দু’জনে ধানখেতে নেমে পড়ে। আলের ওপর দিয়ে ওপর দিয়ে খানিকটা গেলে মেঠো পথ পাওয়া যাবে।
চলতে চলতে বিনু বলল, তোমাকে ছোটদির বাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে না। আগরপাড়ায় গিয়ে কলকাতার ট্রেনে তুলে দিলেই চলবে।
যুগল বলল, শিয়ালদায় লাইমা টালিগুঞ্জে যাইতে পারবেন তো? তাকে বেশ চিন্তিত দেখায়।
বিনু বলল, কেন পারব না? শিয়ালদা থেকে ধর্মতলা। সেখান থেকে বাস পালটে কি ট্রামে টালিগঞ্জ।
ঠিকই বলেছে বিনু। তবু যেন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারে না যুগল, কুন কুন নম্বরের বাস ধরবেন কন দেখি–
বিনু বলল। যুগলের ভাবভঙ্গি স্নেহপ্রবণ অভিভাবকের মতো। বিনুর খুব হাসি পাচ্ছিল।
.
আগরপাড়া স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। অনেক আগেই কুয়াশা আর হিম পড়তে শুরু করেছে ঘন হয়ে। নেমে এসেছে আঁধারও।
টিকিট কেটে এনে প্ল্যাটফর্মের একধারে দাঁড়াল বিনু। পাশে যুগল।
এই সময়টা কলকাতার দিকের প্যাসেঞ্জার কম থাকে। প্ল্যাটফর্মটা প্রায় ফাঁকা। দূরে দূরে মিটমিটে আলো জ্বলছে। কুয়াশা এবং অন্ধকার সেগুলোর টুটি টিপে ধরে আছে।
টুকরো টুকরো নানা কথা বলতে বলতে যুগল হঠাৎ দ্বিধার সুরে জিজ্ঞেস করে, ছুটোবাবু, যদিন গুসা না করেন, একখান কথা জিগামু?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
ঝিনুক বইনের দুঃখুর কথা শুনাশুন আমাগো কানে আইছে।
সুধাদের বাড়িতে দু’বার যুগলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। মুকুন্দপুরেও এতটা সময় একসঙ্গে কাটিয়ে এল। কত গল্প হয়েছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও যুগল বুঝতে দেয় নি, ঝিনুকের লাঞ্ছনার কাহিনী সে জেনে গেছে। কিন্তু হঠাৎ এই প্রসঙ্গটা তুলল কেন? তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিনু।
যুগল বিমর্ষ সুরে বলল, যহন ঝিনুক বইনের কথাখান শুনলাম, বুক আমার ফাইটা গেছিল।
যুগলের কষ্টটা যে যথেষ্ট আন্তরিক তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিনু উত্তর দিল না।
যুগল এবার জিজ্ঞেস করে, ঝিনুক বইনেরে লইয়া এক রাইত এক দিন সুনীতিদিদির বাড়িত আছিলেন। ওনার শাউড়ি যা একখান মানুষ! ঝট করে নাই?
বিনু চমকে উঠল। হেমনলিনী ঝিনুকের সঙ্গে যে ভাল ব্যবহার করতে পারেন না, সেটা আন্দাজ করে নিয়েছে যুগল। আত্মীস্বজনদের সম্বন্ধে অপ্রিয় আলোচনা করতে রুচিতে বাধে বিনুর। ভীষণ অস্বস্তি হয়। সে চুপ করে রইল।
কী ভেবে যুগল ফের বলে, সুধাদিদি আর ছুটো জামাইবাবু, দুইজনেই ভালা মানুষ। কিন্তুক কয়দিন পর ছুটো জামাইবাবুর ঠাউরদা আর জেঠিমা ফিরা আসব। হেয়া ছাড়া আপনের বাবায়ও তীর্থধম্ম সাইরা ফেরবেন। তেনারা পুরানা কালের মানুষ। ঝিনুক বইনেরে কি মাইনা নিবেন?
যে তিনজনের কথা যুগল বলল তাদের সম্বন্ধে যথেষ্ট দুশ্চিন্তা রয়েছে বিনুর। রয়েছে গভীর শঙ্কা। লাঞ্ছিত ঝিনুককে তারা যদি সসম্মানে কাছে টেনে না নেন? হেমনলিনী যা করেছেন, হুবহু সেইভাবেই নোংরা আবর্জনার মতো তাকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলেন?
বিনু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। যুগল ফের বলে, ছুটোবাবু, ছুটো মুখে একখান কথা কই। ঝিনুক বইনেরে লইয়া যদিন বিপদে পড়েন, সিধা মুকুন্দপুরে চইলা আসবেন। আমরা সোম্মান দিয়া তেনারে মাথায় কইরা রাখুম।
বিহ্বল বিনু যুগলের দিকে তাকিয়েই থাকে। অক্ষরপরিচয়হীন এই যুবকটি সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের এপারে চলে এসেছে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মুহূর্তে তার নিদারুণ যুদ্ধ। অপরিসীম ক্লেশ। তার মধ্যেই অন্যের কথা চিন্তা করে সে, অপরের দুঃখে কাতর হয়। লাঞ্ছিত ঝিনুকের জন্য সে যে এতটা ভেবে রেখেছে, কে জানত! যুগলের উদারতা, যুগলের সমবেদনার লেশমাত্রও যদি নিজের পরিজনদের মধ্যে থাকত!
কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে যায় বিনুর। যুগলের একটা হাত ধরে ভারী গলায় বলে, তোমার কথা আমার মনে থাকবে। পরক্ষণে অন্য একটা চিন্তা তাকে ভীষণ দমিয়ে দেয়, কিন্তু
কী হইল ছুটোবাবু?
তোমরা না হয় মাথায় করে রাখলে। কিন্তু মুকুন্দপুরের অন্য সবাই?
এই কথা! যুগল হাসে, মুকুন্দপুরের তিন ফেমিলির বস্যের মাইয়া পাকিস্থানে টাইনা লইয়া গ্যাছে। পাঁচ সাতটা মাইয়া আছে, এইপারে আসনের আগে তাগো মান-ইজ্জৎ নষ্ট হইছে। হগলেরই তো একই দুঃখু। একই কষ্টে বুক টাটায়। ঝিনুক বইনেরে ক্যাঠা কী কইব! চিত হইয়া ছাপ (থুতু) ফেলাইলে নিজের বুকেই তো আইসা পড়ে। আপনে ভাইবেন না ছুটোবাবু–
একসময় দিগদিগন্ত কাঁপিয়ে কলকাতার ট্রেন এসে পড়ে।
.
সুধাদের বাড়ি বিনু যখন পৌঁছল, আটটাও বাজে নি। সদর দরজায় কড়া নাড়তে উমা নেমে এসে খুলে দিয়েছিল। দোতলায় এসে বিনু দেখল, সুধা ঝিনুক আর হিরণ ভেতরে শোবার ঘরে বসে গল্প করতে করতে রেডিও সিলোনের গান শুনছিল। বিখ্যাত সব গান। নামকরা সব শিল্পী। নুরজাহান, রাজকুমারী, রফি, হেমন্তকুমার, জগমোহন, গীতা রায়, লতা মঙ্গেশকর, মুকেশ, তালাত মামুদ, এমনি অনেকে।
বিনুকে দেখে প্রথমটা সবাই অবাক। তারপর হইহই করে উঠল।
সুধা বলল, কি রে, তোর না কালকে আসার কথা ছিল।
কাঁধের ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে একটা বেতের মোড়ায় বসতে বসতে বিনু বলল, চলে এলাম—
রেডিও বন্ধ করে হিরণ জিজ্ঞেস করল, যুগলরা তোমাকে আসতে দিল?
একেবারেই না। শুধু যুগল নাকি, সারা মুকুন্দপুরের লোকজন ঘিরে ধরেছিল। কিছুতেই আসতে দেবে না।
হঠাৎ ঝিনুক বলে ওঠে, যুগলদা তোমাকে এত ভালবাসে। তোমার ওপর কী টান! দু’চারটে দিন ওদের কাছে থেকে আসা উচিত ছিল।