হোটেল থেকে আমরা তার গাড়িতেই কলকাতায় ফিরছিলাম। কফি খাওয়ার পর এলসার কাছে বিদায় নেবার সময় সে নিজে থেকেই আমাদের কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার কথা বলেছে। এটা তার অতিরিক্ত কিছু সৌজন্য নয়। এলসা আর আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার আগে সে কলকাতায় যাবার জন্যেই বেরিয়ে আসছিল। এলসাকে দেখে ও আমাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় যাওয়াটা কিছুক্ষণ স্থগিত থেকেছে মাত্র। বারোহার গাড়িটা রীতিমত খানদানি ও বিরাট। কোন আপত্তি না শুনে সে তার সংগে সামনের সীটেই আমাদের বসিযে নিয়েছে। গাড়িটা যা ঢাউস তাতে জায়গায় অকুলান কিছু হয় নি।
হোটেল থেকে কলকাতার দিকে আসতে আসতে বারোহার মোটামুটি পরিচয় পেয়েছি। বারোহা নিজেই তা দিয়েছে। সে মূল স্পেনের লোক তবে স্পেনে নয় দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে থেকেই তার ব্যবসা চালায়। ব্যবসা তার জৈব সার গুয়ানো নিয়ে। পেরু ও চিলির পশ্চিম প্রান্তের কয়েকটা দ্বীপে হাজার হাজার বছর ধরে সামুদ্রিক পাখীদের দৌলতে সে জৈব সার রশি রশি জমা হয়ে আছে। এক কালে সে সারের চাহিদা আর কদর যা ছিল, ফার্টিলাইজারে কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার তৈরীর পদ্ধতি উদ্ভাবনের পর থেকে তা অনেকটা কমলেও গুয়ানোর ব্যবসায় এখনও লোকসান নেই। বারোহার কাছে অবশ্য তার ববসাই ধ্যান জ্ঞান নয়। বছরে ন’মাস সে মনপ্রাণ দিয়ে ব্যবসা করে। তারপর তিনমাস ছুটি নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। এই ঘুরে বেড়ানোই তার নেশা।
বারোহা মানুষটা সত্যিই বুঝলাম নিতান্ত সরল। নইলে মাত্র খানিকক্ষণের আলাপে আমাদের কাছে এত কথা বলে ফেলবে কেন? তার কথায় খেই ধরেই একবার জিজ্ঞাসা করলাম, সে আগে কখনো ভারতবর্ষে এসেছে কি না।
“না, আসি নি,” হেসে বললে বারোহা। “না এসে খুব ভুল করেছি।”
“তার মানে ভারতবর্ষ আপনার ভালো লাগছে?”
“ভালো লাগছে মানে!” বারোহা যেন অবাক হল, “এদেশ ভালো না লেগে পারে! আমার ত মনে হয় আমি আগের জন্মে এদেশেই কোথাও জন্মেছিলাম।”
“আগের জন্মে এদেশে জন্মেছিলেন, “আমি হেসে উঠলাম, তার মানে জন্মান্তরে আপনি বিশ্বাস করেন?”
“আগে করতাম না। এদেশে আসবার পর করি।” একটু থেমে বারোহা সামনের দুটো গাড়িকে নিপুণভাবে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে আবার বললে, “আপনার দেশ যত দেখছি তত যেন একটা অজানা আকর্ষণ আমায় টানছে মনে হচ্ছে।”
কিন্তু এবার আমি একটু উল্টো না গেয়ে পারলাম না, “এরকম হোটেল থেকে এরকম মোটরে চড়ে যা দেখেছেন তা ঠিক আসল ভারতবর্ষ নয়।”
“হ্যাঁ,” বারোহা গম্ভীর হয়ে বললে। “এলসাও তাই বলে, আসল ভারতবর্ষকে জানতে হলে ক্যাডিল্যাক চড়ে বড় বড় সদর রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে কিছু জানা যায় না। কিন্তু আমার উপায় কি বলুন। আমার ছুটির মাত্র এক মাস আর বাকি। এক মাসের মধ্যে এবারের মত ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে যতটা পারি আমার দেখে যেতে হবে। এ গাড়িটা তাই আমি আসার আগে থাকতে জাহাজে এখানে আনিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। এলসা এ গাড়ি নিয়ে ঠাট্টা করে। কিন্তু তার ঠাট্টা শুনলে আমার আর ভারতবর্ষ বেড়ানোই হয় না। আমি ত তার মত এই দেশ নিয়ে পড়াশোনা আর গবেষণা করতে আসি নি। শিকড় গজিয়ে কোথাও বসে থেকে আমি করব কি?”
একটু হেসে বললাম, “কিন্তু মিস এলসাও ত এখানে থাকছেন না। কদিন বাদেই ওঁকে আর্জেণ্টিনায় ফিরে যেতে হবে বললেন।”
“তাই বলেছে নাকি আপনাদের!” বারোহা একটু অবাক হয়ে বললে, “আমিও জানতাম এখান থেকে ওর এখন যাবার ইচ্ছে নেই।” একটু থেমে একটু যেন দুঃখের সঙ্গে বললে, “আর্জেণ্টিনায় কোনো ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপের টাকায় এখানে গবেষণা করতে এসেছে। সেই স্কলারশিপের মেয়াদ হয়তো শেষ হয়ে গেছে। তাই নিরুপায় হয়ে যেতে হচ্ছে।” অথচ বারোহার গলায় এবার হাল্কা কৌতুকের সুরের তলায় একটু যেন ক্ষোভের আবাস পেয়েছি, “আমি কত করে আমার সঙ্গী হয়ে দেশটা আমায় যথাসম্ভব চেনাতে বলি। বলি যে তাহলে আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক হই। এলসা ইংরেজী জানে না আর আমি জানিনা এদেশের কোন ভাষা। দুজনে এক সঙ্গে থাকলে এদেশের ওপর-মহল নিচের-মহল কোথাও আমাদের ঠেকাতে হবে না। তা আমার কথা হেসেই উঠিয়ে দেয়।”
বারোহা-র সরল উচ্ছ্বাসের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল করে ভেতরে ভেতরে একটু চঞ্চল না হয়ে পারলাম না।
আচার্যদেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাকসি নেবার পর থেকে পরাশর এ পর্যন্ত পয়সার কোনো কথা একরকম বলে নি বললেই হয়। সে মাঝে মাঝে তার কবিতার ভাবনায় কি কোনো সমস্যার জট খোলার জন্যে আনমনা হয়ে থাকে বটে কিন্তু এতক্ষণ ধরে এরকম নীরবতা ত তার পক্ষে স্বাভাবিক নয় মোটেই। এলসা সম্বন্ধে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে বেশী রকম দুর্বল হয়ে পড়ার জন্যেই কি তার এমন ভাবান্তর? কন্দর্প আর কার্তিকে মেশানো চেহারার এই বারোহাকে এলসার এত ঘনিষ্ট বন্ধু বলে জেনে মনের ভেতরে একটা ঘা খেয়ে সে এমন গুম হয়ে গেছে। আর কিছু না হোক তার উদাসীন ভাবটা একটু ভাঙবার চেষ্টায় বারোহা-র কথার জের টেনে বললাম, “মিস এলসার ইংরেজী না জানায় একটু অসুবিধে হয় নিশ্চয়ই।”
“না। অসুবিধা আর কি?” বারোহা এলসার হয়ে বললে, “আপনাদের এখানে ইংরাজির এখনো খুব চল, কিন্তু সারা দুনিয়ায় আমাদের স্প্যানিশ-এর প্রসার বড় কম নয়। গোটা দক্ষিণ আমেরিকাই স্প্যানিশের রাজত্ব বল্তে পারেন। আর স্প্যানিশের সঙ্গে ফরাসী জানলে ত সভ্য সমাজের কোথাও ঠেকবার কথা নয়।”
নিজের ভাষার গৌরব নিয়ে বারোহা-র অহঙ্কারে একটু আমোদই পেয়ে এবার জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, মিস এলসা আপনার কাছে আমাদের কি পরিচয় দিয়েছেন, বলুন ত।”
“কেন?” বারোহা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “ভুল কিছু দিয়েছে?”
“কি দিয়েছে না জানলে ভুল কিনা বুঝব কি করে?” হেসে বললাম, “স্প্যানিশে নিস এলসা কি বলেছেন তা’ত বুঝতে পারি নি।”
“হ্যাঁ, তা ত বটে।” বলে বারোহা একতু গম্ভীর হবাই ষর ভাব করে বললে, “আপনাদের পরিচয় যা দিয়েছে তা কিন্তু মোটেই সুবিধার নয়।”
“তাই নাকি?” আমিও গম্ভীর হলাম, “কি বলেছে, কি?”
“এলসা বলেছে,” বারোহা আর হাসি চাপতে পারলে না, “আপনারা দুজনে পুলিশের লোক, এলসার পেছনে লেগেছেন কিছু একটা ব্যাপারের সন্ধানে।”
কথাটা বলে বারোহা তখন হাসছে। এতক্ষণে পরাশরকে একবার যেন সজাগ হয়ে মুখ ফেরাতে দেখে আমি একটু ভরসা পেলাম। বারোহার হাসিতে যেন ক্ষুণ্ণ হবার ভান করে বললাম, “আশ্চর্য! একথা মিস এলসা জানলেন কি করে?”
“না, না।” হাসতে হাসতে বারোহা আমায় আশ্বস্ত করে বললে, “এলসা তা বলেনি। ও বলেছে আপনারা দুজন কোনোখানে বোধহয় অধ্যাপনা করেন। আপনি বোধহয় ইতিহাস ভূগোল গোছের কিছুর আর আপনার বন্ধু পুরাতত্ত্বের। ঠিক ও নাকি জানে না। আজই নাকি আপনাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছে।”
একটু থেমে বারোহা আবার জিজ্ঞাসা করলে, “ভুল কিছু বলেছে এলসা?”
“না, না ভুল কিছু বলে নি।” আমি হেসে জানালাম।
“আপনারা নিজে থেকে ওকে ট্যাকসি ডেকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছেন বলে ও যে কৃতজ্ঞ সে কথাও এলসা তখন জানিয়েছে। সুতরাং আমি একটু ঠাট্টা করলাম বলে ওকে ভুল বুঝবেন না।”
“না, ভুল বুঝব কেন?” ব্যস্ত হয়ে বারোহাকে আশ্বস্ত করলাম।