কেরীরা দেখতে পেল তখনও অত বেলাতেও দোতলার অধিবাসীরা রাত-পোশাক ছাড়ে নি, অনেকে বারান্দায় দ্রুত পায়চারি করে ঘুমের জের কাটাবার চেষ্টা করছে।
রাস্তার দু-পাশেই যে টানা বাড়ির শ্রেণী এমন নয়, মাঝে মাঝে জলা ও আগাছার জঙ্গল আর পতিত জমি। ডানদিকে এমনি একখণ্ড স্থান দেখে কেরী বলে উঠল—এখানে দিব্য একটি গিজা গড়া যেতে পারে।
মিসেস কেরী বলল, আগে আমাকে বাসায় পৌঁছে দাও, তার পর বসে বসে যত খুশি গির্জা গড়িও।
কেরী বলল, বাসাতেই তো ফিরছি।
গাড়ি যতই পুবদিকে চলতে লাগল ততই বাড়ির সংখ্যা কমে পতিত জমির আয়তন বাড়তে লাগল।
এমন সময়ে একটা শেয়াল পথটা অতিক্রম করে অন্যদিকে চলে গেল।
মিসেস কেরী বলে উঠল-দেখ দেখ, একটা নেকড়ে বাঘ!
কেরী বলল-না ডিয়ার, এটা একটা শেয়াল।
নিশ্চয়ই শেয়াল নয়, নেকড়ে; তুমি আমাকে বৃথা আশ্বাস দিচ্ছ।
তখন টমাস, রাম বসু ও পার্বতী একযোগে সাক্ষ্য দিল, বলল, না, ওটা শেয়াল ছাড়া কিছু নয়।
কিন্তু এত সহজে সমস্যার সমাধান হল না; মিসেস কেরী বলে উঠল, তবে তো এখনই বাঘ বেরুবে, কারণ আমি বই-এ পড়েছি শেয়াল হচ্ছে বাঘের অগ্রদৃত। এই কোচম্যান, গাড়ি জোরে হাঁকাও।
অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়ি মারহাট্টা ডিচের প্রান্তে এসে পড়ল—সেই বৃহৎ বটগাছটার তলায়।
টমাস বলল, ডাঃ কেরী, এই সেই বিখ্যাত মারহাট্টা ডিচ।
মারহাট্টাদের ভয়ে খনন করা হয়েছিল বুঝি?
হাঁ, ঠিক তাই।
এ খাল কি কলকাতাকে পরিবেষ্টিত করেছে?
সেইরকমই কথা ছিল, কিন্তু এর মধ্যে মারহাট্টা হাঙ্গামা থেমে গেল–তাই খালটাও জানবাজার রোড পর্যন্ত এসে থেমে গেল।
আর এই রাস্তাটা?
টমাস বলল-খালের পশ্চিমদিক বরাবর চলেছে, খালের মাটি তুলে তৈরি। সকালে বিকালে হাওয়াখখারের দল এখানে ভিড় করে।
বাপ রে, কি প্রকাণ্ড গাছ! বলে কেরী।
এ হচ্ছে গিয়ে ভারতের বিখ্যাত বেনিয়ান ট্রি। কলকাতা অভিযানের সময়ে এই গাছটার তলাতে বসে নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কেল্লা আক্রমণ দেখেছিল—ঐ দেখ, কেল্লার ফটক দেখা যাচ্ছে।
সকলেই দেখল—হাঁ, দি অ্যাভিনিউ বরাবর কেল্লার ফটক দেখা যাচ্ছে বটে। বটগাছটা ও কেল্লার ফটক সমসূত্রে স্থাপিত।
টমাস বলল, ডাঃ কেরী, এবারে ফেরা যাক, মিসেস কেরী বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
কেরী বলল, আমি তাই বলব ভাবছিলাম, এখন ফিরে যাওয়াই ভাল।
তখন গাড়ি আর একটু দক্ষিণে গিয়ে জানবাজার রোড দিয়ে চৌরঙ্গীর মুখে ফিরল।
কিন্তু আমি ভাবছি, জনদের গাড়ি গেল কোথায়?
মিসেস কেরী বলল, তারা তো খ্রীষ্টীয় প্রচারক নয়, এতক্ষণ নিশ্চয় বাড়ি ফিরে গিয়েছে।
সকলেই বুঝল—যে কারণেই হক, মিসেস কেরীর মেজাজ আজ ভাল নেই, তাই কেউ আর আলাপের কোন প্রসঙ্গ তুলল না। গাড়ি জানবাজার রোড ধরে, গোপী বসুর বাজারের পাশ দিয়ে যখন চৌরঙ্গী রোডে পড়ল তখন সবাই দেখল—
১.১১-১৫ কেরীর আবিষ্কার
চাকাওয়ালা একটা প্রকাণ্ড কাঠের খাঁচা দেশী আর ফিরিঙ্গি পুলিসে মিলে চৌরঙ্গী রোড বরাবর দক্ষিণদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, পিছনে চলেছে এক চুলি, সে মাঝে মাঝে ডুগ ভুগ করে ঢোলে বাড়ি দিচ্ছে আর সঙ্গে জুটে গিয়েছে নানা বয়সের একদল লোক, পথে যেমন সর্বত্র জুটে থাকে।
কেরীরা আরও দেখল খাচার মধ্যে দশ-বারো বছর বয়সের একটি বালক উপবিষ্ট, জীর্ণ তার পোশক, মলিন তার চেহারা—কিন্তু মুখে বেশ সপ্রতিভ ভাব। তার মুখ দেখলে মনে হয়, তার জন্যেই এত আয়োজন হওয়ায় সে যেন বেশ একটু গৌরব বোধ করছে কৌতুক, কৌতূহল আর গৌরববোধ একসঙ্গে ফুটে উঠেছে তার মুখে চোখে।
কেরী শুধাল, ব্যাপার কি?
টমাস বলল, লোকটা আসামী, কোন অপরাধের জন্য ওকে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
এ কি রকম দণ্ড? আর ওর অপরাধটাই বা কি?
রাম বসু বলল, হয়তো কিছু চুরি করেছে; হয়তো কোন সাহেবের ক্রীতদাস, পালিয়েছিল, এখন ধরা পড়ে দণ্ড ভোগ করছে।
কেরী বলল, জানবার উপায় নেই কি? আমি বড় কৌতূহল অনুভব করছি।
খুব জানা যায়, বলে রাম বসু ঢুলিকে ডাকল। সাহেব দেখে ঢুলি তাড়াতাড়ি এল আর লম্বা সেলাম করে দাঁড়াল।
রাম বস বলল, সাহেব জানতে চাইছেন, ছেলেটার কি অপরাধ?
ঢুলি সাহেবের উদ্দেশে রাম বসুকে বললে, হুজুর, ছোঁড়াটা মানি সাহেবের ‘সিলেভ’–
রাম বসু বুঝিয়ে দিল—‘স্লেভ’, ক্রীতদাস।
ঢুলি বলে চলল, মাতুনি সাহেব কুড়ি টাকা দিয়ে ওটাকে কিনেছিল। কিন্তু কুড়ি পয়সার কাজ করবার আগেই ছোঁড়া কদিন আগে পালিয়েছিল। ধরা পড়েছে কাল।
এখন? সাহেবের হয়ে শুধায় রাম বসু।
এখন যা দেখছেন তাই। তামাম শহর ঘোরানো হবে, তার পর ওর পিঠে পড়বে পঁচিশ ঘা চাবুক, তার পর ওকে আবার হাওলা করে দেওয়া হবে মানি সাহেবের সর্দার-খানসামার কাছে।
তার পর?
তার পর ব্যস, চুকে গেল।
সমস্ত ব্যাপারটা শুনে কেরীর চোখ ছলছল করে এল। সে বলল, ব্রাদার টমাস, কি ভয়ানক অবস্থা!
টমাস এ রকম অবস্থার সঙ্গে দীর্ঘকাল পরিচিত। সে বলল, এমন তো চলছে দীর্ঘকাল ধরে।
আর একদিনও চলতে দেওয়া উচিত নয়।
টমাস বলল, খ্রীষ্টধর্ম প্রচার হলেই এসব নৃশংসতা ক্রমে কমে আসবে।
কিন্তু তার অনেক আগেই যে ওর পিঠে পড়বে পঁচিশ ঘা চাবুক।
অবশ্যই পড়বে, ওরা সব ক্ষুদে শয়তান-বলল মিসেস কেরী।
বল কি ডরোথি, ঐ কোমল পিঠে কড়া চাবুক পড়লে কি থাকবে?