কথা বলতে বলতে আচার্যদেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা তখন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। এরপর বিদায় নমস্কার জানিয়ে যে যার পথে যাবার পালা। পরাশরের এখনো পর্যন্ত এই মুহূর্তটাকে কাজে লাগাবার কোনো লক্ষণ নেই দেখে নিজেকেই গায়ে পড়া হয়ে কথাটা তুলতে হল।
“আপনি যাবেন কোন দিকে?” মেয়েটিকে বাংলাতেই জিজ্ঞাসা করলাম।
“আমি!” মেয়েটি যেন এ প্রশ্নে একটু বিচলিত, “আমি – আমি উত্তর দিকেই যাব।”
সেই সঙ্গে আর একটা যা প্রশ্ন করলে তা আমি তার মুখ থেকে আসতে পারে বলে ভাবিনি।
মেয়েটির জিজ্ঞাসা হল, “আচ্ছা এখান থেকে আপনাদের ঐ কি বলে মিনি বাস পাওয়া যায় না?”
“পাওয়া যাবে না কেন!” মেয়েটির মিনিবাসে যেতে চাওয়ায় অবাক হলেও বিস্ময়টা গোপন করে বললাম, “কিন্তু এখন অফিসের সময়। উত্তরমুখো কোনো বাস ট্রামই ত খালি পাওয়া যাবে না। তা আপনি যাবেন কতদূর?”
“তা যাব একটু দূর।” মেয়েটি কুণ্ঠিত ভাবে জানালে, “সেই দমদমের কাছে।”
দমদমের কাছে শুনে সত্যিই একটু দমে গিয়ে যখন এই ভিড়ের সময়ে সেখানে পৌঁছোবার একটু সুলভ ও সুবিধাজনক বাস রুটের কথা ভাবছি, পরাশর ততক্ষণে বেপরোয়া হয়ে একটা চলতি ট্যাকসি ডেকে থামিয়ে ফেলেছে।
কাজটা বীরোচিতই হয়েছে সন্দেহ নেই, সিভ্যালরির পরিচয় দিতে এটুকু না করে উপায় ছিল না। কিন্তু আমি থখন নিজের পকেটের অবস্থা জেনে দমদম পর্যন্ত ট্যাকসির মিটারের নির্দেশ অনুমান করে শঙ্কিত না হয়ে পারি নি।
যে মেয়ে দমদমে যাবার জন্যে মিনি বাসের খোঁজ করে তাকে ট্যাকসি ডেকে দেওয়াটা সত্যিই উপকার করা কি না তাও ভাববার বিষয়।
ট্যাকসি দাঁড়াতে দেখে সেই জন্যেই মেয়েটিকে কেমন একটু ইতস্ততঃ করতে বোধ হয় দেখলাম।
পরাশর অবশ্য ততক্ষণে ট্যাকসির দরজা খুলে ধরে ডাকছে, “আসুন।”
মেয়েটি একটু দ্বিধাভরে যতক্ষণে ট্যাকসিতে গিয়ে উঠল ততক্ষণ আমি পরাশর এরপর কি করবে ভেবে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে রইলাম। পরাশর কি মেয়েটিকে ট্যাকসিতে উঠিয়ে ছেড়ে দেবে?
না, তা পরাশর দিলে না। মেয়েটি ভেতরে গিয়ে ওঠবার পর আমার গড়িমসিতে যে অধৈর্য দেখিয়ে বললে, “কই, এসো কৃত্তিবাস?”
“আমি!” অকপট বিস্ময়ের সঙ্গে একটু ভীত ভাবেই পরাশরের দিকে চাইলাম, “আমায় ডাকছ কেন? আমার এখন অতদূর দমদমে যাওয়ার একটু অসুবিধে আছে।”
“অসুবিধে আবার কি?” পরাশর এবার হাত ধরেই আমায় ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে পাশে এসে বসে ড্রাইভারকে দমদম যাবার নির্দেশ দিলে।
পরাশর এমনভাবে আমাকে নিয়ে ট্যাকসিতে ওঠায়, ভাড়ার ভাবনাটা থেকে তখন মুক্তি পেয়েছি। মেয়েটির ফেরবার সমস্যা মেটাবার সঙ্গে তার ঠিকানাটাও জেনে আসার এ সুযোগ ছেড়ে দেওয়াই তার পক্ষে আহাম্মকি হত।
কিন্তু যার জন্যে এত করা সে মেয়েটির প্রতিক্রিয়াটা কি সেইটেই ত বোঝা যাচ্ছে না।
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৩
তিন
গড়িয়াহাট রোড ধরে গাড়িটা তখন উত্তরের দিকে চলেছে। সেই দক্ষিণ কলকাতায় ট্যাকসিতে ওঠবার পর থেকে মেয়েটি কেমন একটু অন্যমন্স্ক হয়ে সমানে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে। বপুটি আমার নেহাত শীর্ণ নয়। পেছনের সীটে তিনজন পাশাপাশি বসার জন্যে একটু ঘেঁষাঘেঁষিই হয়েছে। মেয়েটির সুগঠিত দেহের কিছু কিছু অংশের স্পর্শ এড়াবার তাতে উপায় নেই। দেহের সে স্পর্শ দিয়ে মনের কথা ত আর বোঝা যায় না। গেলে হয়ত তাতে খুশি হবার মত কিছু পেতাম না। পরাশর তার পরিবহন সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ সমাধান তার ঠিক মনঃপুত না হওয়ারই কথা। মেয়েটি থাকে সেই দমদমে সেখানে যাবার জন্যে নিজে থেকে সে মিনিবাসের খোঁজ করেছে। তার মানে তার আর্থিক সঙ্গতি তেমন যথেষ্ট নয় বলেই ত মনে হয়। পরাশর নিজে থেকে ট্যাকসি ডেকে তাকে পৌঁছে দেবার জন্যে সঙ্গী হওয়ায় মেয়েটির সে দিক দিয়ে এখন অবশ্য বিব্রত হতে হবে না, কিন্তু কোথায় সে থাকে তা জানাবার উৎসাহ তার নেই এমনও হতে পারে।
দমদমে কোথায় থাকবার আস্তানা সে পেয়েছে ত অবশ্য জানি না, তবে তার পোষাক-আশাক দেখে জায়গাটা ডেকে দেখাবার মত নয় বলেই ত মেন হয়।
ঠিক হিপিদের পর্যায়ে মেয়েটি পড়ে না বটে, কিন্তু হিপিরা যেখানে সেখানে যদি থাকতে পারে, মেয়েটির পক্ষে নিতান্ত সাধারণ কোনো আশ্রয়ে থাকা ত থাহলে অসম্ভব নয়। আপত্তি না করলেও তার সেই ঠিকানাটুকু বাধ্য হয়ে জানাতে হচ্ছে বলেই হয়ত মেয়েটির হঠাৎ এই মনমরা আনমনা ভাব। তাতে লোকসান অবশ্য আমাদেরই। আমাদেরই মানে আসলে পরাশরেরই। এতক্ষণ একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়ে পরিচয়টা গভীর করা পরাশরের আর হয়ে উঠল না। মেয়েটির থাকবার জায়গাটা সে দেখে আসবে বটে, কিন্তু গোড়াতেই এমনভাবে সুর কেটে যাবার পর আবার নতুন করে জমানো আর কিছু না হোক সহজ নিশ্চয় হবে ন। এ ব্যাপারে বন্ধু হিসেবে আমিই বা কি করতে পারি ভেবে পেলাম না। গায়ে পড়ে আলাপ যে না করা যায় তা নয়। তাতে আমাকে বেশ খেলো হতে হলেও বন্ধুর খাতিরে তা আমি হতে প্রস্তুত। কিন্তু আলাপটা শুরু করব কি নিয়ে? পরাশরের মত পুরাতত্ত্ব কি ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে ছিটেফোঁটা জানাশোনা থাকলেও তাই নিয়ে আলাপটা শুরু করতে পারতাম। কিন্তু এসব বিষয়ে আমার যা বিদ্যে তাতে দন্তস্ফুট করলে শুধু হাসির খোরাকই যোগাবে। আলাপ শুরু করার ও পথ সুতরাং বন্ধ। মেয়েটি বলেছে সে আর্জেণ্টিনার মেয়ে। ঐ আর্জেণ্টিনা দিয়েই কথাটা শুরু করব নাকি? আর্জেণ্টিনা সম্বন্ধেও বেশী কিছু যে জানি তা নয়, তবে তার রাজধানীর নামটা আর দু-একটা খবর জানা আছে। তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ব বলে একটু নড়েচড়ে বসতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম। প্রথমে নিজের কানটাকে বিশ্বাস করতেই একটু বাধল। তারপর বিস্ময়ের আর শেষ রইল না। যা শুনছি তা মিথ্যে নয়। মেয়েটিই নিজে থেকে কথা বলছে আর ক্ষোভ কি বিরক্তি নয় বেশ একটু কৌতুক মেশানো গলায়।
“কৃত্তিবাসবাবুর বড় বেশী শাস্তি হচ্ছে বুঝতে পারছি।”
মেয়েটি শুধু নিজে থেকে কথাই বলে নি, আমার নামটাও ঠিক মত উচ্চারন করে টিপ্পনী করেছে।
নামটা সেই একবার পরাশর বলেছিল ট্যাকসিতে ওঠবার সময়। তাতেই এতক্ষণ মনে রাখাই ত যথেষ্ট। তার ওপর ঐ কৌতুকের সুরটুকু।