এই পর্যন্ত শুনেই বারোহা একটু যেন লজ্জিতভাবে বাধা দিয়ে বললেন, “অজ্ঞানই কি হয়ে গিযেছিলাম? কে জানে! আমার কিন্তু রিসেপশনে ফোন করার কথাও কিছু মনে নেই।”
ম্যানেজারকেতার পর একটু আশ্বাস দেবার চেষ্টা করলে বারোহা, “যাইহোক, আমি যখন আর সাড়াশব্দ করিনি থখন আমার ফোনটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরেই করা বুঝেই নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।”
“তা কি পারি!” ম্যানেজা একটু ক্ষুভ স্বরেই প্রতিবাদ জানালেন, “আপনার বিষয়ে কি করা উচিত, সেইটেই তখন দারুণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িযেছিল। আপনি সত্যি অসুস্থ হলে যথাসাধ্য চিকিৎসা আর শুশ্রুষার ব্যবস্থা আমাদের না করলে নয়। অথচ আমাদের কোনো বোর্ডারকে মাঝরাতে বিনা কারণে জাগিয়ে বিরক্ত করার অধিকার আমাদের নেই। তবু মঁসিয়ে রেনোয়াও নিজের আর তার ভাগনীর অসুস্থ হওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক কিছু নয় বলেই ধরে নিতে বাধ্য হলাম। আপনাদের সম্বন্ধে হোটেলের দায়িত্ব খাবার আর পানীয় নিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানলাম আপনারা যা খেয়েছেন, তা একেবারে সন্দেহাতীতভাবে নিরাপদ নির্দোষ খাবার, কারণ সমস্ত হোটেলেই সেই এক খাবার পরিবেশিত হয়েছে আর তাতে বিন্দুমাত্র কুফল কারুর হয়নি।”
“খাবার না হলে দোষ কি তাহলে পানীয়ের?”
“সে সম্ভাবনাটা মাথায় এলেও আমল একরকম দিইনি বললেই হয়। আমাদের হোটেলের চেয়ে বিশুদ্দ্ব একেবারে সর্বশ্রেষ্ঠ পানীয় দেশবিদেশের সেরা হোটেলের পক্ষেও দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ এ হোটেলে প্রথম শ্রেণীর জিনিষ ছাড়া নিরেস কিছু এক ফোঁটাও কখনো আসে না।”
“তাহলে কি মাত্রার বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?”
“সত্যি কথা স্বীকার করছি, মিঃ বর্মা ভোর রাত্রে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমায় ফোন করার আগে ওদিক দিয়ে কিছু ভাবিইনি।”
“মিঃ বর্মা ভোরবেলা আপনাকে ফোন করেছিলেন? উনি হোটেলের এ ব্যাপারের কথা জানলেন কি করে?” আমার বিস্মিত প্রশ্নটাই বারোহার মুখ দিয়ে বার হল।
“হ্যাঁ!” ম্যানেজার বিমূঢ় মুখেই স্বীকার করলেন, “ওঁর ফোন পেয়ে আমি ঐ কথা ভেবেই বেশী হতভম্ব হয়েছি। প্রথমে অবশ্য অধিকারের বাইরে এরকম নাক গলাবার স্পর্ধার জন্যে ওঁকে জাহান্নমে বলার ইচ্ছেই হয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি ওঁর যুক্তি শুনে ওঁর প্রস্তাবে রাজী না হয়ে পারিনি।”
“কি যুক্তি দিয়েছেন মিঃ বর্মা! আর কি প্রস্তাব করেছেন?” এবারও আমার কৌতূহলটাই প্রকাশ করলে বারোহা।
আমাদের মত হোটেলের সুনামের পক্ষে এরকম ঘটনা যে অত্যন্ত সর্বনাশ ক্ষতিকর, আর তার মূলে কি আছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বার করে সে জট যে নিঃশব্দে এখনি সরিয়ে ফেলা দরকার, তা জানিয়ে উনি আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছেন।
“সে-সাহায্য আপনার পক্ষে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়, বুঝতে পারছি,” নিজের অসুস্থতা যেন ভুলে গিয়ে একটু হেসে উঠে বললেন বারোহা। “কিন্তু এখনো সেই প্রশ্নটাই উত্তর পাওয়া গেল না। মিঃ বর্মা হোটেলের ও ব্যাপারের কথা রাত না পোহাতে জানলেন কি করে? হোটেলের অন্য কোন বোর্ডারও ত এখনো এ বিষয়ে বোধহয় কিছু জানে না।”
“তা ত জানেই না।” ম্যানেজার বললেন, “তবু মিঃ বর্মা কেমন করে হোটেলের বাইরে থেকে এ খবর পেলেন উনি আসামাত্র আমি জিজ্ঞাসা করেছি। তাতে উনি যা উত্তর দিয়েছেন ওঁর মুখেই শুনুন।”
“সত্যি রহস্যটা কি তা বলবেন মিঃ বর্মা।” জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৯
নয়
“রহস্যটা জানতে চন?” বেশ একটু গম্ভীর মুখে বললে পরাশর, “তাহলে শুনুন। এসবকিছু জানতে পেরেছি জ্যোতিষের গণনায়।”
“জ্যোতিষের গণনায়!” বিস্ময় আমিও প্রকাশ না করে পারলাম না।
“হ্যাঁ, জ্যোতিষের গণনায় । এই দেখুন না জ্যোতিষের আর একটা গণনার কথা আপনাদের শোনাচ্ছি।” পরাশর আমার কাছ থেকে গালা দেওয়া খামটা চেয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ভেতরকার কাগজটা পড়তে পড়তে বললে, “আপনাদের হোটেলের দোতলার সবচেয়ে ভালো স্যুইটটা আজ খালি হবার কথা আছে। কিন্তু তা হবে না। মিঃ র্যা থবোন আর তাঁর স্ত্রী আরো পাঁচদিনের জন্যে স্যুইটটা বুক করবেন অর তার মধ্যে ওঁদের একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা। সেইটেই ঠেকাবার জন্যে আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।”
“আপনি জ্যোতিষের গণনার জোরে এসব ভবিষ্যদ্বাণী করছেন!” বারোহা বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়েই জিজ্ঞাসা করলে। “র্যা থবোন দম্পতির মধ্যে দুর্ঘটনাটা কার হবে আর কি ধরণের তা আপনার জ্যোতিষের গণনায় কিছু পাচ্ছেন?”
“গণনা ত আমার নয়!” পরাশর তার হাতের কাগজতা দেখতে দেখতে বললে – “আমি একজন অসামান্য জ্যোতিষীর কাছ থেকে এসব ‘টিপস’ মানে হদিস পাই। তাঁর এ কাগজ থেকে যা পাচ্ছি তাতে দুর্ঘটনা মিস্টার বা মিসেস র্যা থবোন যে কোনো জনেরই হতে পারে। দুজনেরই একসঙ্গে হওয়া অসম্ভব নয়। আর দুর্ঘটনাটা আপনাদের যা হয়েছে তারই একটু বড় সংস্করণ।”
“তার মানে?” বারোহা আর ম্যানেজার দুজনেই প্রায় একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন। “এ হোটেলে আবার এইরকম বিষক্রিয়া গোছের ব্যাপার দেখা যাবে আর তা হবে আরো গুরুতর।”
একটু থেমে বারোহা একটু তীক্ষ্ণস্বরেই পরাশরকে প্রশ্ন করলে, “এবারে আমাদের যা হয়েছে তা কোনো বিষ থেকেই হয়েছে বলে আপনি মনে করেন! কিন্তু বিষ আসবে কোথা থেকে? মিঃ সেঙ্গার সমস্ত খাদ্য আর পানীয়ই চেক করে গ্যারাণ্টি দিচ্ছেন। তাতে কোন বিষ থাকতেই পারে না।”
“তাতে না থাক।” পরাশর গম্ভীর হয়েই জানালে, “আপনারা যা খেয়েছেন পান করেছেন তার মধ্যেই বিষ ছিল।”
“কেমন করে থাকবে।” বারোহা বেশ একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বললে, “আমাদের খাবার আর ড্রিংক বিষ দেবে কে, আর কি উদ্দেশ্যে।”
“তাই এখন খুঁজে বার করতে হবে!” বললে পরাশর।
“আপনি আমাদের হোটেলের রেস্তোরাঁর ওয়েটার বা বারবয়দের সন্দেহ করছেন কি?” মিঃ সেঙ্গার বেশ তীক্ষ্ণ স্বরেই জিজ্ঞাসা করলেন।
“না, তা করছি না।” শান্তভাবে জানালে পরাশর।
“তাহলে!” উত্তেজনায় বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ পেটে যেন একটা ব্যাথা বোধ করে বারোহা মুখটা একটু বিকৃত করে আবার বিছানায় বসে পড়ল।
“আপনি মিছিমিছি অত উত্তেজিত হবেন না মিঃ বারোহা।” পরাশর কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত করতে চাইলে।