তা করবার জন্যে তা তোড়জোড়টা দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নেহাৎ ভাসাভাসা সাময়িক কিছু নয়। পঞ্চশরের তীরটা আচমকা একটু গভীরভাবেই বিঁধেছে। একটু দেখা পাওয়া যায় আলাপ করবার সুযোগের জন্যে তাকে আমায় নিয়ে পণ্ডিত শিরোমণি এই আচার্যদেবের বাড়িতে ছুটে আসতে হয়েছে তাই। পরাশরের হঠাৎ পুরাতত্ত্ব নিয়ে মেতে ওঠার পেছনে কি আছে এখন আর বোঝা শক্ত নয়। এখানে এসে আর কিছু না হোক কাছাকাছি বসে একটু কথা বলার সৌভাগ্য পরাশরের হয়েছে। তারপরে অবশ্য অনেক ধাপ বাকি। পরস্পরের নাম ধাম জানা থেকে, দেখা শোনার সুযোগ করে নেওয়া ইত্যাদি ধাপগুলো ত আগে না পেরুলে নয়। তাতে আমার কাছে কোনো সাহায্যের আশা কি পরাশর করে? করা তার পক্ষে স্বাভাবিক কিন্তু মেয়েটির নাম পর্যন্ত না জেনে কি-ই বা করতে পারি আমি?
মেয়েটি এতক্ষণের মধ্যে বেশ কয়েকবার আমায় লক্ষ অবশ্য করেছে। আমার আগাগোড়া চুপ কে থাকে দেখে খুব একটা সম্ভ্রম মেশানো ধারণা নিশ্চয় আমার সম্বন্ধে হয় নি। তা না হোক। এতক্ষণের ধারণাটা একটু শুধরে দেবার ব্যবস্থা এবার করলাম। সেই সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় যাতে জানা যেতে পারে সে রকম একটা চেষ্টাও। ঘরের দেয়াল ঘড়িটার দিকে এ পর্যন্ত বহুবারই তাকিয়েছি। এখন তকানোটা সরব করে তুলে বেশ অধৈর্যের সঙ্গে নিজেকেই যেন বললাম, “দশটা ত বাজতে চলল। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়?
পরাশর ও মেয়েটি তাদের আলোচনা থামিয়ে তখন আমার দিকে তাকিয়েছে। পরাশরের দিকে সোজা তাকাইনি। তার চোখে হয়ত একটু ভ্রুকুটি থাকতে পারে। কিন্তু মেয়েটির মুখে ইষৎ হাসির আভাস। সেইটেকেই সহানুভূতি বলে ধরে নিয়ে সোজাসুজি বললাম,, “আমরা ত প্রায় চল্লিশ মিনিট এসেছি। আপনি ত তারো আগে এসেছেন। অপেক্ষা করে আছেন কতক্ষণ!”
আগের অধৈর্য প্রকাশটা বাংলায় করে থাকলেও এবার ইচ্ছা ক্রেই ইংরেজি ব্যবহার করেছি। কথাগুলো সোজা। প্রশ্নটার মধ্যেও জটিল কিছু নেই। কিন্তু মেয়েটি তাতেই অমন হতভম্ব হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকবে ভাবতে পারিনি। আমার কথাটা হয়ত একটু ভুল বুঝেছে ভেবে বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে মাফ চাইবার ভঙ্গিতে বললাম, “আমি শুধু আপনি আমাদের চেয়েও আরো কতক্ষণ অপেক্ষা করছেন তাই জানতে চেয়েছি।”
মেয়েটির মুখ তাতেও কিন্তু যেমন বিমূঢ় বিব্রত ছিল তেমনিই রইল। সেই সঙ্গে একটু কেমন যেন অসহায় ও করুণ।
কি এমন অন্যায় অশোভন কথা বলে ফেলেছি কিছুই না বুঝতে পেরে, এবার নিজেই রীতিমত ঘাবড়ে গিয়ে সাহায্যের জন্যে পরাশরের দিকে ফিরে তার শরণ নিতে যচ্ছিলাম, হঠাৎ কথায় চমকে তার দিকে তাকালাম।
মেয়েটি বেশ একটু সঙ্কোচের সঙ্গে পরিষ্কার বাংলায় তখন বলছে, “অনুগ্রহ করে আমায মাপ করবেন। আমি ঐ ইংরেজিটা জানি না।”
ইংরেজি জানেন না! প্রথম বিস্ময়ে কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবার পরই নিজের মূর্খতার লজ্জা পেলাম। বিদেশী ইউরোপীয় মেয়ে হলেই ইংরেজি অবশ্যই জানবে বলে ধরে নেওয়াটা যে কতখানি নির্বুদ্ধিতা তা তখন ভালো ভাবেই বুঝে মর্জনা চাইতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার সুযোগ মিলল না।
মেয়েটি তখন নিজেই কুণ্ঠিতভাবে কৈফিয়ত দিয়ে চলেছে, “দেখুন অমি আর্জেণ্টিনার মেযে। স্প্যানিশের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, এমন কি ইতালিয়ানও একটু আধটু বলতে পারলেও ইংরেজিটা আর শেখা হয় নি। আপনাদের বাংলা ভাষাটা অবশ্য আমি আমার প্রাচ্য পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্যে সংস্কৃত পালির সঙ্গে সামান্য একটু শিখেছি। আপনি ইংরেজিতে কি বললেন বুঝতে না পেরে ওরকম চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। আপনি নিশ্চয়ই তাতে আমায় অসভ্য ভেবেছেন। আমার সে অনিচ্ছাকৃত অভদ্রতার জন্যে মাপ চাইছি আবার।”
অনিচ্ছাকৃত আর অভদ্রতা এই দুটি শব্দে সামান্য একটু হোঁচোট খেলেও মেয়েটি গড়গড় করে এতখানি বাংলা বলে যাওয়ায় তখন আমি অবাক আর অভিভূত।
যে পরাশর এতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নীরব শ্রোতা হয়েই ছিল সে এবার একটু গম্ভীর ভাবেই মন্তব্য করলে, “শুনুন,, মাপ চাইলে আমার বন্ধুরই চাওয়া উচিত। পৃথিবীটা যে ইংরেজদের খাস তালুক নয় এ খবরটা এখনও ও জানে না।”
মেয়েটির সঙ্গে আমিও এ কথায় হাসলাম।
কিন্তু সেই সঙ্গে পরাশরের ওপর একটু রাগও হল। এমন একটা সুযোগ পেয়েও নষ্ট করতে হয়। আমাকে খোঁচা দেবার ছুতোয় আমার নামটা বলে দিলে ক্ষতি কি ছিল? শেষ কথাটায় আমার বন্ধু জানেনা-র মধ্যে কৃত্তিবাস নামটা অনায়াসে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত, আর তাহলে কথার পিঠে কথা এসে মেয়েটির নাম ধাম জানার একটা সুবিধে কি হত না?
এত কাণ্ডের পর নামটাই যে অজানা হয়ে রইল।
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০২
দুই
শেষ পর্যন্ত তা কিন্তু রইল না।
সেই দিনই সকালে এক সঙ্গে অতগুলো সুযোগ হয়ে যাবে তা ভাবতে পারিনি। আচার্যদেবের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য অবশ্য হয় নি। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পর আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করবার পর জানা গেল, আচার্যদেব একটা জরুরী মিটিং-এ কোথায় আটকে পড়েছিলেন। বাড়ি ফিরতে তাঁর দেরী হবে। বাড়িতে ফোন করে তাই দর্শনপ্রার্থী কাউকে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে বারণ করার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির একজন ওপরের সে ফোনের সংবাদ আমাদের জানিয়ে গেলেন।
খবরটা শুনে পরাশর আর মেয়েটি রীতিমত হতাশ। এক সঙ্গেই বাইরে যেতে যেতে মেয়েটি তার সমস্যার কথা জানালে। আচার্যদেবের কাছে কয়েকটা জরুরী বিষয় জেনে না নিলে যে জন্যে সে ভারতবর্ষে এসেছে সে কাজই সে শেষ করতে পারবে না। অথচ আজ নিয়ে দুদিন নাকি তার বসবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আচার্যদেব শেষ পর্যন্ত এমনি ভাবেই অন্য কিছুতে আটকে পড়ে কথা রাখতে পারেন নি।