কাগজের ফালিটা যেভাবে তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে, তাতে একদিকে একটা ছবির খানিকটা অংশ কাটা অবস্থায় থেকে গেছে। ছবিটা একটি বিদেশী মেয়ের, ছবিটা শুধু নয় তার নিচের লেখা নামের অংশটুকুও মাথার মধ্যে কোথায় যেন অস্পষ্ট টনক নড়লো। নামটায় যতটুকু ওখানে পাওয়া গেছে তা হল, — বারবারা চেরিল … কোথায় দেখেছি এ ছবিটা? কোথায় পেয়েছি এ নাম? কোন পত্রিকা পাতাটা ছেঁড়া হয়েছে তাও যদি বুঝতে পারা যেত। সে পত্রিকা বা অন্য যেখানেই গোক ও ছবি আর নাম আমার যে চোখে পড়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। শুধু তাই নয় ছবিটা আর ঐ নামের সঙ্গে একটা কি খুব অসাধারণ ব্যাপারও জড়িত হয়ে অছে। সেটা কি মনে করবার চেষ্টায়, পরাশরের ওপর অভিমানটাও খানিক বাদে যেন চাপা পড়ে গেল। পরাশরকে কি তার বাসার কোন পত্রিকা থেকে ছবির অংশটা ছিঁড়েছে জিজ্ঞাসা করব? না, সেটা এখন আর সম্ভব নয়। সে কথা জিজ্ঞাসা করতে গেলে পরাশরের এই লেখাটুকুর শোধ আর নেওয়া হবে না। না, অমি নিজে নিজেই ও ছবিটা কি সূত্রে কোথায় দেহেছি তা ভেবে বার করব। যে পর্যন্ত তা না পারি নিজে থেকে পরাশরের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখব না।
বার করতে ঠিকই পারলাম শেষ পর্যন্ত। তবে সেদিন নয়। তার পরের দিন সকালবেলা আচমকা নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। সমাধানটা যখন হয তখন আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবনায় একেবারে অস্থির হয়ে আছি। কারণ তার কিছুক্ষণ আগে ভোরের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে পরাশরের কাছ থেকে অদ্ভুত বেয়াড়া এক ফোন পেয়েছি।
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৬
ছয়
ফোনে একেবার তড়িঘড়ি ডাক।
“কৃত্তিবাস! শোনো এখুনি একবার আমার সঙ্গে বেরুতে হবে। তৈরী হয়ে নাও।”
“এখুনি যেতে হবে মানে? কোথায় যেতে হবে? কেন?”
সে সব কথার কোন উত্তর নেই। শুধু আগের চেয়ে আরো একটু অস্থির গলায় পরাশর জানালে, “আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমার ওখানে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।”
“শোনো শোনো!” ফোনে যথাসাধ্য চিৎকার করলাম। কিন্তু শুনবে কে? নিজের কথাটুকু বলেই পরাশর ফোন নামিয়ে দিয়েছে।
এখন আমি করি কি? কেন, কি বৃত্তান্ত কিছুই না জেনে পরাশরের্ জন্যে তৈরী হয়ে বসে থাকব? সমস্ত মন বিদ্রোহ করে উঠতে পারে কিনা এতে! মানলাম ব্যাপারটা হয়ত দারুণ জরুরী। নষ্ট করার এতটুকু সময় নেই। কিন্তু কোথায় যেতে হবে এই দুটো কথার জন্যে দু সেকেণ্ড দেরী করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয় যেত! এ রকম অন্যায় আবদারে কিছুতেই সায় দেওয়া উচিত নয়। জামা-কাপড় বদলে বেরুবার জন্যে তৈরী হতে হতেই অবশ্য এসব কথা ভাবছিলাম। পরাশরের ওপর রাগ অভিমান যতই থাক নিজের একটু কৌতূহলও ছিল। হঠাৎ কি এমন ব্যাপার হল যাতে এক্ষুণি আমাদের ছুটে যাওয়া দরকার! সত্যিই গুরুতর কিছু না হলে পরাশর অত অস্থির হয় না। সে গুরুতর ব্যাপারটা কি নিয়ে কোথায় হওয়া সম্ভব? কাল আমরা সকালে যাদের সঙ্গে কাটিয়েছি ব্যাপারটা কি তাদের সঙ্গেই জড়িত? না, সম্পূর্ণ নতুন কিছু ঘটনা?
সত্যি কথা বলতে হলে স্বীকার করতেই হয় যে বেরুবার জন্যে তৈরী হতে হতে ক্রমশঃই ব্যাপারটা জানবার জন্যে আরো অধীর হয়ে উঠছিলাম। পরাশরের আসার জন্যে আর তর সইছিল না। সে আধঘণ্টার মধ্যে অসবে বলেছে। কিন্তু আধঘণ্টাটাই আমার কাছে বড় বেশী দেরী মনে হচ্ছে তখন। পরাশরের ওপর গোড়ায় রাগ অভিমান যা করেছি তা তখন সম্পূর্ণভাবেই কেটে গেছে। বরং পরাশর তার নিজমূর্তি ধরেছে বলে তখন খুশিই হয়েছি। কাল কেন কি মতলবে সে অমন চুপ মেরে ছিল এখনও জানি না। তবে সেটা তার প্রেমে গদগদ ভাব ভাবার মত আহাম্মক হবর জন্যে আমিই এখন লজ্জিত। সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লেও পরাশরের অমন অবস্থা হবে কেন? তার ঐ ভোম মেরে থাকার পেছনে অন্য কোনো একটা রহস্য নিশ্চয় আছে আর আজকের এই অস্থিরতা নিশ্চয় সেই রহস্যের সঙ্গে জড়িত। যাক হাতে পাঁজি মঙ্গলবার থাকতে মিছে এত জল্পনা কল্পনার দরকার কি? পরাশর আধঘণ্টার মধ্যে আসবে বলেছে। আধঘণ্টার পঁচিশ মিনিটই ত কেটে গেছে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!
কিন্তু কি হল কি! ঘড়ির কাঁটা পাঁচ মিনিট ছাড়িয়ে দশ মিনিটের দাগও যে পার হতে চলেছে। এখনো পরাশরের দেখা নেই কেন? পরাশর মাঝে মাঝে খেয়ালবশে ঘড়ি ধরা সময় রাখতে গাফিলতি করে বটে, কিন্তু সে রকম দরকারী কিছু হলে সে আবার সেকেণ্ডের কাঁটাকেও হার মানায়। যে উত্তেজনা আর অস্থিরতার সঙ্গে সে খানিক আগে ফোন করেছে তাতে তার ত একেবারে কাঁটায় কাঁটায় আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোবার কথা। কি হয়েছে কি তাহলে? ব্যস্ত হয়ে তার বাসাতেই এবার ফোন করলাম। না সে বাসায় নেই। তার অনুচরের কাছে জানা গেল আধঘণ্টারও আগে সে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার মানে আমায় ফোন করবার পর বাড়িতে সে আর এক মিনিটও সময় নষ্ট করে নি। কিন্তু তার বাসা থেকে আমার এখানে আসতে ত খুব বেশী হলে বিশ মিনিটের বেশী লাগবার কথা নয়। বিশেষ এই সকালবেলার ফাঁকা রাস্তায়। তাহলে কি গাড়ির ব্রেকডাউন? না দুর্ঘটনা কোনো! অশুভ ভাবনাটাকে দূরে ঠেলে রেখে আবার ফোন করলাম পরাশরের বাসায়।
জিজ্ঞেস করলাম তার অনুচরকে, “পরাশর কোথায় যাচ্ছে কিছু বলে গেছে কি?”
“না তা বলেন নি।” উত্তর পেলাম, “শুধু বলে গেছেন আজ দিনের বেলা আর বাড়িতে খাবেন না।”