সমগ্র জনতার সমবেত হায় হায় ধনির মধ্যে অগ্নিবলয় গ্রাস করল রেশমীকে। এমন বহ্নিয়ন বিবাহের দিব্য দুকুলে তার দিব্য অঙ্গ মণ্ডিত, অগ্নিশিখার বলয় তার বাহুতে, অগ্নিশিখার কুণ্ডল কর্ণে, অগ্নিশিখার সিথি সীমন্তে, অগ্নিশিখার স্বর্ণহার তাব কণ্ঠে, অবশেষে স্বয়ং অগ্নিদেব স্বর্ণোজ্জ্বল কিরীটী পরিয়ে দিলেন তার শিরে।
একবার সে চীৎকার করে বলল, জন, সেদিনের সেই কথাটা—
আর কিছু শোনা গেল না, শেষ হল না সেই কথাটা।
মানুষের শেষ কথাটা আর শেষ হল না।
অগ্নিশিখা নিস্তেজ হয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে তারাগুলোর জ্যোতি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে লাগল। জগতে ওদের ভাষাটাই সত্য। আগুন নিভে আসতেই চারদিক গাঢ়তর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হল। তখনও শেষ দু একটা লকেট কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ‘রেশমী’ অক্ষরের আঁচড় একবারে মিলিয়ে যায় নি আকাশের পট থেকে।
৫. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ
কি, চারদিক যে বড় নীরব, পাখানগুলো সব গেল কোথায়—বলতে বলতে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বিপুল দেহ টেনে নিযে ঘরে প্রবেশ করে।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রথম পণ্ডিত। বিপুল তার দেহ, বিপুল তার পাণ্ডিত্য, লোকে বলে ঐ প্রকাণ্ড পেটটা বিদ্যায় ঠেসে ভর্তি করা। বিদ্যালঙ্কার ঘরের কোণে নিয়মিত স্থানে হাতের মোটা লাঠিটা রেখে দেয়, তার পরে বিস্তৃত ফরাসের উপরে বসে পড়ে পাঙ্খাপুলারদের উদ্দেশে বলে ওঠে, একটু জোরে টান বাবা, ঘামটা মরুক।
দ্বিতীয় পণ্ডিত রামনাথ বাচস্পতি নস্যের ডিবেটা সরাতে সরাতে বলে, এস ভায়া, তোমার তো আবার এর গন্ধটা পর্যন্ত সহ্য হয় না।
সহ্য হয় না সাধে! ও বস্তু নাসাতে গ্রহণ করলে পুষ্পের ঘ্রাণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
পড়লেই বা ক্ষতি কি? এর ঘ্রাণটাও তো মন্দ নয়?
চাদরের প্রান্ত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে বিদ্যালঙ্কার, দেবতার নির্মাল্যের গন্ধ যদি না পেলাম, তবে তো জীবন বৃথা।
তার পরে প্রসঙ্গ পালটিয়ে বলে, আজ যে সব নীরব, ব্যাপার কি?
ব্যাপার তো আমিও বুঝতে পারছি না, এসে দেখি সব ভোঁ ভোঁ, জনপ্রাণী নেই।
এসব রহস্য জানা তোমার আমার কর্ম নয় রামনাথ। বসুজা কোথায়? রাজীবলোচনকেও তো দেখছি না।
রামনাথ বলে, রাজীবলোচনের কথা বলতে পারি না, তবে বসুজা পাদ্রী কেরী সাহেবের ঘরে। সে এলেই সব জানতে পারা যাবে, ততক্ষণ ধৈর্য অবলম্বন কর।
মন্দ বল নি, যেমন গরম পড়েছে—এই বলে মৃত্যুঞ্জয় চাদরের প্রান্ত দিয়ে হাওয়া করে পাখার হাওয়াকে প্রবলতর করে তুলতে চেষ্টা করে।
এবারে রামনাথ বলে, এখানকার ফিরিঙ্গী পড়ুয়াদের তোমার ঐ হোলের লাঠিটাকে বড় ভয়।
সশব্দে হেসে উঠে মৃত্যুঞ্জয় বলে, হেতালের লাঠিই বটে! এই লাঠি দিয়ে গোখরোর বাচ্ছাদের শাসন করে রেখেছি।
কাজটা ভাল কর না হে বিদ্যালঙ্কার। দুদিন পরে এরা সব জঞ্জ-ম্যাজিস্টর হবে, তখন যে ওদেরই হাতে উঠবে হেন্তালের লাঠি।
এ তোমার ভুল বাচস্পতি। ছাত্রজীবনের শাসন উত্তরকালে ছাত্ররা মনে রাখে না। এই দেখ না কেন, সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে কসাইটোলা থেকে ফিরছিলাম, হঠাৎ সামনে এক ফিটন গাড়ি থেমে গেল। গাড়ি থেকে নামল এই কলেজের—তুমি যাকে বল বিরাট রাজার গোশালা—এক প্রাক্তন ফিরিঙ্গী ছাত্র-আমাকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাল।
কে হে লোকটা?
নামটা হচ্ছে থ্যাকারে, ছোকরাকে আমি বেশ চিনতাম। শ্রীহট্টের যে হাতীধরা থ্যাকলে ছিল, সে ওর কাকা কি জেঠা, বা ঐ রকম কি একটা।
হ্যাঁ, ফিরিঙ্গী বেটাদের কাকা-জেঠা, মামা-মেসো-পিসে সবাই ‘অঙ্কেল। যেমন জাত, তেমনি সম্বন্ধ-বিচার।
জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কি করছ? বলল, চব্বিশ পরগণার রাজস্ব-সংগ্রাহক, কলেকটার। তবেই দেখ, মনে রেখেছে! একদিন ওকেই এই কলেজে-ঘরে খুব ভৎসনা করেছিলাম—অথচ কেমন বিনয়ের সঙ্গে কথা বলল।
যাক ভাই, চাঁদ সওদাগরের হাতেই হোলের লাঠি শোভা পায়। আমার বোধ হয় কি জান, কেরী সাহেবও মনে মনে ভয় করে তোমার ঐ লাঠিগাছাকে। ঐ যে কেরী সাহেব ও বসুজা আসছে।
কেরী ও বসুজা প্রবেশ করে। রামনাথ উঠে দাঁড়ায়, বিদ্যালঙ্কার তত্তাপোশের উপরেই নড়েচড়ে বসে সম্মান জানায়।
কেরী দুজনের উদ্দেশে বলে, নমস্তে।
আগে সে গুড মর্নিং বলে অভিবাদন করত, এখন বিদ্যালঙ্কারের পরামর্শে দেশীয় অভিবাদনবাক্য উচ্চারণ করে।
বিদ্যালঙ্কার বলে, আজ সব নীরব কেন? ছাত্রেরা সব গেল কোথায়?
কেরী আসন গ্রহণ করতে করতে বলে, আজ ওরা আমাদের ছুটি দিয়েছে।
বিস্মিত বিদ্যালঙ্কার বলে, কেমন?
কেরী বলে, আজ ওরা সব ধর্মঘট করেছে।*
সে বস্তু আবার কি? শুধায় বিদ্যালঙ্কার।
কেরী বুঝিয়ে বলে, কর্তৃপক্ষের কোন আদেশ বা ব্যবস্থা পছন্দ না হলে হাত পা গুটিয়ে বসে থেকে আপত্তি জানানোকে স্ট্রাইক করা বা ধর্মঘট করা বলে।
সে তো বুঝলাম, বলে মৃত্যুঞ্জয়, কিন্তু এখানকার পাখানদের অপছন্দ কোন্ ব্যবস্থা?
তবে পূর্ব ইতিহাস বলতে হয়। আগে সিভিলিয়ান রাইটাররা শহরের যত্রতত্র বাড়ি ভাড়া করে থাকত। তার ফলে কামিনীকাঞ্চন-সংক্রান্ত দুনীতি বেড়ে যাচ্ছিল দেখে লর্ড ওয়েলেসলি ব্যবস্থা করে যে, সকলকে এই রাইটার্স বিল্ডিং-এর দোতলায় থাকতে হবে। এই ব্যবস্থার ফলে রাইটারদের মধ্যে দুনীতি অনেক কমে যায়।
মৃত্যুঞ্জয় বলে, সে তো অনেক দিনের কথা। এতদিন পরে হঠাৎ ওরা সচেতন হয়ে উঠল কেন?