মুন্সিগঞ্জে কোর্টরুমের যেরকম চেহারা দেখেছিল, পোর্টব্লেয়ারেও তার ব্যতিক্রম নেই। একদিকে উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর বিচারকের জন্য চেয়ার, সামনে টানা লম্বা টেবিল। নিচে পাবলিক প্রসিকিউর এবং ল’য়ারদের বসার জন্য চেয়ার। দু’ধারে আসামী এবং সাক্ষীদের জন্য উঁচু চৌকো ডেক। তারই একপাশে পেশকারের বসার বন্দোবস্ত। এসবের পর বেশ ক’টা ফাঁকা চেয়ার এবং বেঞ্চি। সেখানে বাদী আর বিবাদী পক্ষের লোকেরা বসতে পারে। আগ্রহী দর্শকরা আদালতের সওয়াল-জবাব শুনতে এলে ওখানে বসে।
দশটার একটু আগেই বিনয়রা কোর্ট চত্বরে পৌঁছে গিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘কোর্টরুমের ভেতরে গিয়ে লইয়ারদের পেছন দিকের ফাঁকা চেয়ারে বসুন। এখনও সময় হয় নি। এজলাসের পেছন দিকে আমার অ্যান্টি-চেম্বার আছে। আমি সেখানে চলে যাই। ঠিক দশটায় কোর্টের প্রসিডিংস শুরু হবে। আপনাকে বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হবে না।
বিনয় সোজা আদালতে গিয়ে ঢুকল। বিশ্বজিৎ একটু ঘুরপথে কোর্টরুমের পেছন দিকে চলে গেলেন।
আদালত একরকম ফাঁকাই ছিল। কয়েক মিনিটের ভেতর পেশকার, আদালি, নিচের স্তরের কিছু কর্মী, পাবলিক প্রসিকিউটর, দু-চারজন লইয়ার চলে এলেন। পেছনের অ্যান্টি-চেম্বার থেকে কোর্ট রুমে এসে বিশ্বজিৎ রাহা বিচারকের নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসলেন।
একটু পরেই পুলিশ পাহারায় লক্ষ্মণ ভক্তকে আসামীর ডকে এনে তোলা হল। কোর্টের কাজ শুরু হয়ে গেল।
পাবলিক প্রসিকিউটরটি বর্মী। তবে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বহুকাল তিনি পোর্টব্লেয়ারে আছেন। বিশ্বজিৎ তাকে বললেন, ‘মিস্টার পি পি (পাবলিক প্রসিকিউটর), অভিযুক্ত লক্ষ্মণ ভক্তকে জিগ্যেস করুন, পরশু সে বলেছিল নিজের মামলা নিজেই চালাবে। এখনও কি তার সেই একই সিদ্ধান্ত? সে যদি মত বদলে থাকে আদালত থেকে তাকে একজন উকিল দেওয়া হবে।
পি পি মুখ খোলার আগেই লক্ষ্মণ হাতজোড় করে বলে ওঠে।–’হুজুর, আমার উকিলের দরকার হবে না নে। নিজিই নিজির (নিজেই নিজের) কথা কতি চাই (বলতে চাই)।’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘বেশ। তোমার নামে যে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, পরশুদিনই তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আদালতের তরফ থেকে। তুমি নবদ্বীপ কুণ্ডুকে খুন করার জন্যে বাঁশের খুটি দিয়ে এমন মার মেরেছ যে সে একেবারে বেহুঁশ হয়ে যায়। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। চিকিৎসার জন্যে তাকে পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক কষ্টে তাকে বাঁচাতে পারা গেছে। কতদিনে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে, এখনও ঠিক নেই। তা ছাড়া আরও একটা অভিযোগ রয়েছে তোমার বিরুদ্ধে। সরকারের তরফ থেকে বাঁশের খুঁটি পুঁতে প্রতিটি উদ্বাস্তুর জমির সীমানা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। তুমি খুঁটি তুলে নবদ্বীপের জমির অনেকটা দখল করার চেষ্টা করেছিলে, দু’টোই মারাত্মক অপরাধ। এ সম্বন্ধে তোমার কী বলার আছে?’
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চোখ পিট পিট করতে করতে শুনে গেল লক্ষ্মণ। তারপর হঠাৎ দুই হাত ওপর দিকে তুলে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে চিকুর ছাড়ল।–’মিছে কথা হুজুর, মিছে কথা। উপুরি দেহিচি ভগমান বাবা (ওপরে দেখেছি ভগবান বাবা), নিচি (নিচে) দেখিচি আফনিরি (আপনাকে)। আফনি (আপনি)–’
পি পি বাধা দিলেন।–’হুজুর যা জিগ্যেস করেছেন তার জবাব দাও। বাজে কথা বলতে হবে না।‘
লক্ষ্মণ হাত নেড়েই যাচ্ছিল।–’ক’তি দ্যান বাবা, কতি দ্যান (বলতে দিন, বলতে দিন)। হুজুরের সব কথার জবাব দেবা নে (দেব)। অত হড়বড়ালি (হড়বড় করলে) কি হয়? ধয্যি ধরতি (ধৈর্য ধরতে) হয়।’ বলেই বিশ্বজিতের দিকে ফিরে ধুয়ো ধরার মতো আগের গতে ফিরে গেল।–’উপুরি দেখিচি ভগমান বাবা, নিচি দেখিচি আফনিরি (আপনাকে)। আফনি রাখলি রাখতি ফারেন (পারেন) মারলি মারতি ফারেন (মারল মারতে পারেন)—’
পি পি আবর বাধা দিলেন।– ‘কেন, আজে বাজে বকে আদালতের সময় নষ্ট–’
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে লক্ষ্মণ বলল, ‘পুরা কথাটা বুললি (বললে) বুজতি ফারবেন (বুঝতে পারবেন), বাজে বকতিছি (বকছি) না। উপুরি দেখিচি ভগমান বাবা, নিচি দেখিচি আফনিরে (আপনাকে), আফনে রাখলি রাখতি ফারেন (পারেন), মারলি মারতি ফারেন, টাস (ঠাস) করি বাড়ি মারি শ্যাষ করি দিতি ফারেন, গুলি করি হাগরের (সাগরের) জলে ভাসায়ে (ভাসিয়ে) দিতি ফারেন। উপুরি দেখিচি ভগমান বাবা—’
বিচারকের আসনে বসে থমথমে গম্ভীর মুখে বিশ্বজিৎ। জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরা দীর্ঘ অভ্যাসে নিজেদের সংযত রাখেন। লক্ষ করলাম, বিশ্বজিতের কিঞ্চিৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। বললেন, ‘ওসব থাক, তুমি আসল কথার উত্তর দাও।‘
কিন্তু কার সাধ্য লক্ষ্মণকে রুখতে পারে। গলার স্বর উঠিয়ে নামিয়ে বলেই চলেছে, ‘হুজুর, বিহান বেলাতি (সকাল বেলায়) জমিনি আসি (জমিতে এসে) দ্যাখলাম, সীমানার খুটাগুলোন আমিন ঠিক করি বসায়ে দিতি ফারে নে (পারে নি)। আমি খরলাম (করলাম) কি, ঠিক করি পুতি দেলাম (ঠিক করে পুঁতে দিলাম)। তা নবদ্বীপভাই তার বউ আর ছেলিরে নিয়ি (বউ ছেলেকে নিয়ে) নিজির (নিজের) জমিনে আসি খুটাগুলোন দেখি খেপি গ্যাল (খেপে গেল)। ক’ল (বলল) হালার পুঁত হালা (শালার ছেলে শালা), আমার জমিনে খুটা (খুঁটি) হান্দায়ি (ঢুকিয়ে) দিছিস (দিয়েছিস) ক্যানো? আমি তারে ক’লাম (বললাম), হালার পুত হালা কতি (বলতে) নাই ভাই। হে (সে) আমারে ক’ল হালা পুঙ্গির পুত। আমি তারে ক’লাম, অত চেতি যাতি নাই (অতি রেগে যেতে নেই)। বয়স তো কম হল না। হে (আমার) আরও কত অশৈল্য (অশ্লীল) কথা ক’ল (বলল)। হেসব হুজুরের সামনি মুখি আনতি পারফ (পারব) না।’
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।