বিনু একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। দেখতে পেল, ধানখেত থেকে কী একটা যেন বুকের কাছে আটকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে যুগল। একটু পর পুকুর পেরিয়ে পাড়ে এসে উঠল সে, তারপর জল থেকে মস্ত বড় গোলাকার খাঁচার মতো একটা জিনিস তুলে আনল। সরু সরু কাঠি ফাঁক ফাঁক করে তার দিয়ে বেঁধে খাঁচাটা তৈরি। এমন জিনিস আগে আর কখনও দেখে নি বিনু। সে জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
যুগল বলল, চাই।
কী হয় এটা দিয়ে?
ভিতরে তাকাইয়া দ্যাখেন ছুটোবাবু।
প্রথমটা লক্ষ করে নি বিনু। যুগলের কথামতো তাকাতেই খুশিতে তার চোখ চকচকিয়ে উঠল। ‘চাই’-য়ের ভেতরটা মাছে বোঝাই, বোদ লেগে রুপোলি আঁশগুলো ঝলকে উঠছে।
বিনু প্রায় লাফ দিয়েই উঠল, ইস, কত মাছ!
এই মাছ দেইখ্যাই কন কত মাছ! আইতেন বষাকালে, দেখতেন মাছ কারে কয়! বলতে বলতে কী এক কৌশলে চাই’-য়ের পেছন দিকটা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে মাছগুলো ঝুপ ঝুপ করে মাটিতে পড়ে লাফাতে লাগল। নানা রকমের মাছ। বেশির ভাগই বিনুর চেনা। রুই, কালবোস, বড় বড় সরপুঁটি, গোলসা ট্যাংরা আর বেলে–এগুলো চিনতে পারল সে। বাদ বাকি অচেনা।
মাছ বার করা হয়ে গিয়েছিল। যুগল বলল, ছুটোবাবু আপনে ইট্ট (একটু) মাছগুলার কাছে। খাড়ন, দেইখেন চিলে আর কাউয়ায় (কাকে) আবার তুইলা নিয়া না যায়।
বিনু জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যাবে?
ধানখ্যাতে, চাইটা আবার পাইতা রাইখা আসি। মাছধরা ফাঁদের পেছন দিকটা তাড়াতাড়ি আটকে দিয়ে জলে গিয়ে নামল যুগল। নিমেষে ধানবনে সেটা রেখে ফিরে এল। তারপর যেখানে পচা পাট স্থূপাকার হয়ে আছে সেখান থেকে একটা বড় গামছা এনে মাছগুলো বেঁধে উঠে দাঁড়াল। বলল, চলেন ছুটোবাবু–
কোথায়?
মাছগুলা ভিরে দিয়া আসি।
দু’জনে বাড়ির দিকে চলতে লাগল।
বিনু মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, ইত্যাদি কর্মকুশলতায় যুগল তাকে জয় করে নিয়েছে।
পাশ থেকে যুগলকে একবার দেখে নিয়ে বিনু বলল, তুমি তো খুব সাঁতার কাটতে পার!
হ– মাথাটা অনেকখানি হেলিয়ে যুগল বলল, তা পারি। আমারে পুকৈর পার হইতে দেখলেন তো?
হ্যাঁ।
এইরকম তিনটা পুকৈর আমি এক ডুবে পার হইয়া যাইতে পারি। ইস্টিমারে কইরা যে গাং দিয়া আইলেন
হ্যাঁ—
সাতইরা (সাঁতরে) উই গাংটা যে কতবার এপার-ওপার করছি, হিসাব নাই ছুটোবাবু।
আগে মুগ্ধ হয়েছিল, এবার একেবারে ভক্তই হয়ে পড়ল বিনু। তোষামোদের সুরে বলল, আমাকে একটু সাঁতার শিখিয়ে দেবে?
চলতে চলতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল যুগল। বিস্ময়ে তার চোখ গোলকার হয়ে গেছে। সাঁতার জানে না, এমন মানুষ জীবনে এই বোধহয় প্রথম দেখল সে। বলল, আপনে সাতর জানেন না ছুটোবাবু!
চোখ নামিয়ে বিনু খুব আস্তে করে বলল, না। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিল না সে।
কলকাতায় থাকে বলে বিনুর খুব গর্ব। তার ধারণা, পৃথিবীর সব কিছু জেনে বসে আছে। কিন্তু একটি পেঁয়ো যুবকের কাছে যে পরাজয় মানতে হবে তা কে জানতো?
আবার হাঁটতে শুরু করল যুগল। আমাগো এইহানে কুলের (কোলের) পুলাটাও (ছেলেটাও) সাতর দিতে পারে। ডর নাই, দুই চাইর দিনের ভিতর সাতর শিখাইয়া, মাছ ধরা শিখাইয়া আপনেরে চালাক কইরা দিমু।
বিনু গম্ভীর হয়ে গেল। যুগলের কাছ থেকে চালাক হবার পাঠ নিতে হবে, এতখানি মেনে নিতে সে রাজি না। বলল, আমি বোকা না।
যুগল বলল, হে তো জানিই ছুটোবাবু–
একটু পর তারা ভেতর-বাড়িতে এসে পড়ল। যুগল ডাকল, ঠাউরমা, ইট্টু বাইরে আসেন দেখি—
রান্নাঘর থেকে স্নেহলতা বেরিয়ে এলেন। তার পিছু পিছু শিবানী সুরমা সুনীতি আর ঝিনুকও এল।
ততক্ষণে গামছা খুলে মাছগুলো ঢেলে ফেলেছে যুগল। সুনীতি সবিস্ময়ে বলল, এত মাছ কোথায় পেলে!
সবগুলো দাঁত বার করে হাসল যুগল, ধরলাম।
বিপুল উৎসাহে হাত-পা নেড়ে যুগলের মাছ ধরার পদ্ধতি বর্ণনা করতে লাগল বিনু।
স্নেহলতা সস্নেহ ভৎর্সনার সুরে বললেন, একেবারে মেছো রাশি। দিনরাত খালি মাছই ধরছে। আর ধরতেও পারে। মাছ যেন ওর গায়ে লেগে উঠে আসে।
মাছ দেখে সুরমা খুব খুশি। বললেন, ছেলেটা কে গো মামী?
স্নেহলতা সংক্ষেপে পরিচয় দিলেন। এখান থেকে মাইল বিশেক দূরে পাকসি বলে ভূঁইমালীদের একটা গ্রাম আছে। যুগলদের বাড়ি সেইখানে। তবে বাড়ির সঙ্গে, বাপ-মা ভাই-বোনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই হয়। দশ বছর বয়সে হেমনাথ তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে যুগল এ বাড়িরই ছেলে, কৃচিৎ কখনও নিজেদের বাড়ি যায়। এবেলা যায় তো, ওবেলা ফিরে আসে। এখানে থেকে থেকে বাপ-মা’র কাছে গিয়ে ওর মনই বসে না।
উঠোনে মাছগুলো লাফালাফি করছে। ওঘর থেকে সুধা দেখতে পেয়েছিল, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল। চোখ বড় করে বলল, কত মাছ রে!
একটু পর অবনীমোহন আর হিরণও এল। মাছ দেখে সবাই বেজায় খুশি। জল-বাংলার রুপোলি ফসল সকলকে উচ্ছ্বসিত করে তুলেছে।
স্নেহলতা যুগলের দিকে ফিরে বললেন, দিনরাত তো মাছরাঙার মতো মাছের পেছনে লেগে রয়েছ। পাট তোলা হয়েছে?
যুগল একগাল হেসে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, না।
উনি কেতুগঞ্জ থেকে এসে যদি দেখেন পাটের মনে পাট পড়ে আছে, মাছ খাওয়াবে’খন।
ঠাউরদা আসনের আগেই পাট তুইলা ফেলামু। বলেই দৌড় লাগাল যুগল। উঠোনের আধাআধি গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বিনুকে ডাকল, আসবেন নিকি ছুটোবাবু?