গাড়িটা তখন বেলেঘাটা হয়ে পার্ক-সার্কাসে এসে পৌঁছেছে। পরাশর এতক্ষণে তার নীরবতা ভঙ্গ করে গাড়িটা থামাতে অনুরোধ করলে। বারোহা গাড়ি থামাতে অনুরোধ করলে। বারোহা গাড়ি থামাবার পর বিদায় নিয়ে নেমে যেতে যেতে খুশি মনেই বললাম, “আপনার নামটা শুনে প্রথমেই আমার কার কথা মনে হয়েছিল জানেন?”
“কার কথা?” একটু অবাক হয় জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
“মনে হয়েছিল আপনাদের বিখ্যাত সেই লেখক পিও বারোহা-র কথা। আপনার সঙ্গে কোন সম্বন্ধ তম্বন্ধ আছে নাকি। পদবীতা এক কি না, তাই ভাবছিলাম।”
“পদবী এক।” একটু থেমে থাকার পর সজোরে হেসে উঠে বারোহা যেন আমাকেই লজ্জা দিলে। “পদবী এক হলেই সম্বন্ধ থাকবে কেন। না, না ও নামের কোনো লেখকের সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই।”
বারোহা গাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর পরাশরের দিকে ফিরলাম। সে তখনো যেন কেমন অন্যমনস্কভাবে দ্মাড়িয়ে আছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা,, হঠাৎ এখানে গাড়ি থামাতে বললে কেন? বারোহা ত শহরের মাঝখানেই যচ্ছে। সেখানে কোথাও ত নেমে যেতে পারতাম।”
“তা পারতাম। তবে এখানে একটু কাজ আছে।”
“এখানে কি কাজ?” একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
উত্তর যা শুনলাম তাতে নিজের শ্রবণ শক্তিতেই প্রথম সন্দেহ জাগল। “এখানে এক জায়গায় একটু হাত দেখাব।” বললে পরাশর।
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৫
পাঁচ
পরাশর হাত দেখাবার জন্যে এখানে নেমেছে। কথাটা প্রথমে বিশ্বাস করতেই পারি নি। হাত দেখাবে পরাশর! সব আজগুবি দুর্বলতা ত কোনদিন তার ছিল না। সে কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে! কিন্তু সত্যিই সে যখন মিনিট দশেক হাঁটিয়ে একটা গলি গোছের রাস্তার একটি দোতলা বাড়ির সামনে নিযে গিযে দাঁড়াল, তখন তার নতুন দুর্বলতা সম্বন্ধে আর সন্দেহ রইল না।
বাড়িটার পরিচয় ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত তার সর্বাঙ্গে লাগানো নানা বিচিত্র সাইনবোর্ডেই ঘোষিত। দুধারের দেয়ালে ষটচক্র সুষুম্মা কাণ্ড ইত্যাদি কি সমস্ত দেহরহস্যের ছবি আঁকা বোর্ড ঝোলানো। দরজার মাথায় প্রকাণ্ড সোনালী হরফে লেখা বোর্ড। তাতে উঁচু-করা জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা – নিখিল বরেণ্য যোগসিদ্ধ জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজ। বাংলার চেয়ে আরো বড় ও উঁচু হরফ ইংরাজি। তাতে অবশ্য আর একটু সংক্ষেপে প্রথম লাইনে লেখা ‘শঙ্কর মহারাজ, অ্যাষ্ট্রলজার সুপ্রিম অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড, আর তার নিচের লাইনে লেখা ‘রীডস ইওর লাইফ-লাইক এ বুক’।
শঙ্কর মহারাজের পসার কি রকম ও কাদের মধ্যে তা ঐ গলির ভেতরই দাঁড় করানো দুটি দামী মোটরেই বোঝা যায়। মক্কেলদের একজন আমরা ওপরে যাবার মুখেই নেমে এসে গাড়িতে উঠলেন। দুজনেই বর্ষয়সী বিদেশী মেম-সাহেব। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুনে এটুকু বোঝা গেল যে তাঁরা জ্যোতিষ চক্রবর্তীর কাছে নতুন আসছেন না। নাতি প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যাবার পর আরেক যে মক্কেলকে অত্যন্ত কৃতার্থভাবে বিদায় নিতে দেখলাম তিনিও শ্বেতাঙ্গ। তাতে এইটুকু অন্ততঃ বোঝাগেল যে শঙ্কর মহারাজের খ্যাতিটা দেশের চেয়ে বিদেশেই বেশী না হোক কম নয়।
জ্যোতিষ চক্রবর্তীর প্রণামী বেশ একটু বেশী বলে ওপরে সাধারণ প্রার্থীর ভিড় একেবারেই নেই। আমাদের আগের শ্বেতাঙ্গ মক্কেল চলে যাবার পর আমরাই শুধু সেখানে রইলাম। শঙ্কর মহারাজের কাছে পরাশর একেবারে অচেনা নয় দেখলাম। কাছে গিয়ে বসতেই একতু যেন সকৌতুক ভৎর্সনার সুরে মহারাজ বললেন, “আবার কি হল।”
“আজ্ঞে হাতটা এবার একটু দেখুন।” বলে পরাশর তার ডান হাতটা বাড়িযে দিল।
“হাত দেখতে হবে না।” জ্যোতিষ চক্রবর্তী হাত ঠেলে দিয়ে বললেন, “আমি তোমার মুখেই সব দেখতে পাচ্ছি। অপেক্ষা কর এক মিনিট।”
জ্যোতিষ চক্রবর্তী যতক্ষণ পরাশরের মুখ দেখলেন তাঁর মধ্যে আমিও তাঁকে তখন দেখে নিলাম। ভক্তি না হোক সম্ভ্রম জাগাবার মত চেহারা বটে। দামী গালচের ওপর পাতা জাজিমের আসনে দুধারে মখমলের তাকিয়া নিয়ে যেন ছোটখাটো পাহাড়ের মতো বসে আছেন। লোমশ বুকের ভাঁজ ভুঁড়ির ভাঁজ সবই দেখবার মত। এই দেহের অনুপাতে বিরল কেশ মুণ্ডটাও বিরাট। মুখটি পরিপাটি করে কামানো ও কপাল থেকে গাল, গলা ও বুক পর্যন্ত বিধিত্র সব তিলক চিহ্ন আঁকা। বিদেশীদের কাছে এই চেহারার এক উদ্ভট আকর্ষণ থাকতে পারে কিন্তু পরাশরের এখানে ভাগ্য গণনার জন্য আসা যে কল্পনাতীত। এরকম আজগুবী খেয়াল কেমন করে তার হতে পারে। জ্যোতিষ চক্রবর্তীর পরের কথায় তার কিছুটা হদিশ অবশ্য পেলাম।
মুখে ঈষৎ কৌতুকের কুঞ্চন নিয়ে শঙ্কর মহারাজ বললেন, “হুঁ, অবস্থা বেশ সঙ্গীন দেখছি। রোগটা একেবারে সাংঘাতিকভাবে চেপে ধরেছে। আশা ভরসা কিছু দিতে পারছি না। মঙ্গল আর কেতুর সংযোগ পেয়ে বিপক্ষ একেবারে অপরাজেয়। তবে …না না দাঁড়াও দাঁড়াও। বুধ আর শুক্রকে যদি বক্রী করা যায়! এমনিতেই দেখছি অবস্থানের শনির দৃষ্টি পড়েছে। স্থান-ত্যাগের ব্যাকুলতা দেখা যাচ্ছে তাই। সিদ্ধিলাভ ত্বরান্বিত করবার তাই চেষ্টা। শনির অপ্রসন্নতার সঙ্গে বুধ আর শুক্রকে যদি বক্রী করা যায় তাহলে – তাহলে তোমার অভিলাষ পূর্ণ হতেও পরে।”
পরাশরের মুখটা গোড়া থেকেই লক্ষ করছিলাম। শঙ্কর মহারাজ তাঁর গণনার সিদ্ধান্ত জানাতে শুরু করার পর থেকে বেশ একটু ম্লান থাকবার পর এতক্ষণে তা একটু যেন উজ্জ্বল হতে দেখলাম।
“স্থান ত্যাগের ত্বরাটা যথার্থই বলছেন?” বলে পরাশর এবার উৎসুকভাবে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর দিকে চাইল।
“আমার গণনা ত তাই বলে,” হেসে বললেন শঙ্কর মহারাজ। “বুধ আর শুক্রকে বক্রী করবার ব্যবস্থা যদি চাও ত করা যেতে পারে।”
“আজ্ঞে অনুগ্রহ করে তাই করবেন।” বলে ব্যাগ খুলে করকরে একটি একশ টাকার নোট বার করে জ্যোতিষ মহারাজের পায়ের কাছে নামিয়ে দিলে পরাশর।
তারপর ভক্তি ভরে প্রণাম করে আমার সঙ্গে নিচে নেমে আসবার সময় তার মুখের ভাব দেখে মনে হল এতক্ষণে সে যেন একটু বল ভরসা পেয়েছে।