এরপর আর আমায় পায় কে? অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে নামটাম সবই বার করে ফেললাম। মেয়েটির নাম এলসা। আর্জের্ণ্টিনায় বাড়ি। সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে ভারতবর্ষের গুপ্তযুগের কয়েকজন বৌদ্ধ আচার্য পণ্ডিতদের সব্মন্ধে গবেষণা করে থিসিস লিখতে এখানে এসেছে। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের কয়েকটি জায়গায় ঘুরে সেখানকার কাজ শেষ করেছে। এখন বাংলাদেশের কাজই তার বাকি। এখানকার কাজ শেষ করতে নানা কারণে দেরী হচ্ছে। তবু আশা করছে, সপ্তাহ দু-একের মধ্যেই কাজ শেষ কের ফিরে যেতে পারবে। এলসার পরিচয় যেতুকু পেলাম তা এমন কিছু নতুন কি আশ্চর্য নয়। আজকালকার দিন বিদেশ থেকে যে সব ছেলে মেয়ে ভারতবর্ষে পড়তে শুনতে কি বেড়িয়ে যেতে আসে তাদের অনেকের কাহিনীই এই ধরণের।
কিন্তু এরপর যা জানলাম তা সত্যই চমকে একেবারে বিমূঢ় করবার মত। ট্যাকসি এরোড্রোমের রাস্তায় অনেক দূর তখন চলে এসেছে। ড্রাইভার টার্মিন্যালের দিকেই গাড়ি চালাতে যাচ্ছিল, হঠাৎ এলসা বারণ করে বললে, “না, ওদিকে নয়।” ওদিকে নয় তা আগেই জানতাম, কিন্তু সত্যিই যাবে কোথায়? এরোড্রোমের এলাকা ছাড়লে অবশ্য কিছু বাগানবাড়ি গোছের কলকাতার সম্পন্ন মানুষের বিশ্রামকুঞ্জ গোছের আছে। তারই একটিতে আশ্রয় যোগাড় করেছে নাকি এলসা? না, সে রকম কোথাও নয়। নিজেই নির্দেশ দিয়ে এলসা যেখানে ট্যাকসি নিয়ে গিয়ে থামলে তার সামনের দোকানটা দেখে আমার অন্ততঃ চক্ষুস্থির।
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৪
চার
এতো যাকে বলে পাঁচতারা মার্কা। আমীর ওমরাহদের থাকবার হোটেল। এলসা এখানে থাকে? নেহাৎ সাধারণ কমদানী কাপড়ের আধা-হিপি যার বেশবাস খানিক আগে এখানে আসবার জন্যে যে মিনিবাসের খোঁজ করছিল সেই পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে আসা মেয়ের আস্তানা হল এই হোটেল।
পরাশর ট্যাকসির মিটার দেখে ভাড়া চুকিয়ে দিলে। দেবার সময় ভেবেছিলাম মেয়েটি আপত্তি করবে। তা সে করলে না। কিন্তু আমাদের নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিতে দিলে না। তাদের কফিবারে কয়েক মিনিটের জন্যে একবার অন্তত পা দিয়ে একটু কফি যেতে নিমন্ত্রণ জানালে।
নিজের পোষাক-আশাকের কথা ভেবে এই বাদশাহী হোটেলে সে নিমন্ত্রণ রাখবার খুব ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু পরাশরের দেখলাম একেবারে ভাত খাবি না আঁচাব কোথা গোছের অবস্থা।
বলতে না বলতে রাজী হযে সে প্রায় আমাদের সকলের আগে যেভাবে হোটেলে গিযে ঢুকল সেটা তখন আমাদের একটু খারাপই লেগেছিল।
কিন্তু পরে মনে হয়েছে যে তখন অমন করে না গেলে সেনর বারোহার সঙ্গে আলাপই হত না। আর সেটা এক দিক দিয়ে লোকসানই হত। কারণ সেনর বারোহা এমন একজন মানুষ আজকের দুনিয়ায় যাদের একতা নতুন যুগের প্রতিনিধি বলা যায়। এ কাহিনী লিখতে লিখতে তাঁর পরিচয়টা ধীরে ধীরে সবই প্রকাশ পাবে। আপাততঃ এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে প্রথম দেখাতেই দেশ বা বিদেশের কোন মানুষ আমার মনে এমন কৌতুহল জাগায়নি।
সেনর বরোহার সঙ্গে হোটেলে ঢোকবার দেউড়িতেই প্রায় দেখা। তিনি হোটেল থেকে বেড়িয়ে কোথায় যচ্ছিলেন। আমাদের ঠিক নয়, এলসা কে দেখেই এক মুখ হেসে বিদেশী যে ভাষায় তাকে সম্ভাষণ করলেন সেটা স্প্যানিশ বলেই মনে হল। এলসা হেসে দাঁড়িযে তখনই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলে। পরিচয় কি যে দিলে তা অবশ্য বুঝলাম না। হয়ত, পরাশরের পরিচয় দিলে বাঙ্গালী একজন বড় পণ্ডিত গবেষক বলে আর আমাকে পরাশরের বন্ধু ও কলকাতায় একজন গণ্যমান্য কেউ হবার গৌরব দিলে। পরিচয় যাই দিক,, বারোহার দিক দিয়ে হৃদ্যতার তাতে অভাব হল না। বাইরে যাওয়া তার মাথায় উঠল, আমাদের সঙ্গে করমর্দন করে কফিবারেই সঙ্গী হল আমাদের। বারোহা অবশ্য ইংরেজী ভালো রকমই জানে। সত্যি কথা বলতে গেলে, নামটা না বলে প্রথেমেই আলাপ কারলে তার ইংরেজি শুনে সে যে ইংরেজ বা মার্কিনী নয়, তা বুঝতেই পারতাম না।
মানুষটা অবশ্য অনেক দিক দিযেই লক্ষ্য করবার মত। এলসা হোটেলের দরজায় তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই আমাদের ঢোকবার মুখে আর সকলের মধ্যে তার চেহারাটা চোখে পড়েছিল। না পড়াটাই আশ্চর্য। ইস্পাত তীক্ষ্ণ। চাবুকের মত চেহারা যাকে বলে বারোহার ঠিক তাই। নামটা জানবার পর সে চেহারায় একট হদিসও পেয়েছি। বরোহা স্পেনের মানুষ। সে দেশের বুনো ক্ষেপিয়ে দেওয়া ষাঁড়ের সঙ্গে প্রাণ তুচ্ছ করে শুধু একটা লাল কাপড় আর নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে পা চালানোর কৌশল আর ক্ষিপ্রতায় যারা লড়ে বারোহা-র শিরায় সেই টোরিয়াডরদের রক্তই নিশ্চয় বইছে। তাই সাদাসিধে প্যাণ্ট সার্ট ও তার চলা ফেরায় যেন চিতার মত সুঠাম প্রাণীর সংহত বলিষ্ঠতা ফুটে বার হচ্ছে। পোষাক আশাক বা চেহারায় তেমন জৌলুস না থাক, ইংরাজি না জেনেই এলসা এখানে বেশ জনপ্রিয় দেখলাম।
কফিবারে কফি খাবার সময় অনেকেই তাকে প্রীতি সম্ভাষণ জানিয়ে গেল। মঁসিযে রেনোয়া নামে একজন ফরাসী প্রৌঢ় তার ভাগনীকে নিয়ে খানিকক্ষণ ত আমাদের টেবিলে বসে এক পাত্র করে কফিই খেয়ে গেলেন। এঁদের সকলের সঙ্গেই এলসা তাঁদের ভাষাতেই আলাপ চালালে। বারোহার সঙ্গে যেমন স্প্যানিশ, রেনোয়া আর তার ভাগনীর সঙ্গে তেমন ফরাসীতে। শুধু ইংরাজিটা সে কেন যে শেখেনি সেইটা আশ্চর্য। কফি খাওয়া পর্ব শেষ করে হোটেল থেকে কলকাতা ফেরবার সময় বারোহাও সেই কথা বলে দুঃখ করলে।