উদ্বাস্তুরা প্রায় নিঃশব্দে হাঁটছে তো হাঁটছেই। তাদের দেখতে দেখতে মনে হল, মধ্যযুগের যাযাবরেরা এইভাবেই বুঝিবা খাদ্যের সন্ধানে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাহাড় পর্বত মরুভূমি পার হয়ে। ঘুরে বেড়াত।
একটা টিলার মাথায় চলে এসেছিল বিনয়রা। পথ এবার নিচের দিকে নেমে দূরে অন্য একটা টিলায় গিয়ে উঠেছে।
বিশ্বজিৎ দূরের টিলাটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমরা প্রায় এসে গেছি। ওই টিলাটার পর এবারডিন বাজার। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘জগদীশকাকার কাগজ কেমন চলছে?’
বিনয় বলল, ‘বেশ ভালো। এখানে ‘নতুন ভারত’ আসে?’
‘আসে। তবে রোজ নয়। উইকে তিনদিন প্লেন সারভিস আছে। প্লেনের সঙ্গে কাগজও আসে।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘আপনাদের কাগজ রিফিউজি প্রবলেমের ওপর অন্য পেপারগুলোর চাইতে অনেক বেশি ইমপর্টান্স দিচ্ছে। তার ওপর অন্যেরা যা করেনি, আপনারা তাই করতে চলেছেন। আন্দামান সেটেলমেন্ট কভার করবেন। আশা করি, সার্কুলেশন হুহু করে বেড়ে যাবে।’
বিশ্বজিৎ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ‘নতুন ভারত’-এর পরিকল্পনা আপাতত তা-ই। উদ্বাস্তু সমস্যার ওপর বিশেষ করে জোর দেওয়া। সেটা সঠিক ধরে ফেলেছেন বিশ্বজিৎ।
বিনয় একটু হাসল। তবে ‘নতুন ভারত’ নিয়ে কোনও মন্তব্য করল না। বলল, ‘এখানকার রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ কেমন চলছে?’
বিশ্বজিৎ আস্তে মাথা নাড়লেন। ‘আমি কিছু বলব না। নিজের চোখে দেখে আপনাকে সেটা বুঝে নিতে হবে।’
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।
ঝিনুকের চিন্তাটা ভেতরে ভেতরে চলছিলই। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হল, পুনর্বাসন দপ্তরের এই মহা ক্ষমতাবান অফিসারটি ইচ্ছা করলে ঝিনুকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সরাসরি তো বলা যায় না, আমাকে মিডল আন্দামানে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিন। পোর্ট ব্লেয়ারকে ঘিরে দক্ষিণ আন্দামানের শরণার্থীদের নতুন নতুন বসতিগুলো না দেখেই কেন সে মধ্য আন্দামানে যেতে চাইছে এই নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠবে। সেগুলো তার পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর।
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বিনয় জিগ্যেস করল, ‘মিডল আন্দামান এখান থেকে কতদূর?
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘ষাট বাষট্টি মাইল।‘
‘নিরঞ্জনবাবু বলেছেন, ইন্টার-আইল্যান্ড শিপ সারভিসের জাহাজ মাসে একবার মাত্র ওখানে যায়।‘
‘ঠিকই বলেছে।‘
‘এছাড়া আর কোনওভাবে সেখানে যাওয়া যায় না? চলতে চলতে ঘাড় ফিরিয়ে কয়েক পলক বিনয়কে লক্ষ করলেন বিশ্বজিৎ। তারপর বললেন, যায়। শেল কালেক্টরদের মোর্টর বোট আইল্যান্ডের কোস্ট ধরে ধরে মাঝে মাঝে মিডল আইল্যান্ড, এমনকী আরও দূরে নর্থ আইল্যান্ড অব্দি চলে যায়।তবে কতদিনে যাবে তার ঠিক নেই।’
‘শেল কালেক্টর কাদের বলে?’
বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে দিলেন, সমুদ্রে ডুবুরি নামিয়ে যারা শঙ্খ, কড়ি, যেমন টার্বো ট্রোকাসনটিলাস এমনি নানা জিনিস তুলে আনে তারা হল শেল-কালেক্টর। সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তবেই এসব শেল তোলা যায়। তোলার পর অ্যাসিড দিয়ে সাফ করে পালিশ লাগিয়ে এগুলো বাইরে চালান করা হয়। বিদেশের বাজারে আন্দামানের টার্বো ট্রোকাস নটিলাসের বিপুল চাহিদা।
বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘তা ছাড়া নর্থ আন্দামানের মায়াবন্দরে একটা কোম্পানির অনেকগুলো বিরাট বিরাট কাঠের কারখানা রয়েছে। তাদের ছোট জাহাজ আছে একটা। সেটা মিডল আন্দামান হয়ে কখনও পনেরো দিন, কখনও বা দু তিন মাস পর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মায়াবন্দর যায়।’
নিরাশই হয়ে পড়ে বিনয়। শেল কালেক্টরদের বোট বা কাঠের কারখানার জাহাজের ব্যাপারটা অনেকখানিই অনিশ্চিত। কবে ওদের মিডল আর নর্থ আন্দামানে যাবার দরকার হবে, কে জানে। এমনও তো হতে পারে, পাঁচ-সাত দিনের ভেতর যাবে।
বিনয় জিগ্যেস করে, ‘ওরা কি নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কারওকে নিয়ে যায়?
‘না। তবে–’
‘সরকারি অফিসাররা বললে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে।’
আশার একটু সংকেত যেন দেখতে পায় বিনয়। গভীর আগ্রহে বলে, কয়েকদিনের মধ্যে ওদের বোট বা জাহাজ মিডল আন্দামানে যাবে কিনা সেটা কি জানা যায়।
‘তা হয়তো যায়।’ বলেই বিশ্বজিতের খেয়াল হল, মধ্য আন্দামান সম্পর্কে বিনয়ের কেন এত ঔৎসুক্য? জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি মিডল আন্দামানে যেতে চাইছেন?’
হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।’-ওখানে তো সেটেলমেন্ট হচ্ছে। সেটা দেখাও খুব জরুরি।’
‘অবশ্যই। আগে সাউথ আন্দামানের সেটেলমেন্ট দেখে নিন। তারপর মিডল আন্দামানে যাবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।’
বিনয় বুঝতে পারছে, বিশ্বজিৎ ইচ্ছা করলে শেল কালেক্টরদের বোটে বা কাঠের কারবারিদের জাহাজে তাকে পাঠিয়ে দিতে পারেন। তার মতো বিপুল ক্ষমতাবান অফিসারের হুকুম অমান্য করার মতো বুকের পাটা ওদের কারও হবে না। কিন্তু বোট বা জাহাজ কবে ছাড়বে সেটা বড় মাপের প্রশ্ন। তা ছাড়া এখানে পা। দিতে না দিতেই পোর্ট ব্লেয়ারের চারপাশের পুনর্বাসনের হাল না দেখে সত্তর মাইল দূরের মধ্য আন্দামানে যাবার জন্য এত ব্যগ্র হয়ে ওঠাটা একটু দৃষ্টিকটুই। যতই ব্যাকুল হোক ঝিনুকের সঙ্গে এখনই দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। আপাতত বেশ কিছুদিন বিনয়কে দক্ষিণ আন্দামানেই কাটাতে হবে।
খানিক আগে বিশ্বজিৎ যে উঁচু টিলাটা দেখিয়েছিলেন, চড়াই বেয়ে বেয়ে সবাই এখন সেটার মাথায় উঠছে। নিঃশব্দে খানিকটা চলার পর বিনয় জিগ্যেস করে,
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।