা আপনার ভুল। আমরা রেস্তোরাঁর রেকর্ড বই ত বটেই, টেবিলের ওয়েটার আর বার অ্যাটেণ্ড্যাণ্টদের কাছেও খবর নিয়েছি। খবর কি পেয়েছি, তা বলুন না মিঃ সেঙ্গার! একটু সবিস্তারেই বলবেন।”

মিঃ সেঙ্গার এ অনুরোধে প্রথমটা যেন থতমত খেলেন। এ কামরার মধ্যে এবার বেশ কাছে থেকে মিঃ সেঙ্গারকে তখন লক্ষ্য করবার সুযোগ পেয়েছি। ওপরের ফিটফাট পালিশ করা চেহারা সত্ত্বেও লোকটিকে কি একটা কারণে যেন অত্যন্ত বিব্রত মনে হল। কারণটা এর পরই তাঁর কথায় বুঝতে বাকি রইল না। মিঃ সেঙ্গার কিছুটা মুখস্থ আওড়াবার মত যা বলে গেলেন, তাতে জানা গেল, আগের দিন রাত্রে বারোহা এই হোটেলের রেস্তোঁরায় আর কয়েকজন বোর্ডারকে নিয়ে একটা ছোট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। পার্টিতে বারোহা বাদে ছিল ফরাসী প্রৌঢ় মঁসিয়ে রেনোয়া। তাঁর ভাগনী জিনেৎ আর এলসা। পার্টিতে আহার যতটা তার চেয়ে পানটা একটু বেশীই সাধারণতঃ হয়ে হাকে, কিন্তু রেস্তোরাঁর বারের হিসেব থেকে জানা গেছে সেরকম কিছু একেবারেই হয় নি। বারোহা ব্রাণ্ডির ভক্ত, গত রাত্রে তাও সে গোণাগুণতি কয়েকটি পাত্র মাত্র খেয়েছে। মঁসিয়ে রেনোয়া, মাদমোয়াজল জিনেৎ আর এলসাও তাই। মঁসিয়ে রেনোয়া কিছুক্ষণ পার্টিতে থাকবার পরে শরীর খারাপ বলে বিদায় নিয়ে গেছেন। পার্টিও তারপর বেশীক্ষণ চলেনি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সবাই যে যার কামরায় চলে গিযেছেন। কিন্তু তারপর, মানে, রাত্রি থেকেই এঁদের অসুস্থতা শুরু হয়েছে।

প্রথমে রিসেপশন কাউণ্টারে ‘কল’ এসেছে মঁসিয়ে রেনোয়ার কাছ থেকে। তিনি নিজে অত্যন্ত অসুথ বোধ করছেন। কিন্তু নিজের চেয় বেশী ভাবিত হয়েছেন তাঁর ভাগনী জিনেতের জন্যে। কিছুক্ষণ আগে তাঁর হঠাৎ গলাটা যেন কেউ চেপে ধরেছে এই রকম বোধ হবার সঙ্গে মাথাটা বড় বেশী ঝিম-ঝিম করছে মনে হয়। হয়ত প্রেসার বেড়েছে মনে করে তার ওষুধ খুঁজে না পেয়ে তিনি পাশের ঘরের জিনেৎকে ফোন করেন। জিনেতের ঘুম নাকি খুব পাতলা। তবু আট-দশ মিনিট ধরে ফোন করে সাহায্য চান। ইমার্জেন্সির সাহায্য আসবার আগেই জিনেৎ-এর সাড়া অবশ্য তিনি পান। কোন রকমে ফোন ধরে সে তার বুকের কষ্ট আর গভীর আচ্ছন্ন ভাবের কথা বলে। মঁসিয়ে রেনোয়া তার দরজায় গিয়ে দাঁড়াবার পর কোনরকমে দরজাটাও খুলে দিতে পারে তখন।

মঁসিয়ে রেনোয়া ইমার্জেন্সীতে ফোন করায় মিনিট খনেকের মধ্যেই রিসেপশনে মিঃ বারোহার ফোন আসে, তখনই একজন ডাক্তার পাওয়া যাবে কি না জানবার জন্যে। এ ফোন পেয়ে রিসেপশনের স্টাফ যে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ওঠে তা বলাই বাহুল্য। মিঃ সেঙ্গারকে তৎক্ষণাৎ তারা ফোন করে জাগিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা জানায়। মিঃ সেঙ্গার অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে তখনই হোটেলে চলে এলেও ব্যাপারটা নিয়ে বেশ একটু মুস্কিলে পড়েন। মঁসিয়ে রেনোয়া তখন অবশ্য ফোনে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর ভাগনী ইতিমধ্যে অনেকটা সুস্থবোধ করছে বলে তাঁর জন্যে কোনো ডাক্তার পাঠাবার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু অসল দুর্ভাবনা হয়েছে মিঃ বারোহাকে নিয়ে। মিঃ বারোহা সেই একবার ডাক্তারের জন্যে ফোন করার পর একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। বার বার তাঁর ঘরে রিং করেও কোনো সাড়া তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি যেন একবার ফোন করেই ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে হয়। ঘুমিয়ে পড়ার বদলে অজ্ঞান হওয়ার সম্ভাবনাও যে থাকতে পারে সে কথা ভেবেই ম্যানেজার তখন অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছেন।

এই পর্যন্ত শুনেই বারোহা একটু যেন লজ্জিতভাবে বাধা দিয়ে বললেন, “অজ্ঞানই কি হয়ে গিযেছিলাম? কে জানে! আমার কিন্তু রিসেপশনে ফোন করার কথাও কিছু মনে নেই।”
ম্যানেজারকেতার পর একটু আশ্বাস দেবার চেষ্টা করলে বারোহা, “যাইহোক, আমি যখন আর সাড়াশব্দ করিনি থখন আমার ফোনটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরেই করা বুঝেই নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।”
“তা কি পারি!” ম্যানেজা একটু ক্ষুভ স্বরেই প্রতিবাদ জানালেন, “আপনার বিষয়ে কি করা উচিত, সেইটেই তখন দারুণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িযেছিল। আপনি সত্যি অসুস্থ হলে যথাসাধ্য চিকিৎসা আর শুশ্রুষার ব্যবস্থা আমাদের না করলে নয়। অথচ আমাদের কোনো বোর্ডারকে মাঝরাতে বিনা কারণে জাগিয়ে বিরক্ত করার অধিকার আমাদের নেই। তবু মঁসিয়ে রেনোয়াও নিজের আর তার ভাগনীর অসুস্থ হওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক কিছু নয় বলেই ধরে নিতে বাধ্য হলাম। আপনাদের সম্বন্ধে হোটেলের দায়িত্ব খাবার আর পানীয় নিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানলাম আপনারা যা খেয়েছেন, তা একেবারে সন্দেহাতীতভাবে নিরাপদ নির্দোষ খাবার, কারণ সমস্ত হোটেলেই সেই এক খাবার পরিবেশিত হয়েছে আর তাতে বিন্দুমাত্র কুফল কারুর হয়নি।”
“খাবার না হলে দোষ কি তাহলে পানীয়ের?”
“সে সম্ভাবনাটা মাথায় এলেও আমল একরকম দিইনি বললেই হয়। আমাদের হোটেলের চেয়ে বিশুদ্দ্ব একেবারে সর্বশ্রেষ্ঠ পানীয় দেশবিদেশের সেরা হোটেলের পক্ষেও দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ এ হোটেলে প্রথম শ্রেণীর জিনিষ ছাড়া নিরেস কিছু এক ফোঁটাও কখনো আসে না।”
“তাহলে কি মাত্রার বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?”
“সত্যি কথা স্বীকার করছি, মিঃ বর্মা ভোর রাত্রে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমায় ফোন করার আগে ওদিক দিয়ে কিছু ভাবিইনি।”
“মিঃ বর্মা ভোরবেলা আপনাকে ফোন করেছিলেন? উনি হোটেলের এ ব্যাপারের কথা জানলেন কি করে?” আমার বিস্মিত প্রশ্নটাই বারোহার মুখ দিয়ে বার হল।
“হ্যাঁ!” ম্যানেজার বিমূঢ় মুখেই স্বীকার করলেন, “ওঁর ফোন পেয়ে আমি ঐ কথা ভেবেই বেশী হতভম্ব হয়েছি। প্রথমে অবশ্য অধিকারের বাইরে এরকম নাক গলাবার স্পর্ধার জন্যে ওঁকে জাহান্নমে বলার ইচ্ছেই হয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি ওঁর যুক্তি শুনে ওঁর প্রস্তাবে রাজী না হয়ে পারিনি।”
“কি যুক্তি দিয়েছেন মিঃ বর্মা! আর কি প্রস্তাব করেছেন?” এবারও আমার কৌতূহলটাই প্রকাশ করলে বারোহা।
আমাদের মত হোটেলের সুনামের পক্ষে এরকম ঘটনা যে অত্যন্ত সর্বনাশ ক্ষতিকর, আর তার মূলে কি আছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বার করে সে জট যে নিঃশব্দে এখনি সরিয়ে ফেলা দরকার, তা জানিয়ে উনি আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছেন।
“সে-সাহায্য আপনার পক্ষে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়, বুঝতে পারছি,” নিজের অসুস্থতা যেন ভুলে গিয়ে একটু হেসে উঠে বললেন বারোহা। “কিন্তু এখনো সেই প্রশ্নটাই উত্তর পাওয়া গেল না। মিঃ বর্মা হোটেলের ও ব্যাপারের কথা রাত না পোহাতে জানলেন কি করে? হোটেলের অন্য কোন বোর্ডারও ত এখনো এ বিষয়ে বোধহয় কিছু জানে না।”
“তা ত জানেই না।” ম্যানেজার বললেন, “তবু মিঃ বর্মা কেমন করে হোটেলের বাইরে থেকে এ খবর পেলেন উনি আসামাত্র আমি জিজ্ঞাসা করেছি। তাতে উনি যা উত্তর দিয়েছেন ওঁর মুখেই শুনুন।”
“সত্যি রহস্যটা কি তা বলবেন মিঃ বর্মা।” জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৯

নয়

“রহস্যটা জানতে চন?” বেশ একটু গম্ভীর মুখে বললে পরাশর, “তাহলে শুনুন। এসবকিছু জানতে পেরেছি জ্যোতিষের গণনায়।”
“জ্যোতিষের গণনায়!” বিস্ময় আমিও প্রকাশ না করে পারলাম না।
“হ্যাঁ, জ্যোতিষের গণনায় । এই দেখুন না জ্যোতিষের আর একটা গণনার কথা আপনাদের শোনাচ্ছি।” পরাশর আমার কাছ থেকে গালা দেওয়া খামটা চেয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ভেতরকার কাগজটা পড়তে পড়তে বললে, “আপনাদের হোটেলের দোতলার সবচেয়ে ভালো স্যুইটটা আজ খালি হবার কথা আছে। কিন্তু তা হবে না। মিঃ র্যা থবোন আর তাঁর স্ত্রী আরো পাঁচদিনের জন্যে স্যুইটটা বুক করবেন অর তার মধ্যে ওঁদের একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা। সেইটেই ঠেকাবার জন্যে আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।”
“আপনি জ্যোতিষের গণনার জোরে এসব ভবিষ্যদ্বাণী করছেন!” বারোহা বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়েই জিজ্ঞাসা করলে। “র্যা থবোন দম্পতির মধ্যে দুর্ঘটনাটা কার হবে আর কি ধরণের তা আপনার জ্যোতিষের গণনায় কিছু পাচ্ছেন?”
“গণনা ত আমার নয়!” পরাশর তার হাতের কাগজতা দেখতে দেখতে বললে – “আমি একজন অসামান্য জ্যোতিষীর কাছ থেকে এসব ‘টিপস’ মানে হদিস পাই। তাঁর এ কাগজ থেকে যা পাচ্ছি তাতে দুর্ঘটনা মিস্টার বা মিসেস র্যা থবোন যে কোনো জনেরই হতে পারে। দুজনেরই একসঙ্গে হওয়া অসম্ভব নয়। আর দুর্ঘটনাটা আপনাদের যা হয়েছে তারই একটু বড় সংস্করণ।”
“তার মানে?” বারোহা আর ম্যানেজার দুজনেই প্রায় একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন। “এ হোটেলে আবার এইরকম বিষক্রিয়া গোছের ব্যাপার দেখা যাবে আর তা হবে আরো গুরুতর।”
একটু থেমে বারোহা একটু তীক্ষ্ণস্বরেই পরাশরকে প্রশ্ন করলে, “এবারে আমাদের যা হয়েছে তা কোনো বিষ থেকেই হয়েছে বলে আপনি মনে করেন! কিন্তু বিষ আসবে কোথা থেকে? মিঃ সেঙ্গার সমস্ত খাদ্য আর পানীয়ই চেক করে গ্যারাণ্টি দিচ্ছেন। তাতে কোন বিষ থাকতেই পারে না।”
“তাতে না থাক।” পরাশর গম্ভীর হয়েই জানালে, “আপনারা যা খেয়েছেন পান করেছেন তার মধ্যেই বিষ ছিল।”
“কেমন করে থাকবে।” বারোহা বেশ একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বললে, “আমাদের খাবার আর ড্রিংক বিষ দেবে কে, আর কি উদ্দেশ্যে।”
“তাই এখন খুঁজে বার করতে হবে!” বললে পরাশর।
“আপনি আমাদের হোটেলের রেস্তোরাঁর ওয়েটার বা বারবয়দের সন্দেহ করছেন কি?” মিঃ সেঙ্গার বেশ তীক্ষ্ণ স্বরেই জিজ্ঞাসা করলেন।
“না, তা করছি না।” শান্তভাবে জানালে পরাশর।
“তাহলে!” উত্তেজনায় বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ পেটে যেন একটা ব্যাথা বোধ করে বারোহা মুখটা একটু বিকৃত করে আবার বিছানায় বসে পড়ল।
“আপনি মিছিমিছি অত উত্তেজিত হবেন না মিঃ বারোহা।” পরাশর কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত করতে চাইলে।

ফল কিন্তু উল্টো হল। বারোহা সাময়িক ব্যাথাটা ঝেড়ে ফেলে আবার সোজা হয়ে বসে বললে, “আমার এ উত্তেজনা মিছিমিছি বলছেন! আপনি যা বলছেন তার মানেটা নিজেই তলিয়ে বুঝেছেন। আপনার মতে আমাদের খাবার বা পানীয়ে বিষ অতি অবশ্য কিছু ছিল। সে বিষের জন্যে এ হোটেলের ব্যবস্থা বা লোকজন দায়ী নয়। তার অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে নাকি যে আমাদের খাবারে বা ড্রিংকে আমাদের পার্টির কেউই বিষ মিশিয়েছে? কিন্তু পার্টির চারজনই আমরা যে অসুস্থ সেটা হিসেবে ধরেছেন?”
“মিস এলসার অসুস্থ হওয়ার খবর অবশ্য আমি এখনো পাইনি।” জানালে মিঃ সেঙ্গার।
“খবর না পেলেই তিনি সুস্থ মনে করার কোনো কারণ নেই।”
ম্যানেজারের মন্তব্যটা সংশোধন করলে বারোহা, “মিস এলসার কোনো খবর না পাওয়া ত আরো ভাবনার ব্যাপার বলে আমার মনে হচ্ছে। তিনি হয়ত আমাদের চেয়ে বেশী অসুস্থ বলে কোনো খবর দিতেও পারেন নি?”
“না, তিনি অসুস্থ নন।” বাধ্য হয়েই প্রতিবাদ জানালাম।
“অসুস্থ নয়। আপনি কি করে জানলেন।” একটু সন্দিগ্ধ ভাবেই জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
“জানলাম, আমি তাঁকে সুস্থ শরীরে ওপরের ল্যাণ্ডিং-এ নিচে নামবার লিফটের জন্যে অপেক্ষা করতে দেখেছি বলে।”
“সেই অত সকালে আপনি নিজের কামরায় যাবার সময় তাঁকে ল্যাণ্ডিং-এ দেখেছেন!” মিঃ সেঙ্গার সবিস্ময়ে বললেন, “কিন্তু মিস এলসা ত সে লিফটে নিচে নামেন নি। আমি আর মিঃ বর্মা ঐ লিফটে ওপরে আসব বলেই অপেক্ষা করছিলাম। লিফট ত কোথাও না থেমে সোজা নিচে নেমে এসেছে।”
তাহেল তিনি বোধহয় কিছু ভেবে তাঁর কামরাতেই আবার ফিরে গেছেন! বারোহা বললে, “তার কারমায় একবার ফোন করে দেখলে ত পারেন।”
“হ্যাঁ, তাই করুন।” বললে পরাশর, “নম্বর ত চারশ’ পঁচিশ।”

চারশ’ পঁচিশ শুনে মনে মনে একটু চমকালাম। পঁচিশ মানে একেবারে আমার পাশের কামরা। আমাকে ঠিক ছাব্বিশ নম্বরেই ঘর দেবার মধ্যে সেদিক দিয়ে কোনো অর্থ আছে নাকি?
মিঃ সেঙ্গার তখন এলসার ঘরে ডায়াল করে কোনো সাড়াই কিন্তু পাচ্ছেন না। ফোনটা ধরে রেখেই তিনি আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “এ তো শুধু রিং-ই হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না।”
“তাহলে মিঃ ভদ্র আর কাউকে দেখে এলসা মনে করে ভুল করেননি ত?” সন্দেহ প্রকাশ করলে বারোহা।
“না, সে-ভুল হওয়াও সম্ভব নয়,” বললেন ম্যানেজার, “ফ্লোরে এলসার বয়স বা চেহারার কোনো মেয়েই নেই।”

লিফটের জন্যে ল্যাণ্ডিং-এ দাঁড়িয়ে থাকলেও কোন কারণে হয়ত তখন না গিয়ে এলসা পরে নেমে গেছে মনে করে নিচের রিসেপশন কাউণ্টারে খোঁজ নেওয়া হল এর পর। না, মিস এলসা নিচে নামেই নি বলে সেখান থেকে জানা গেল।
“তাহলে তার কামরাতেই খোঁজ করতে যেতে হয়।” উদ্বিগ্ন হয়ে বললে বারোহা।
“তা যাওয়া যাবেখন, পরে।” বললে পরাশর, “আপাততঃ উপরের তলায় একবার ফোন করে দেখুন ত মিঃ সেঙ্গার।”
“ওপরের তলায় ফোন করে দেখব,” ম্যানেজার বেশ অবাক, “সে কি!”
“নিচে না নেমে থাকলে ওপরে গেছে ভাবাই স্বাভাবিক নয় কি!” পরাশরের গলায় একটু যেন প্রচ্ছ্ন্ন কৌতুক।
“কিন্তু ওপরতলায় ফোন করা হবে কাকে।” জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
“র‍্যাথবোনদেরই ফোন করে দেখুন।” নির্দেশ দিলে পরাশর।
“র‍্যাথবোনদের?” বারোহার গলায় তার অবিশ্বাসের সুরটা অস্পষ্ট রইল না। কিন্তু র‍্যাথবোনদের কামরাতেই এলসার খবর পাওয়া গেল। সে কিচ্ছুক্ষণ আগে ও-কামরাতেই গেছে। এই মিনিট দুযেক হল নিজের কামরয় নেমে গেছে।
“মিস এলসার হঠাৎ র‍্যাথবোনদের ঘরে যাবার মানে।” ভুরু কুঁচকে নিজের বিমূঢ়তাটা বুঝিয়ে বারোহা এবার সোজাসুজি পরাশরকেই চেপে ধরতে চাইল, “কিন্তু আপনি সবকিছু জড়িয়ে যে রকম একটা শয়তানী ষড়যন্ত্র কল্পনা করছেন, এই সবেমাত্র দিল্লীর ঐ শোভরাজের দল ধরা পড়ার পর নেহাৎ গবেট ছাড়া কারুর পক্ষে সেরকম কিছু করা কি সম্ভব? খবরের কাগজে কাগজে এখনো ত সে দলের নানা খবর বার হচ্ছে। কি করে তারা ট্যুরিস্ট সেজে নিরীহ সরল অন্য ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের বিষ দিয়ে অজ্ঞান কে যথাসর্বস্ব লুট করত সে বিবরণ ত এখন কারুর অজানা নয়। সদ্য সদ্য ঐ ঘটনার পর ঐ এক প্যাঁচ দিয়ে বাজিমাৎ করার কথা কোনো আহাম্মকও নিশ্চয় ভাববে না।”
“আহাম্মকেরা পারবে না বলেই অতি বুদ্ধিমানেরা ভাববে।” পরাশর তার নিজস্ব ব্য্খ্যা শোনালে, “সাধারণের পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত বলেই এই সময়টা তারা বেছে নেবে একই প্যাঁচ খাটাবার জন্যে।”
“না। আমায় মাপ করবেন মিঃ বর্মা,” নিজের মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে বললে বারোহা। “আমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।”
“বোঝবার চেষ্টা এখন তাহলে করবেন না।” পরাশর উপদেশের সুরেই বললে, “আপনি শুধু একটু সাবধানে থাকবেন।”
“আমি সাবধানে থাকব।” পরাশরের কথায় বারোহা আমাদের মতই হতভম্ব, “আমারও এখনো ভয়ের কিছু আছে নাকি? কাল রাত্রের ব্যাপারেও তা কেটে যায় নি?”
“না, মিঃ বারোহা!” বেশ গম্ভীর হয়েই জানালে পরাশর, “আপনার আসল বিপদ এইবারেই আসছে। আর র্যা থবোনদের চেয়েও তা অনেক গুরুতর।”
“বলেন কি?” বারোহার মুখ দেখে মনে হল পরাশরের কথাটা ঠাট্টা না সত্যি সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। হেসে উঠবে না ভয় পাবে ঠিক করতে পারছে না তাই।

বারোহার এ প্রতিক্রিয়াটা পরাশর লক্ষ্য করল কিনা বুঝতে পারলাম না। ম্যানেজারের দিকে ফিরে সে তখন তাঁকে আরেকবার এলসার ঘরে ফোন করতে বলছে।
“আবার মিস এলসার ঘরে!” ম্যানেজার একটু আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলেন কিন্তু পরাশর সে আপত্তি খণ্ডন করে বললে, “এতক্ষনে মিস এলসা নিজের ঘরেই ফিরেছেন বলে মনে হচ্ছে। ওঁকে ফোন করে শুধু বলুন যে বিশেষ একটা জরুরী প্রয়োজেনে আপনি দুজন সঙ্গীকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে চান।”
“দেখা করতে যদি না চান?” রিসিভারটা তুলে ধরেও ডায়াল করবার আগে ম্যানেজার তাঁর সন্দেহটা জানালেন।
“আপত্তি করলে ভিন্ন ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আপত্তি করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।” আশ্বাস দিলে পরাশর।

পরাশরের আশ্বাস মতই এলসাকে ফোন করলেন ম্যানেজার। হঠাৎ তাঁর মুখে হিন্দী শুনে প্রথমটা অবাক হবার পরই মনে পড়ল এলসা ইংরেজী জানে না। ফোনে ম্যানেজারের কথা থেকে বোঝা গেল পরাশরের অনুমানই ঠিক। এলসা দেখা করতে আপত্তি জানাল না, একনকি দেখা করার উদ্দেশ্য বা ম্যানেজারের সঙ্গীদেরও নামও জানতে চাইল না।
এলসার কামরাতেই এবার গেলাম, যাবার আগে কামরা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বারোহা শুধু একটু ক্ষুণ্ণ স্বরে জানালে, “আপনাদের সঙ্গে আমিও যদি থাকতে পারতাম।”
“তার জন্যে দুঃখ করবেন না।” তাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেল পরাশর। “যা যা কথা ওখানে হবে সব আপনি আমার বা মিঃ ভদ্রের মুখে জানতে পারবেন। অচ্ছা শেষবার বলে যচ্ছি সাবধানে থাকবেন!”

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ১০

দশ

এবারে লিফট দিয়েই উঠে এলসার ঘরে পৌঁছোবার পর তার দরজায় বেল টিপতে হল না। দরজা খুলে এলসা নিজেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
ম্যানেজারের সঙ্গে আমাদের দেখে মুখে তার কোনো ভাবান্তর কিন্তু দেখা গেল না। ম্যানেজার দরজা থেকেই আমাদের পরিচয় দেওয়া শুরু করেছিল। এলসার কামরায় গিয়ে বসবার পর ম্যানেজার হঠাৎ হিন্দী ছেড়ে ফরাসী ধরায় প্রথমটা বেশ চমকেই গেলাম। তারপর ম্যানেজারের এ ভাষা বদলের মানেটা অস্পষ্ট রইল না।

ফরাসী আমি জানি না। তবে বলতে বা লিখতে না পারলেও দু’চারটে কথা একটু আধটু জানা আছে। ম্যানেজারের ফরাসীতে দখল আমার চেয়ে খুব বেশী নয়। তিনি কোনোরকমে ভুল ভাল শব্দ যা বোঝাবার চেষ্টা করলেন সেটা হল এই যে আমরা কোথা থেকে উড়ে আসা এক গা-জ্বালানো উপদ্রব। হোটেলের একটা সামান্য গোলমালের কথা কেমন করে জেনে ফেলে এখন জুলুম করে মাতব্বরি করছি। হোটেলের সুনামের খাতিরে আমাদের অত্যাচার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে। সেই জন্যেই বাধ্য হয়ে আমাদের আবদার শুনে এ সময়ে এঘরে আমাদের আসতে হয়েছে। মিস এলসা এ ত্রুটি যেন ক্ষমা করেন।

এলসা যেরকম নির্বিকার মুখ করে আমাদের দিকে একবারও না তাকিয়ে এসব কথা শুনে গেল ও তারপর একটু হাসি মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার উদ্দেশ্যে জানতে চাইল তাতে তার অভিনয় ক্ষমতারও তারিফ না করে পারলাম না।
এলসার হাসিমুখের প্রশ্নের উত্তরে পরাশর বেশ একটু নীরস গলায় যা বলল তাতে কিন্তু আমি রীতিমত স্তম্ভিত।
কোনোরকম ভণিতা না করে সে বললে, “হিন্দী, ফরাসী হয়েছে এবার সাধু বাংলায় আমাদের উদ্দেশ্যটা শুনুন। উদ্দেশ্যটা, আপনাকে এখনি এ হোটেল শুধু নয় এ দেশই ছেড়ে যেতে অনুরোধ করা।”

একথাতেও এলসার মুখের হাসি একটু মুছেও গেল না। আগের মতই প্রসন্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করলে, “এ অনুরোধের কারণ নিশ্চয় আছে?”
“তা আছে বইকি।” পরাশর গম্ভীর হয়েই বললে, “সেগুলো কি আপনি শুনতে চান?”
“হ্যাঁ, শুনলে নিজের সম্বন্ধে একটু জ্ঞান লাভ হতে পারে।”
“তাহলে এক এক করে শুনুন,” – পরাশর যেন আঙ্গুল গুনে বলতে আরম্ভ করলে, “আপনি ভারতীয় পুরাতত্ত্বের ছাত্রী নন, এলসা আপনার নাম নয়, আর্জেণ্টিনা থেকে আপনি আসেন নি।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান!” এলসা কথার মধ্যেই বাধা দিয়ে বললে, “আপনাদের পরিচয়ের ফিরিস্তি বেশ লম্বা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এসব কথা শোনাবার অধিকার আপনার কি যদি জিজ্ঞাসা করি?”
“তাহলে আপনাকে সোজা আমাদের সঙ্গে এখানকার হেড কোয়ার্টার্সে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।” পরাশর একটু কড়া গলাতেই বললে, “সেটা চাই না বলেই আপনাকে নিজর মান নিয়ে আগে থাকতে সরে পড়বার সুযোগ দিচ্ছি।”
“অনেক ধন্যবাদ!” এলসা হেসেই বললে, “তবে আমার প্রতি এই বিশেষ অনুগ্রহ কেন, সেটাও ত জানতে ইচ্ছে করে!”
“ধরুন, ধরুন…” পরাশরকে এবার জবাব দিতে থতমত খেতে দেখে উত্তরটা আমারই দিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল বলি, “অনুগ্রহের কারণ অসময়ে অপাত্রে একটু দুর্বলতা, এটা বুঝতে পারছেন না?”

আমার কিছু বলা হল না, পরাশরেরও তাই তোৎলামি সারলো না। তার আগে ম্যানেজার মিঃ সেঙ্গারই স্পষ্ট বিরক্তির সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠলেন। কথা বাঙ্গলা বোঝা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হলেও, কিছু কিছু শব্দ আর পরাশরের কথা বলার ভঙ্গি মানে তাঁর কাছে খুব অস্পষ্ট থাকে নি। পরাশর বিরূপ হতে পারে জেনেও, তাতে তিনি নিজের অধৈর্যটা গোপন করবার চেষ্টা না করে বললেন, “সকাল থেকে হোটেলের কাজ-কর্ম কিছুই আমার দেখা হয় নি। আপনাদের যা বলবার যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে মিস এলসাকে আর বিরক্ত না করে আমরা যেতে পারি।”
“না, না আপনি নারাজ হবেন না মিঃ সেঙ্গার!” পরাশর কিছু বলার আগে এলসাই আমাদের অবাক করে জানালে, “এঁরা আমার বন্ধু লোক। আপনার কাজ থাকলে মিছিমিছি আর আপনাকে আটকে রাখব না।”
“এঁরা বন্ধুলোক!” উচ্চারিত ভাষায় না হলেও মুখের ভাবে এই বিমূঢ় বিস্ময়টুকু পুরোপুরি ফুটিযে ম্যানেজার হতভম্বের মত চলে যাবার পর, পরাশরই প্রথমে মুখ খুলল। তার গলার স্বর কিন্তু আগের মতই রুক্ষ। জিজ্ঞাসা করলে, “আমরা যখন বন্ধুলোক তখন কালকের পার্টির রহস্যটা এবার একটু ভাঙবেন?”
“পার্টির রহস্য! পার্টির আবার রহস্য কি অছে? চারজনের একটু খেয়াল হয়েছিল তাই একসঙ্গে খেয়ে দেয়ে একটু আনন্দ করেছি।”
“আনন্দ করেছেন? আনন্দের পরিণাম কি হয়েছে তা কিছু জানেন? জানেন যে আপনি ছাড়া অপর তিনজন রাত্রে বেশ অসুস্থ আর অল্প বিস্তর বেহুঁশ হয়ে গিযেছিল।”
“তাই নাকি!” এলসা যেন অবাক, “আশ্চর্য! কই আমার ত কিছু হয় নি।”
“এই কিছু না হওয়াতা আশ্চর্য শুধু নয়, আরও কিছু।”
“আরো কিছু!” এলসা ভুরু কোঁচকালে, “আরো কি?”
“রীতিমত সন্দেহজনক।”
এলসা এ কথায় কি বলতে যাচ্ছিল পরাশর তাকে হাত তুলে থাম্যে বললে, “শুনুন মিস এলসা। মিছে কথা কাটাকাটি করে কোনো লাভ আর নেই। আপনার সম্বন্ধে যা কিছু জানবার আমাদের জানা হয়ে গেছে। অভিযোগের ফিরিস্তি আপনার বিরুদ্ধে সত্যিই অত্যন্ত লম্বা, সেগুলি মুখে বলার সময় না নিয়ে কাগজে এই লিখে এনেছি।”
পকেট থেকে সত্যিই একটা লম্বা খাম বার করে এলসার হাতে দিয়ে পরাশর বললে, “ধীরে সুস্থে এতা পড়বার সুযোগ খানিক বাদেই আপনাকে দেবো। তার আগে আপনার কামরাটা একটু সার্চ করতে চাই।”
“সার্চ করবেন আমার ঘর!” এলসা যেন অবাক, “সার্চ করবার তল্লাসী পরোয়ানা এনেছেন?”
“আপনার মত মেয়ের ঘর তল্লাস করবার জন্যে সার্চ ওয়ারেণ্ট লাগে না।” পরাশর তাচ্ছিল্যভরে বললে, “তাছাড়া আমি শুধু আপনার এ কামরায় দেরাজ আলমারীগুলো দেখব। লুকোবার মত কিছু থাকলে আপনি তা সরিয়ে রাখতে পারেন।”
“না, সরিয়ে রাখবার আমার কিছু নেই। আপনি ইচ্ছে করলে সমস্ত কামরাই খুঁজে দেখতে পারেন।” রেগে উঠেই যেন এলসা ঢালাও স্বাধীনতা দিলে পরাশরকে।

পরাশর কিন্তু সারা ঘর তল্লাসী করল না। এমন কি দেরাজ আলমারীও খুলল না। তার বদলে প্রথমেই কামরার ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে প্রসাধনের জিনিষের বিভিন্ন কৌটো আর জার নাড়তে নাড়তে একটি ছোট শিশি তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলে, “এটা কি?”
“পরীক্ষা করলেই যখন জানতে পারবেন, তখন লুকিয়ে লাভ নেই।” বললে এলসা, “ওটা বিষ।”
“কি রকম বিষ। মানুষ মারা যায়?”
“তা মাত্রা বেশী হলে তাও যেতে পারে।” এলসা স্বীকার করলে, “তবে সাধারণ মাত্রায় কিছুক্ষণের জন্যে অজ্ঞান করে দেয় মাত্র।”
“আপনার অকপটতার জন্যে ধনবাদ।” পরাশর যেন ব্যঙ্গ করল, “আপনার বুদ্ধিকেও তারিফ। গোপন কোথাও না রেখে চোখের ওপর রেখে লুকোবার সবচেয়ে চতুর ব্যবস্থা করেছেন।”
“প্রশংসা আপনাকেও ফিরিয়ে দিচ্ছি,” এলসার গলার স্বরও একটু বাঁকা, “অন্য কোথাও না খুঁজে প্রথমেই যে খোলা জায়গায় নজর দিযেছেন সেটা আপনার বাহাদুরী।”
“আচ্ছা এসব তারিফের লেনদেন এখন থাক,” পরাশর ড্রেসিং টেবিলেরই একটা দেরাজ খুলে বললে, “আপনার এ ড্রয়ারের এই ছোট অ্যালবামটাও দামী মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ, ওটাতে খুব বিরল কিছু ছবি আছে।”
“তাহলে ওটাও আমার নিতে হবে।” পরাশর অম্লান বদনে বললে, “তবে এখন নেবার দরকার নেই। তার কারণ আমরা আজ রাত্রে এই কামরাতেই থাকছি।”
“এই কামরাতে আমার সঙ্গে থাকছেন!” এলসার গলাটা বিমূড়তাতেই যেন তেমন তীক্ষ্ণ হতে পারল না।
“না, আপনার সঙ্গে নয়।” পরাশর ব্যাখ্যা করলে, “আজ রাতটা কামরা বদল করে আপনাকে আমার বন্ধু কৃত্তিবাসের ঘরেই থাকতে হবে।”
“না, আমি তা থাকব না।” এলসা ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানালে।
“না থাকতে চাইলে আপনাকে এখনই অনেক বিশ্রী জবাবদিহির দায়ে পড়তে হবে। তার চেয়ে বিনা ঝামেলায় ঘরটা বদল করাই ভালো নয়কি?”
“এ আপনাদের অন্যায় জুলুম!” নিরুপায় বলেই এলসার গলাটা কেমন করুণ শোনালো।
“এ জুলুম না করে আমাদের উপায় কি?” প্রায় নির্মম ভাবেই বললে পরাশর, “আপনার বন্ধু সহায় সাথী কে বা কারা, আজ আশা করি জানতে পারব।”

আমার কাছ থেকে ঘরের চাবিটা নিয়ে এলসাকে দিয়ে পরাশর আবার বললে, “পালাবার চেষ্টা আপনি করবেন না জানি। তবু শুনে রাখুন, এ হোটেলের চারিধারে ত বটেই এখান থেকে যাবার আসবার সমস্ত রাস্তাই আজ আমাদের নজরবন্দী। নেহাৎ ইঁদুর বেড়াল না থাকলে সে পাহারা এড়িয়ে যেতে পারবেন না।”
এবার কোনো উত্তর না দিয়ে দেরাজ আলমারী থেকে কয়েকতা তার নিতান্ত দরকারী জিনিস একটা হ্যাণ্ড ব্যাগে ভরে এলসা চলে যাবার পর পরাশর আমার দিকে ফিরে বললে, “আজ রাতটা জেগে কাটাবার জন্যেই তৈরী থাকো। বারোহাকে যে কথা দিয়েছিলাম তা রেখেই আমি আসছি।”

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ১১ (শেষ)

এগার

নাটকের যবনিকা সে রাত্রেই পড়ল। ঘুম কাটাবার জন্যে ক্যানটিন থেকে কড়া কফি আনিয়ে খেয়ে টেবিল ল্যাম্পের পাশে একটা ডিভানে শুয়ে এলসার কামরাতেই পাওয়া একটা ডিটেকটিভ নভেল পড়বার চেষ্টা করছিলাম। এ সব সময়ে পরাশরের কবিতা লেখার কথা। কিন্তু সে চেষ্টা না করে সে পাশের অন্য টেবিলে বসে এলসার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারী পাওয়া অ্যালবামটা একটু যেন অতিরিক্ত মন দিয়ে দেখছিল। রাত তখন বারোটা বাজে। এয়ারকণ্ডিশনারের মৃদু আওয়াজ ছাড়া ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ পরাশর অ্যালবাম রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের সব কটা বাতি নিভিযে দিলে। পরাশরের কান আমার চেয়ে খাড়া। বুঝলাম সে নিশ্চয় সন্দেহজনক কোন শব্দ বাইরে পেয়েছে। সেই অনুমানটা ঠিক। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই ঘরের দরজায় মৃদু টোকা শোনা গেল। সেই সঙ্গে দেখা গেল দরজার তলা দিয়ে লম্বা একটা চিরকুট কাগজ কে ঠেলে দিচ্ছে কাগজটা টেনে নেবার পর পরাশরের টর্চের আলোয় সেটা তার সঙ্গে পড়লাম। তাতে অত্যন্ত জড়ানো হাতে লেখা, “আমি দারুণ বিপদ মাথায় নিয়ে তোমাকে দুটো কথা জানাতে এসেছি। দরজাটা খুলে আমায় দু মিনিটের জন্যে ভেতরে যেতে দাও।”
ওপরে যেমন সম্বোধন নেই নিচে তেমনি কোনো সই নেই। এ কার হাতের লেখা! দরজার বাইরে কে? আমি রীতিমত ভাবিত হলেও পরাশর বিনা দ্বিধায় দরজাটা খুলে দিলে।আলোটা অবশ্য না জ্বেলেই। দরজা খুলে দিতে যে ঘরে ঢুকল করিডরের আলোতে তার কাঠামোটা দেখেই বারোহা বলে চিনলাম। বারোহা অন্ধকার দেখে একটু দ্বিধাভরেই ঘরে ঢুকে বললে, “ঘরটা অন্ধকার কেন এলসা? আলোটা জ্বালো।”
পরাশর আলোটা জ্বালল সেই মুহূর্তেই। এলসার বদলে আমাদের দুজনকে দেখে বারোহার অবস্থা তখন বেশ কাহিল। নিজেকে সামলাবার অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও একটু ধরা গলায় শুধু বলতে পারলে, “আপনারা! এ ঘরে?”
“হ্যাঁ, আমরাই।” পরাশর ঐ সাড়ে ছ’ফুট লম্বা মানুষটাকে যেন নাবালক হিসেবে দেখে ব্যঙ্গের সুরে বললে, “তা এ ঘরে এত রাত্রে কেন এসেছেন? এলসার সঙ্গে গোপন অভিসারের মতলবে?”
“না, না। আমায় বিশ্বাস করুন,” বারোহা কাতর প্রতিবাদ জানালে।” এলসার সঙ্গে আমার সে-রকম সম্বন্ধ নয়। আমি শুধু…”
ঐ পর্যন্ত বলে বারোহা একটু থামতেই পরাশর যেন ঠেলা দিয়ে বললে, “আমি শুধু বলে থামলেন কেন? আমি শুধু, কি বলতে যাচ্ছিলেন?”
“বলতে যচ্ছিলাম যে – আপনারা আমাকে সন্ধ্যাবেলা যা বলে এসেছিলেন তা শুনে আমি সত্যি, মিস এলসার জন্যে ভাবিত হয়ে পড়েছিলাম। তাই লুকিয়ে ওকে একটু সাবধান করে দিতে এসেছিলাম।”
“সাবধান করতে এসেছিলেন না আপনার চিরশত্রুর হদিশ পেয়ে তাকে শেষ করতে!” পরাশর কড়া গলায় বললে, “কিন্তু কি আজ আপনাকে সকালে বলে দিলাম? বলেছিলাম না যে আপনার মাথার ওপর একটা মস্ত বিপদের ফাঁড়া ঝুলছে! এমন করে এ ঘরে এসে সে বিপদ এখন ত সঙ্গীন করে তুলেছেন।”
“সঙ্গীন করে তুলেছি!” বারোহা হতাশ স্বরে বললে, “কিন্তু আপনারা থাকতে এ ঘরে আমার বিপদ হবে কেন? আপনারা আমায় রক্ষা করবেন না।”
“বিপদ আপনার যে নিজের ডাকা!” পরাশর নির্মমভাবে বললে, “তার আমরা রক্ষা করব কি করে।”
যে অ্যালবামটা খানিক আগে সে দেখছিল সেইটে বারোহার হাতে উলে দিয়ে পরাশর আবার বললে, “দেখুন দেখি এ ছবিগুলো চিনতে পারেন?”
বারোহা অ্যালবামটা খুলে ছবিগুলো তাচ্ছিল্যভাবে একটু দেখেই সেটা মুড়ে ফেলে বললে, “হ্যাঁ পারি – । এগুলো আমারই ছবি। কিন্তু তাতে কি বলতে চান কি?”
কথাটা শুনে শুধু নয় – গলার স্বরটাতেও আমি যেন চমকে উঠলাম। সেই বারোহাই আমাদের সামনে অ্যালবাম হাতে বসে আছে। কিন্তু গলার আওয়াজ থেকে মুখের ভাব ও দেহের ভঙ্গিতে এ যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
পরাশরেরও এ চমকটা লাগল কি না জানি না – কিন্তু তার কথায় সেটা প্রকাশ পেল না।
আগের মতই চাপা বিদ্রুপের সুরে সে বললে, “বলতে চাই এই যে – অতি বুদ্ধিমান হওয়ার বিপদ এক্টু বেশী। এই সেদিন দিল্লীতে চার্লস শোভরাজের দল ধরা পড়ার পরই ও জাতীয় শয়তানী আবার হওয়া সম্বন্ধে কেউ সাবধান থাকবে না ধরে নিয়ে তুমি খুব চতুর ফাঁদই এখানে পেতেছিলে। প্রথমে নিজেই যেন বিষের শিকার হয়েছে। এমনভাবে ড্রেস রিহার্সাল দিয়ে জমিটা ভালোভাবে তৈরী করে নিয়েছিলে। তোমার লক্ষ্য র্যা থবোন – এরা ছিল না। ওদের নাম আমি তোমায় একটু ধোঁকা দেবার জন্যই করেছিলাম। তোমার আসল লক্ষ্য হল মঁসিয়ে রেনোয়া। প্রচুর দামী জিনিস নিয়ে ঘোরা তার এক বদরোগ। এ হোটেলে তাঁকে বধ করাবার জন্যেই তুমি জাল পেতে বসেছিলে। একটা কথা শুধু তুমি ভুলে গেছলে যে – ডালে ডালে যারা চরে তাদের ওপরেও পাতায় পাতায় চরবার মানুষও আছে।”
“আর সেই পাতায় পাতায় যার চরে – তাদের মরণ হয়, অতিবুদ্ধির অহঙ্কারে।”
একেবারে চাবুকমারা গলায় কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে পিস্তল বার করে বারোহা ঘরের বালবের দিকে ছুঁড়ে সেটা ফাটিয়ে দিলে।
তারপর গাঢ় অন্ধকারে তার হিংস্র শাসানি শোনা গেল, “আমি এখন ঘর থেকে বেরিয়ে যচ্ছি। কেউ বাধা দিতে চেষ্টা করলে মশা মাছি মারার দ্বিধাটুকুও আমি যে করব না এইটুকু শুধু জানিয়ে যচ্ছি। যে যেখানে আছ সেখান থেকে এক পা নড়বে না।”

“এই হুকুমটা তোমার ওপরও রইল।”
হঠাৎ তীব্র একটা চোখ-ধাঁদানো জোরালো টর্চের আলো বারোহার ঠিক মুখের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে এই কথাগুলো শুনতে পেলাম। কথাগুলো একটি মেয়ের গলার – আর সে মেয়ে যে এলসা তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পরাশর কামরার অন্য একটা আলো জ্বেলে দেওয়ায় তা বুঝতে পারলাম। এলসার এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে বারোহার ঠিক কপাল লক্ষ্য করে উঁচিয়ে ধরা পিস্তল।
এলসা শুধু একা নয় তার সামনে আর একটা যে মেয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে মঁসিয়ে রেনোয়া-র ভাগনী বলেই চিনলাম।
আলো জ্বলবার পরই আবার কড়া আদেশ শোনা গেল, “তোমার পিস্তল ফেলে দাও বারোহা। তুমি যত বড় লক্ষভেদীই হও, তুমি জানো যে তোমার হাত ঘুরিয়ে পিস্তল ছোঁড়ার আগেই তোমার মাথার ঘিলু এই কার্পেটকে নোংরা করে দেবে। ফেলো পিস্তলটা।”
বারোহা দুচোখে অগ্নি বৃষ্টি করেও পিস্তল ফেলে দিতে এবার বাধ্য হল।
জিনেৎকে টর্চ ধরা হাতে ঘৃণাভরে বারোহার দিকে ঠেলে দিয়ে এলসা এবার বললে, “এই নাও তোমার যোগ্য সহচরীকে বুড়ো লম্পট মঁসিয়ে রেনোয়াকে কাবু করবার জন্যে ভাগনী বলে সেবাদাসী করে নিজেই যাকে তুমি জুটিয়ে দিয়েছেলে।”

এ নাটক দেখতে দেখতে সত্যি তখন আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। পরাশরের কথায় আমার চমক ভাঙল। বারোহার ফেলে দেওয়া পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে সে আমায় বললে, “সাবধানের মার নেই। আর কিছু না পাও ওপর থেকে মিস এলসার স্কার্ফ টার্ফ কিছু এনে গুণধরের হাত দুটো একটু বেঁধে ফেলো দিকি।”
পাশের ঘরে বাঁধবার কিছু খোঁজবার জন্যে যেতে যেতে একটা কথা শুধু না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। “আচ্ছা মিস এলসার রহস্যটা দু কথায় একটু বলবে? উনি কি আমাদেরই আরক্ষী বাহিনীর কেউ? তুমি কি ওকে চিনতে?”
এলসা হাসল, আর সংক্ষেপেই উত্তর দিলে পরাশর, “না, উনি ইণ্টারপোল।”
বিশ্ব পুলিশ সংস্থার একজন বড় গোয়েন্দা। প্রায় দু বছর ধরে নানা দেশে নানা বেশে বারোহাকে চোখে চোখে রেখে যাকে বলে রাঙা হাতে ধরবার জন্যে পেছনে লেগে আছেন। আর তাঁকে চেনার কথা জিজ্ঞাসা করছ? ওঁকে চিনতে দেরী হয়েছে বলেই এ ব্যাপারটা এতদূর গড়াতে পেরেছে।

পাঁচতারা হোটেলের সব ঝামেলা চুকে তুকে যাবার পর পরাশরের সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করতে করতে একদিন জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজের কথা জানতে চেয়েছিলাম। পরাশর হেসে বলেছিল, “আরে উনিই ত চর চরাবার চাঁই। জ্যোতিষ সেজে দেশী বিদেশীদের পেটের খবর বার করে আমাদের জন্যে জমা করে রাখেন। এরপর একটু ধোঁকায় ধাঁধায় পড়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আচ্ছা, তোমাদের এই আন্তর্জাতিক ঠগ ধরার ব্যাপারে আমাকে অমন ধড়াচূড়া পরিয়ে নিয়ে গেছলে কেন বলো ত? আমি তোমাদের কোন কাজে ত লাগিনি!”
“বাঃ, তোমায় না নিয়ে গেলে এ বৃত্তান্তের কথক হত কে! আমি কি আবার নিজের জবানীর দায়ে পড়ব নাকি!”
বন্ধু বাৎসল্য এরপর আর রাখা যায়!

শেষ

Exit mobile version