বারোহার এ প্রতিক্রিয়াটা পরাশর লক্ষ্য করল কিনা বুঝতে পারলাম না। ম্যানেজারের দিকে ফিরে সে তখন তাঁকে আরেকবার এলসার ঘরে ফোন করতে বলছে।
“আবার মিস এলসার ঘরে!” ম্যানেজার একটু আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলেন কিন্তু পরাশর সে আপত্তি খণ্ডন করে বললে, “এতক্ষনে মিস এলসা নিজের ঘরেই ফিরেছেন বলে মনে হচ্ছে। ওঁকে ফোন করে শুধু বলুন যে বিশেষ একটা জরুরী প্রয়োজেনে আপনি দুজন সঙ্গীকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে চান।”
“দেখা করতে যদি না চান?” রিসিভারটা তুলে ধরেও ডায়াল করবার আগে ম্যানেজার তাঁর সন্দেহটা জানালেন।
“আপত্তি করলে ভিন্ন ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আপত্তি করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।” আশ্বাস দিলে পরাশর।
পরাশরের আশ্বাস মতই এলসাকে ফোন করলেন ম্যানেজার। হঠাৎ তাঁর মুখে হিন্দী শুনে প্রথমটা অবাক হবার পরই মনে পড়ল এলসা ইংরেজী জানে না। ফোনে ম্যানেজারের কথা থেকে বোঝা গেল পরাশরের অনুমানই ঠিক। এলসা দেখা করতে আপত্তি জানাল না, একনকি দেখা করার উদ্দেশ্য বা ম্যানেজারের সঙ্গীদেরও নামও জানতে চাইল না।
এলসার কামরাতেই এবার গেলাম, যাবার আগে কামরা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বারোহা শুধু একটু ক্ষুণ্ণ স্বরে জানালে, “আপনাদের সঙ্গে আমিও যদি থাকতে পারতাম।”
“তার জন্যে দুঃখ করবেন না।” তাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেল পরাশর। “যা যা কথা ওখানে হবে সব আপনি আমার বা মিঃ ভদ্রের মুখে জানতে পারবেন। অচ্ছা শেষবার বলে যচ্ছি সাবধানে থাকবেন!”
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ১০
দশ
এবারে লিফট দিয়েই উঠে এলসার ঘরে পৌঁছোবার পর তার দরজায় বেল টিপতে হল না। দরজা খুলে এলসা নিজেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
ম্যানেজারের সঙ্গে আমাদের দেখে মুখে তার কোনো ভাবান্তর কিন্তু দেখা গেল না। ম্যানেজার দরজা থেকেই আমাদের পরিচয় দেওয়া শুরু করেছিল। এলসার কামরায় গিয়ে বসবার পর ম্যানেজার হঠাৎ হিন্দী ছেড়ে ফরাসী ধরায় প্রথমটা বেশ চমকেই গেলাম। তারপর ম্যানেজারের এ ভাষা বদলের মানেটা অস্পষ্ট রইল না।
ফরাসী আমি জানি না। তবে বলতে বা লিখতে না পারলেও দু’চারটে কথা একটু আধটু জানা আছে। ম্যানেজারের ফরাসীতে দখল আমার চেয়ে খুব বেশী নয়। তিনি কোনোরকমে ভুল ভাল শব্দ যা বোঝাবার চেষ্টা করলেন সেটা হল এই যে আমরা কোথা থেকে উড়ে আসা এক গা-জ্বালানো উপদ্রব। হোটেলের একটা সামান্য গোলমালের কথা কেমন করে জেনে ফেলে এখন জুলুম করে মাতব্বরি করছি। হোটেলের সুনামের খাতিরে আমাদের অত্যাচার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে। সেই জন্যেই বাধ্য হয়ে আমাদের আবদার শুনে এ সময়ে এঘরে আমাদের আসতে হয়েছে। মিস এলসা এ ত্রুটি যেন ক্ষমা করেন।
এলসা যেরকম নির্বিকার মুখ করে আমাদের দিকে একবারও না তাকিয়ে এসব কথা শুনে গেল ও তারপর একটু হাসি মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার উদ্দেশ্যে জানতে চাইল তাতে তার অভিনয় ক্ষমতারও তারিফ না করে পারলাম না।
এলসার হাসিমুখের প্রশ্নের উত্তরে পরাশর বেশ একটু নীরস গলায় যা বলল তাতে কিন্তু আমি রীতিমত স্তম্ভিত।
কোনোরকম ভণিতা না করে সে বললে, “হিন্দী, ফরাসী হয়েছে এবার সাধু বাংলায় আমাদের উদ্দেশ্যটা শুনুন। উদ্দেশ্যটা, আপনাকে এখনি এ হোটেল শুধু নয় এ দেশই ছেড়ে যেতে অনুরোধ করা।”
একথাতেও এলসার মুখের হাসি একটু মুছেও গেল না। আগের মতই প্রসন্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করলে, “এ অনুরোধের কারণ নিশ্চয় আছে?”
“তা আছে বইকি।” পরাশর গম্ভীর হয়েই বললে, “সেগুলো কি আপনি শুনতে চান?”
“হ্যাঁ, শুনলে নিজের সম্বন্ধে একটু জ্ঞান লাভ হতে পারে।”
“তাহলে এক এক করে শুনুন,” – পরাশর যেন আঙ্গুল গুনে বলতে আরম্ভ করলে, “আপনি ভারতীয় পুরাতত্ত্বের ছাত্রী নন, এলসা আপনার নাম নয়, আর্জেণ্টিনা থেকে আপনি আসেন নি।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান!” এলসা কথার মধ্যেই বাধা দিয়ে বললে, “আপনাদের পরিচয়ের ফিরিস্তি বেশ লম্বা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এসব কথা শোনাবার অধিকার আপনার কি যদি জিজ্ঞাসা করি?”
“তাহলে আপনাকে সোজা আমাদের সঙ্গে এখানকার হেড কোয়ার্টার্সে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।” পরাশর একটু কড়া গলাতেই বললে, “সেটা চাই না বলেই আপনাকে নিজর মান নিয়ে আগে থাকতে সরে পড়বার সুযোগ দিচ্ছি।”
“অনেক ধন্যবাদ!” এলসা হেসেই বললে, “তবে আমার প্রতি এই বিশেষ অনুগ্রহ কেন, সেটাও ত জানতে ইচ্ছে করে!”
“ধরুন, ধরুন…” পরাশরকে এবার জবাব দিতে থতমত খেতে দেখে উত্তরটা আমারই দিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল বলি, “অনুগ্রহের কারণ অসময়ে অপাত্রে একটু দুর্বলতা, এটা বুঝতে পারছেন না?”
আমার কিছু বলা হল না, পরাশরেরও তাই তোৎলামি সারলো না। তার আগে ম্যানেজার মিঃ সেঙ্গারই স্পষ্ট বিরক্তির সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠলেন। কথা বাঙ্গলা বোঝা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হলেও, কিছু কিছু শব্দ আর পরাশরের কথা বলার ভঙ্গি মানে তাঁর কাছে খুব অস্পষ্ট থাকে নি। পরাশর বিরূপ হতে পারে জেনেও, তাতে তিনি নিজের অধৈর্যটা গোপন করবার চেষ্টা না করে বললেন, “সকাল থেকে হোটেলের কাজ-কর্ম কিছুই আমার দেখা হয় নি। আপনাদের যা বলবার যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে মিস এলসাকে আর বিরক্ত না করে আমরা যেতে পারি।”
“না, না আপনি নারাজ হবেন না মিঃ সেঙ্গার!” পরাশর কিছু বলার আগে এলসাই আমাদের অবাক করে জানালে, “এঁরা আমার বন্ধু লোক। আপনার কাজ থাকলে মিছিমিছি আর আপনাকে আটকে রাখব না।”
“এঁরা বন্ধুলোক!” উচ্চারিত ভাষায় না হলেও মুখের ভাবে এই বিমূঢ় বিস্ময়টুকু পুরোপুরি ফুটিযে ম্যানেজার হতভম্বের মত চলে যাবার পর, পরাশরই প্রথমে মুখ খুলল। তার গলার স্বর কিন্তু আগের মতই রুক্ষ। জিজ্ঞাসা করলে, “আমরা যখন বন্ধুলোক তখন কালকের পার্টির রহস্যটা এবার একটু ভাঙবেন?”
“পার্টির রহস্য! পার্টির আবার রহস্য কি অছে? চারজনের একটু খেয়াল হয়েছিল তাই একসঙ্গে খেয়ে দেয়ে একটু আনন্দ করেছি।”
“আনন্দ করেছেন? আনন্দের পরিণাম কি হয়েছে তা কিছু জানেন? জানেন যে আপনি ছাড়া অপর তিনজন রাত্রে বেশ অসুস্থ আর অল্প বিস্তর বেহুঁশ হয়ে গিযেছিল।”
“তাই নাকি!” এলসা যেন অবাক, “আশ্চর্য! কই আমার ত কিছু হয় নি।”
“এই কিছু না হওয়াতা আশ্চর্য শুধু নয়, আরও কিছু।”
“আরো কিছু!” এলসা ভুরু কোঁচকালে, “আরো কি?”
“রীতিমত সন্দেহজনক।”
এলসা এ কথায় কি বলতে যাচ্ছিল পরাশর তাকে হাত তুলে থাম্যে বললে, “শুনুন মিস এলসা। মিছে কথা কাটাকাটি করে কোনো লাভ আর নেই। আপনার সম্বন্ধে যা কিছু জানবার আমাদের জানা হয়ে গেছে। অভিযোগের ফিরিস্তি আপনার বিরুদ্ধে সত্যিই অত্যন্ত লম্বা, সেগুলি মুখে বলার সময় না নিয়ে কাগজে এই লিখে এনেছি।”
পকেট থেকে সত্যিই একটা লম্বা খাম বার করে এলসার হাতে দিয়ে পরাশর বললে, “ধীরে সুস্থে এতা পড়বার সুযোগ খানিক বাদেই আপনাকে দেবো। তার আগে আপনার কামরাটা একটু সার্চ করতে চাই।”
“সার্চ করবেন আমার ঘর!” এলসা যেন অবাক, “সার্চ করবার তল্লাসী পরোয়ানা এনেছেন?”
“আপনার মত মেয়ের ঘর তল্লাস করবার জন্যে সার্চ ওয়ারেণ্ট লাগে না।” পরাশর তাচ্ছিল্যভরে বললে, “তাছাড়া আমি শুধু আপনার এ কামরায় দেরাজ আলমারীগুলো দেখব। লুকোবার মত কিছু থাকলে আপনি তা সরিয়ে রাখতে পারেন।”
“না, সরিয়ে রাখবার আমার কিছু নেই। আপনি ইচ্ছে করলে সমস্ত কামরাই খুঁজে দেখতে পারেন।” রেগে উঠেই যেন এলসা ঢালাও স্বাধীনতা দিলে পরাশরকে।