পরশর নিজে গাড়ি রাখে না। সাধারণত দরকার হলে পাড়ার ট্যাকসি স্ট্যাণ্ড থেকে কোনো একটা গাড়ি আনিয়ে নেয়। পাড়ার গাড়ি সব তার চেনা। সেই জন্যে কার কোন ট্যাকসি নিয়েছে জানলে পরে খোঁজ-খবর নেবার সুবিধে হয়।
ফোনে এবার সেই কথাই জানতে চাইলাম, “কোন ট্যাকসি নিয়ে পরাশর বেরিয়েছে তা দেখেছ?”
“আজ্ঞে ট্যাকসিতে ত তিনি যান নি!”
“ট্যাকসিতে যান নি? তাহলে গেছেন কিসে?”
“আজ্ঞে বড় একখানা প্রাইভেট গাড়িতে। ভোরেই কাকে ফোন করে আনিয়ে রেখেছিলেন।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।” বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করলাম।
পরাশর মাঝে মাঝে তেমন দরকার হলে একটা গাড়ি ভাড়া দেওয়ার এজেন্সী থেকে ড্রাইভার সমেত প্রাইভেট ভালো গড়ি আনিয়ে ব্যবহার করে। আজও তাই করেছে। কিন্তু এই সাত সকালে ওরকম গাড়ি ভাড়া করার কারণটা কি? আর কারণ যাই হোক সে গাড়ি নিয়েও আমার কাছে এমন কথার খেলাপ করল কেন? আর কারণ যাই হোক আধঘণ্টার মধ্যে তুলে নিতে আসছে বলে আমায় তৈরী থাকতে বলাটা তার ঠাট্টা নিশ্চয় নয়!
রাস্তায় দুর্ঘটনা ছাড়া পরাশরের এই কথার খেলাপের আর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না ভেবে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমার বাড়ি থেকে তার বাসা পর্যন্ত ট্যাকসিতে খোঁজ করে আসব কিনা ভাবছি, এমন সময় টেবিলের ওপর ভাঁজ করা কাগজটা চোখে পড়ল। গত কাল পরাশর এইটেই আমার পকেটে গুঁজে দিয়েছিল আর সারা দিন সারা রাত চেষ্টা করেও আমি তার ছাপা ছবি আর নামের অংশটা আগে কোথায় দেখেছি স্মরণ করতে পারি নি।
মনের গতি বড় বিচিত্র। ধীর স্থির হয়ে অত ভেবে চিন্তেও যা বার করতে পারি নি এই উদ্বেগ অস্থিরতার মাঝে সেটা যেন মাথার ভেতর ঝিলিক দিয়ে ফুটে উঠল। ঐ মুখ আর বারবারা রেচিল নাম। ও ত আমার ভালরকম জানা। ভারতবর্ষের বড় বড় সব হোটেলে ট্যুরিস্ট সেজে যে দল অনেক সরল অন্য ট্যুরিস্টদের বিষ খাইয়ে বেহুঁশ করে সর্বস্ব চুরি করেছে মেয়েটি ত সেই দলের। পুরো নাম বারবারা রেচিল স্মিথ। বৃটেনে বাড়ি। চার্লস শোভরাজ নামে এক ধুরন্ধর শয়তানের সর্দারীতে আরো দুটি মেয়ের সঙ্গে বহুদেশে এ কাজ করে বেড়াবার পর ভারতবর্ষের দিল্লী শহরে এসে প্রথম ধরা পড়েছে। এদের সকলের ছবি ও শয়তানীর বিবরণ আমি এই কিছুদিন আগে পড়েছি। ঠিক এই বিবরণ ছপা কাগজের ফালিতে আমাকে পরাশরের চিঠিটি লেখার মধ্যে কোনো অস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে নাকি?
সেইটেই বোঝবার চেষ্টা করার মধ্যে ফোনটা বেজে উঠল।
বিদেশী মেয়ের যান্ত্রিক কণ্ঠ, “মিঃ ভদ্র আছেন?”
বুঝলাম কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের টেলিফোন অপারেটর আমায় খোঁজ করছে।
কেন করছে তা বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়েই বললাম, “হ্যাঁ, আছি। কোথা থেকে কে ফোন করছেন?”
“এইখানে কথা বলুন।” বলে অপারেটর ফোন ছেড়ে দিলে।
পর মুহূর্তেই পরাশরের গলা শুনলাম, কৃত্তিবাস! যা বলছি মন দিয়ে শোনো।”
পরাশরকে সুস্থ নিরাপদ জেনে তখন আমার আগেকার উদ্বেগ দুর্ভাবনাটা ক্ষোভ হয়ে উঠেছে।
“তার আগে আমার কথা শোনো!” রীতিমতো ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম, “আমাকে সাত সকালে ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে এমন মিছিমিছি তৈরী থাকতে বলার মানে কি? তুমি…”
আমার ঝাঁঝালো গলার জবাবে পরাশরের একটু বেশীরকম গম্ভীর শান্ত গলা — “সব পরে জানতে পারবে। এখন ভালো করে শুনে নাও যা বলছি। খানিকক্ষণ বাদে তোমার কাছে একটা বড় গাড়ি যাচ্ছে। তুমি যেন বিদেশে কোথাও যাচ্ছ এমনভাবে সাজ পোষাক সরঞ্জাম নিয়ে সে গাড়িতে চলে আসবে। বিদেশে যাবার লাগেজ তোমার আছেই। যা হোক কিছু ভরে সেগুলো সঙ্গে নেবে। পাসপোর্ট আনতেও ভুলো না।”
“তা না হয় ভুলব না।” হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু এ গাড়িতে করে যেতে হবে কোথায়?”
“যাবে, কাল যেখানে গিয়েছিলে সেই পাঁচতারা মার্কা হোটেলে। কোনো ভাবনা নেই। তোমার ঘর রিজার্ভ করা আছে। তুমি এসে লবির কাউণ্টারে দাঁড়ালেই হবে। আমি নিজে সেখানে থাকব। আর একটা কথা। আসবার সময় জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজের বাড়ির সামনে গাড়িটা একটু দাঁড় করাবে। তোমায় নামতে হবে না। শঙ্কর মহারাজেরই অনুচরদের কেউ তোমার হাতে একটা সীলকরা খাম দিয়ে যাবে। সেইটে নিয়ে আসবে।”
“শোনো পরাশর…”
শোনবার ওদিকে কেউ নেই। পরাশর যথারীতি কথা শেষ করেই ফোন নামিয়ে রেখেছে।
কিন্তু এ আমায় কি দারুণ সমস্যায় সে ফেললে। যেন বাইরে কোথাও যাচ্ছি এমন ভাবে সাজসরঞ্জাম নিয়ে পাঁচতারার হোটেলে গিয়ে ওঠা, সেখানে আবার আমার জন্যে আগে থাকতে ঘর রিজার্ভ হয়ে থাকা, তার সঙ্গে ঐ বুজরুক জ্যোতিষ চক্রবর্তীর দেওয়া গালা আঁটা এক চিঠির বাহক হওয়া, — এসব কিছুর মানে কি! কাল যাকে পরাশরের প্রেমাস্পদই বলে ভেবেছিলাম, সেই ভারতীয় পুরাতত্ত্বের ছাত্রী এলসা, এই খানদানী হোটেল, জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজ, আর – আর — এই ছেঁড়া কাগজের ছবি আর নামটার মধ্যে কোনো ভেতরের সম্পর্ক আছে কি?
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৭
সাত
ঠিক ঐ কথাই ভাবতে ভাবতে নয় কেমন একটু বিভ্রান্ত অবস্থায় মাঝপথে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে তাঁর পাঠিয়ে দেওয়া গালা-আঁটা খামটা নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে যখন গিয়ে পৌঁছ্হোলাম, তখন হোটেলের বাইরে বা ভেতরে অস্বাভাবিক কোনো কিছুই কিন্তু দেখতে পেলাম না। সকালের দিকে এ ধরণের বড় হোটেলে যে একটা প্রায় নিঃশব্দ ব্যস্ততা থাকে তার বেশী সেখানে কিছুর চিহ্ন নেই। লবির কাউণ্টারে পরাশর সত্যিই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে একা নয় তার সঙ্গে আরেকজনও আছেন।আমি গিয়ে দাঁড়াতেই পরাশর পরিচয় করিয়ে দিলে। “মিঃ ভদ্র, মিঃ সেঙ্গার – হোটেলের ম্যানেজার।”
ম্যানেজার সেঙ্গার ভারতীয় কিন্তু পোষাক-আশাক চাল-চলন এমনকি চেহারা দেখেও তা বোঝা খুব সহজ নয়। বছর চল্লিশের অত্যন্ত সুঠাম, আর যাকে বলা যায় ব্যায়াম-সাধা মজবুত চেহারা। রংটা ইউরোপীয়দের মতই প্রায় ফর্সা হওয়ার দরুণ ভুলটা সহজেই হতে পারে।
তিনি একটু হেসে করমর্দনের বদলে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ইংরেজীর বদলে হিন্দীতেই বললনে, “আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি মিঃ ভদ্র। আপনার কামরা ঠিক করাই আছে। আশা করি আপনার কোনো অসুবুধে হবে না।”