- বইয়ের নামঃ প্রেমের প্রান্তে পরাশর
- লেখকের নামঃ প্রেমেন্দ্র মিত্র
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০১
প্রেমের প্রান্তে পরাশর
প্রেমেন্দ্র মিত্র
[প্রেমেন্দ্র মিত্রঃ জন্ম ১৯০৪; মৃত্যু ১৯৮৮। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্রকার । ১৪-টি চলচ্চিত্রের পরিচালক, চিত্রনাট্য লিখেছেন অজস্র। ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থ লিখে পান আকাদেমি পুরস্কার ও রবীন্দ্রপুরস্কার। বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনকে সাহিত্যের মর্যাদা তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন ঘনাদাকে সৃষ্টি করে। গোয়েন্দা সাহিত্যর ওঁর অবদান পরাশর বর্মা। পরাশর বর্মার বই মূলতঃ বড়দের জন্যে লেখা, তাই কিশোরদের গোয়েন্দাকাহিনী সংগ্রহে পরাশর বর্মাকে চোখে পড়ে না। ‘প্রেমের প্রান্তে পরাশর’ উপন্যাসটি এ. মুখার্জী এণ্ড কোং প্রকাশিত ‘পরাশর সমগ্র’ থেকে নেওয়া। এটি এখানে ছাপানোর অনুমতি দিয়ে তার কর্ণধার রঞ্জন সেনগুপ্ত আমাদের বাধিত করেছেন।]
এক
“চন্দ্রগোমীর ব্যাকরণের কোনো খণ্ডিত পুঁথি কি এখন পাওয়া যায়?
বৈয়াকরণ শাকটায়ন যে চান্দ্র ব্যাকরণের কাছে ঋণী, সে-ব্যাকরণ কি চন্দ্রগোমীরই রচিত ‘সংজ্ঞক ব্যাকরণ’
চদ্রগোমী কি সত্যিই নাগার্জুন শূন্যবাদের অনুগামী চন্দ্রকীর্তির শিষ্য?”
ওপরে যা লেখা হয়েছে তা পড়তে পড়তে মাথা যদি কারুর একটু গুলিয়ে যায় তাহলে তাকে দোষ দেবার কিছু নেই। গোয়েন্দা গল্প পড়তে বসে ভুল করে পুরাতত্ত্ব গবেষণার কোনো সন্দর্ভের পাতা খুলে ফেলা হয়েছে বলে যদি সন্দেহ হয়, সেটাও সহজেই মার্জনীয়। ওরকম সন্দেহ হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। আমারও হয়েছিল। আর কাগজে ছাপার অক্ষরে ঐ কথাগুলি পাঠ করে নয়, ভারতবর্ষের সর্বজনবিদিত বিখ্যাত এক আচার্য পণ্ডিতের পাঠাগারে মেঝের ওপর পাতা বিচিত্র নকসার চৈনিক মাদুরে বসে নিজের কানে পরাশর বর্মা আর আমি ছাড়া ও-কক্ষের তৃতীয় ব্যক্তির মধ্যে প্রশ্নোত্তরে ঐ জাতীয় আলোচনা শুনে।
আচার্যদেব তখনও এ ঘরে আসেননি। তাঁরই অপেক্ষায় আমরা তিনজন তাঁর পাঠাগারে বসে আছি। কিন্তু আমি ঠিক আচার্যদেবের অপেক্ষায় বসে আছি বললে সত্যের একান্ত অপলাপ হবে। আমি তাঁর জন্যে এখানে অপেক্ষা করে নেই, তাঁর দেখা পাওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নিয়ে এখানে আসিও নি।। তবু কেন যে এই সমাবেশে আমি উপস্থিত তা আশা করি ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না। হ্যাঁ, পরাশরের জন্যেই আমার এই বিড়ম্বনা। সে নাছোড়বান্দা হয়ে একরকম জোরজুলুম করে আমায় ধরে নিয়ে এসেছে। আসবার আগে অবশ্য প্রলোভন দেখিয়েছে অনেক। তার সঙ্গে গেলে নাকি এমন কিছু জানতে শুনতে পারব যা আমার সমস্ত অভিজ্ঞতার বাইরে। যেন সে আশ্বাসের গ্যারান্টি হিসেবেই আমার পকেটে একটা ছোট খাম গুঁজে দিয়ে বলেছে, – এখন থাক। সময় পেলে আজ রাত্রে পড়ে দেখো। তবে এসব ভুজুং ভাজুং-এ অনায়াসে আমি বশ হতে পারতাম, কিন্তু হাতের একটা জিনিষ দেখে আমার টনক গোড়াতেই নড়ে গেছে। সন্ত্রস্ত হয়ে তার সব সাধাসাধি আর লোভ দেখানো তাই ঠেকাতে চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য।
পরাশরের হাতে যে জিনিষটি দেখেছিলাম সেটি একটি বই। ছোটখাটো চটি পকেট বই নয়। রঙিন মন-মাতানো ছবির দেশি কি বিদেশী উপন্যাস টুপন্যাসও নয়। দাঁতভাঙানামের ভাষাতত্ত্বের একটা থান ইঁটের আকারের বই। পরাশরের হাতে কবিতার বইটা তবু কিছুটা গা সোয়া হয়ে গেছে, কিন্তু ভাষাতত্ত্বের কেতাবটা গোড়াতেই রীতিমত সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। পরাশর যেখানকার একেবারে সৃষ্টিছাড়া যে অভিজ্ঞতার লোভ দেখাচ্ছে ঐ ভাষাতত্ত্বের সঙ্গে তার কোন সংস্রব থাকলে আমার আর এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়। কিন্তু কে কার কথা শোনে। পরাশরের অনুরোধ কাটাবার সমস্ত চেষ্টা যে বিফল হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে যাঁর বাড়িতে এসে একাধারে তাঁর পাঠাগার ও বসবার ঘরে মেঝের মূল্যবান মাদুরের আসনে বসে আছি, পুরাতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের অদ্বিতীয় পণ্ডিত হিসাবে তাঁর খ্যাতি ভারতের বাইরে সারা বিশ্বে ছড়ানো। নাম না করলেও অনেকেই হয়ত বুঝতে পারবেন বলে নামটা আর করলাম না। আচার্যদেবের পাঠাগারে বসে আছি খুব কমক্ষণ নয়। পরাশরের তার পণ্ডিতি আলোচনায় মগ্ন হয়ে সময়ের খেয়াল হয়ত নেই, আমি কিন্তু ঘরে ঢোকবার পর থেকে দরজার মাথায় দেয়াল ঘড়িটার ওপর আগাগোড়াই নজর রেখেছি। তাতে এক মিনিট দু মিনিট করে পুরো সাতাশ মিনিট এ পর্যন্ত কেটেছে। শুধু ঘড়ির কাঁটার দিকে অবশ্য নয়, পরাশরের সঙ্গে যিনি এইসব দাঁতভাঙা আলোচনা চালাচ্ছেন ঘরের সেই তৃতীয় ব্যক্তিটির দিকেও মনোযোগ না দিয়ে পারি নি। মনোযোগ দেবার মতই ব্যক্তি অবশ্য। শুধু মনোযোগ দেবারই নয়, বেশ একটু বিস্মিত কৌতূহল অনুভব করবারও। ব্যক্তিটি পুরুষ নয় নারী, এবং বাঙালী বা ভারতীয় নয়, বিদেশী যুবতী।
বিদেশ বলতে কোন দেশের তা অবশ্য তাঁকে দেখে বলা সম্ভব নয়। তাঁর পোষাকটা আর একটু বেখাপ্পা হলে তাঁকে বিশ্ব নাগরিক হিপি ভাবা যেত। কিন্তু দেশী-বিদেশীর অদ্ভুত সংমিশ্রণ হলেও সে পোষাকে সযত্ন অযত্নের ছাপ নেই। একটু যেন জীর্ণ পুরোনো মনে হলেও নিম্নাঙ্গের ঢলঢলে সায়ার মত আবরণ আর উর্দ্ধাঙ্গের বেদিয়ানী কোর্তার ধরণের পোষাক দুটি নোংরা ময়না নয় বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মাঠায় চুড়ো বাঁধা সাদাটে যাকে বলে প্ল্যাটিনাম চুলে পারিপাট্য না থাকলেও একটু ছিরি ছাঁদ আছে আর প্রসাধন বিহীন মুখখানাও শ্রীহীন নয়। কোন দিক দিয়েই নিখুঁত না হলেও গড়ন পেটন সবশুদ্ধ জড়িয়ে যত ক্ষীণই হোক কেমন একটু মোহিনীভাবই মেয়েটির আছে বলে মনে হয়।
এ সব দিযে আর যাই হোক তাঁর জাতি কুলশীল ত’ জানা যায় না। পোষাক চেহারা দিয়ে যা সম্ভব নয় তার ভাষা দিয়ে তা বুঝব তারও উপায় নেই। বিদেশী মেয়েটি ইউরোপীয় কোনো ভাষায় নয়, কথা বলছে আমাদেরই বাংলা ভাষায়। এবং বলছে একেবারেই স্বচ্ছন্দে। উচ্চারণে সামান্য একটু আধটু আড়ষ্টতা আর টান অবশ্য আছে। কিন্তু তা থেকে তার মাতৃভাষা অনুমান করবার মত ক্ষমতা আমার অন্তত নেই। দেয়াল ঘড়িতে সাতাশ মিনিট আধ ঘণ্টায় গিয়ে পৌঁছেছে ইতিমধ্যে। আচার্যদেব আজ আর কখন আসবেন। তার এত দেরী করার কারণ কি।