ঘরের বাইরের করিডর দিয়ে যে দু’ একজন পরিচারককে মাঝে মাঝে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করাটা এখন অন্যায় হবে না। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে কে? আমার পক্ষে সেটা কি শোভন হবে না। আর পরাশর যেরকম তন্ময় হয়ে আলোচনা চালাচ্ছে তাতে আচার্যদেবের আসতে দেরী হওয়ার জন্যে কোনো অস্থিরতা তার আছে বলে মনে হয় না। হঠাৎ কথাটা মাথার মধ্যে একটা ঝিলিক খেলে গেল। পরাশরের হঠাৎ পুরাতত্ত্ব নিয়ে এত মত্ত হবার সহজ ব্যাখ্যাই কি আমার সামনে মূর্তিমতী হয়ে বসে আছে? কিন্তু কে ইনি? এঁর সঙ্গে পরাশরের আলাপ পরিচয় হল কোথায়? আর এতদিন বাদে হৃদয় ঘটিত ব্যাপার যদি পরাশরের একটা ঘটেই থাকে তার জন্যে সৃষ্টিছাড়া অভিজ্ঞতার লোভ দেখিয়ে আমায় সঙ্গে আনবার দরকারটা কি? আমায় কি সাক্ষী হিসেবে রাখা? কিসের সাক্ষী?
এক একজন মানুষ অবশ্য একটু বেশী মাত্রায় যাকে বলে লোক দেখানো স্বভাবের থাকে। প্রেমের জাগরণের মত নিভৃত গভীর ব্যাপারও তারা কাউকে না জনিয়ে না শুনিয়ে সুখ পায় না। কিন্তু পরাশর অমন সস্তা একজিবিশনিষ্ট ত’ কোনো কালেই নয়। বিশেষত প্রণয় ঘটিত ব্যাপার এতকাল বাদে তার জীবনে যদি ঘটেই থাকে সেটাকে সে পারতপক্ষে গোপন রাখতেই চাইবে। তাহলে কিছু না জানিয়ে শুনিয়ে আমার দেখবার সুযোগ দিয়ে আমার অনুমোদনটা নেওয়াই কি তার উদ্দেশ্য? সেটা হওয়া অসম্ভব নয়। পরাশর নেহাৎ ছেলে ছোকরা ত আর নয়। প্রথম যৌবন পার হতেই চলেছে বলা যায়। এ বয়সে এরকম একটা কিছু ঘটলে একটু সাবধানে পা বাড়ানোই ভালো। এর ওপর মেয়েটি যখন বিদেশী তখন নিজের পছন্দ অপছন্দ ছাড়া পাকা বুদ্ধির দারুর সমর্থন চাওয়াটা পরাশরের পক্ষে উচিতই হয়েছে।
নিজের দায়িত্বটা বুঝে মেয়েটিকে বেশ একটু খুঁটিয়েই এবার লক্ষ করলাম। ফিল্মে নামবার মত সুন্দরী না হলেও একটা চটক যে চেহারায় আছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চটকটা একটু নয়, আছে বেশ বেশী মাত্রাতেই। আর সেটা শুধু মুখ চোখের নয় সমস্ত শরীরের। পোষাকের বর্ণনা আগেই করেছি। সেই কিছুটা ইরাণী বেদিয়ানীদের ধরণের গায়ের ঝোলাকুর্তা আর তার তলায় সায়া আর লুঙ্গির মিশ্রণের জেল্লাহীন বিনা বাহারের বেশবাসের ভেতর দিয়েই দেহ সৌষ্ঠবের মাদকতা কেমন করে ফুটে বেরুচ্ছে তা বলা শক্ত। হয়ত মেঝের ওপর বসার অনভ্যস্ত ভঙ্গির দরুণ দেহে প্রচ্ছন্ন রেখার এখানে ওখানে একটু ইঙ্গিতই তার জন্যে যথেষ্ট।
এ রকম মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া পরাশরের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর শুধু চেহারায় চটকই নয়। মেয়েটির মুখ চোখে বুদ্ধির দীপ্তিটাও বেশ স্পষ্ট। তার কাছে যা সম্পূর্ণ বেদেশী সেই ভাষায় বেশ একটু কষ্ট করে কথা বলতে হলেও অবাধে এতক্ষণ ধরে সে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে সেইটেই ত আশ্চর্য। কথা যা বলছে ভাষাটা বাংলা বলেও তা আমার কাছে অব্শ্য পুরোপুরি গ্রীক। সব কথায় কানই দিচ্ছি না। মাঝে মাঝে দু-একটা যা কানে আটকে যাচ্ছে সেই কটিই মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। যেমন পরাশরের কি একটা প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটিকে বলতে শুনেছি, “না আমি আচার্যদেবের কাছে ‘কাশিকা বৃত্তি’ সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।”এ কথার উত্তরে পরাশর যা বলেছে তাতেও অবশ্য আমার চক্ষু স্থির।
পরাশর বলেছে, “কাশিকাবৃত্তি ত বামন আর জয়াদিত্য দুজনের এক সঙ্গে লেখা।”
মেয়েটি মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে।
পরাশর তাতে আবার বলেছে, “কিন্তু কাশিকা বৃত্তিতে না বলে অন্কে কিছু চুরি করে দুই পণ্ডিত চ্দ্রগোমী কি চান্ত্র ব্যাকরণের নাম পর্যন্ত করেন নি।…”
এতখানি শোনবার পর আমার কনের ফুটো আপনা থেকেই যেন বুজে গেছে।
মাথাটা গুলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে একবার এমন সন্দেহও জেগেছে যে ব্যাপারটা আগাগোড়া আমায় বোকা বানাবার ফিকির না ত? দুজনে মিলে আগে থাকতে ষড় করে রেখে এই সব হিংটিং ছট আউড়ে আমায় হকচকিয়ে দেওয়াই এদের মজা।এ সন্দেহটা অবশ্য মনের মধ্য উঠতে না উঠতেই সকৌতুকে উড়িয়ে দিয়েছি। পরাশর ও মেয়েটি বৌদ্ধ যুগের গুরু-গম্ভীর বিষয় নিয়েই আলোচনা করছে সন্দেহ নেই। কিন্তু পরাশর হঠাৎ এ বিষয়ে কবে থেকে উৎসাহী হয়ে উঠল? এ মেয়েটির সঙ্গে তার কি আগে থাকতেই আলাপ হয়েছিল? সে রকম কোনো লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। দুজন দাঁত ভাঙ্গা তত্ত্ব নিয়ে আলাপ চালাচ্ছে কিন্তু কেউ কাউকে একবার নাম বা পদবী ধরেও সম্বোধন করে নি। তাতে দুজনেই দুজনের অজানা বলেই ধরে নিতে হয়। কিন্তু সে রকম হলে শিষ্টাচার মত আলাপের আগে পরাশরের পরিচয়টা দেওয়া নেওয়াই উচিত ছিল। তার বদলে খানিকটা বসে থাকবার পর কোন রকম ভূমিকা না করেই দুজন কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে। কথা আগে বলেছে অবশ্য মেয়েটি। আমাদের আগে থাকতে সেই ঘরের মেঝেয় বসেছিল। মেয়েতি আগে কথা বলতে পরাশরের পক্ষে সুবিধে হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু মেয়েতি অচেনা অজানা একজনের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলল কি করে? এটা কি তার আধা হিপি হওয়ার লাইসেন্স! না আচার্যদেবের পাঠাগারের আবহাওয়ারই ওটা গুণ? এর ভেতর এসে বসলে ও সব ভুয়ো আদব-কায়দার কোনো মানে থাকে না। পরাশর আর মেয়েটির সোজাসুজি আলাপ শুরু করতে তাই বাধেনি।
মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও সে যে পরাশরের অচেনা নয় তা অবশ্য কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই বোঝ শক্ত হয় নি। পরাশর কোথাও না কোথাও মেয়েটিকে দেখেছে আর তারপর তার সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ খুঁজে আচার্যদেবের বাড়িতে আজ এসে হাজির হয়েছে। আগে থাকতে মেয়েটিকে না চিনলে আমাকেও আজ সঙ্গে করে ধরে আনার মান থাকত না। নিজের পছন্দটা পরাশর আমাকে দিয়ে একটু যাচাই করাতেই চায়।