ও।
আজকের কাগজটা দেখেছেন?
উত্তর দিতে গিয়ে সুবর্ণা লক্ষ করল, স্থির চোখে পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে রাজীব। সে বলল, ভাল করে দেখা হয়নি।
রামেশ্বর বললেন, ওতে টেরোরিস্টটার ছবি বেরিয়েছে। দেখে নেবেন। তা হলে লোকটাকে চিনতে সুবিধা হবে।
আচ্ছা।
পরে আবার আপনাকে ফোন করব।
ঠিক আছে।
সুবর্ণার জবাবগুলো শুনে রাজীব মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিল রামেশ্বর কী ধরনের প্রশ্ন করেছেন। তবু জিজ্ঞেস করল, ওসি অত কী বলছিল?
টেলিফোন নামিয়ে রেখে তার সঙ্গে রামেশ্বরের যা কথাবার্তা হয়েছে, সব জানিয়ে দিল সুবর্ণা। তারপর আবার শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাওয়াতে লাগল।
হঠাৎ ফোন আসায় খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাজীবের। ফের খেতে খেতে বলল, তার মানে এই প্যালেসের ওপর পুলিশ নজর রাখছে। দেখা যাচ্ছে খুব সহজে এখান থেকে বেরুনো যাবে না।
সুবর্ণা উত্তর দিল না।
ব্রেকফাস্ট করার পর রাজীব যখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে সেই সময় শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়া শেষ হল। সুবর্ণা বলল, আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে এখন আলাপ করতে যাবেন কি?
হা হা, নিশ্চয়ই। দ্রুত বাকি চাটুকু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় রাজীব। সুবর্ণাও উঠে পড়েছিল। রাজীবকে সঙ্গে নিয়ে সে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে আসে।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে, ক্যাপসিউল আর ট্যাবলেট খেয়ে ফের খবরের কাগজ পড়ছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। সুবর্ণা ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা, ওঁকে নিয়ে এসেছি। সে টের পাচ্ছিল, পা দু’টো ভীষণ কাঁপছে।
কাগজ থেকে চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রাজীবকে লক্ষ করেন সংগ্রামনারায়ণ। তারপর সামান্য দূরে একটা ডিভান দেখিয়ে বলেন, বসুন–
বসতে বসতে রাজীব বলে, আমি রাজীব। বয়সে আপনার থেকে অনেক ছোট। আপনি করে বললে অস্বস্তি হবে।
বেশ, তুমি করেই বলব। সংগ্রামনারায়ণ বললেন, কাল বৌমা যখন তোমার কথা বলল, ওষুধের রি-অ্যাকসানে চোখ মেলে তাকাতে পারছিলাম না।
হ্যাঁ, শুনেছি।
তুমি বৌমার কিরকম যেন আত্মীয় হও?
রাজীব উত্তর দেওয়ার আগেই, চোখকান বুজে মানুষ যেমন সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়, অবিকল সেইভাবে সুবর্ণা বলে ওঠে, উনি আমার বৌদির পিসতুতো দাদা।
তার বলার ভঙ্গিটা এতই অস্বাভাবিক এবং সন্ত্রস্ত যে মুখ ফিরিয়ে একবার তাকে দেখে নিলেন সংগ্রামনারায়ণ। তারপর ফের রাজীবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় থাকো?
রাজীবের মধ্যে কিন্তু কোনওরকম চাঞ্চল্য নেই। অবিচলিত সুরে বলল, দিল্লিতে।’
চাকরি করো?
না।
তা হলে?
আপাতত কিছুই প্রায় করি না। একটা কলেজে পড়াতাম, ছেড়ে দিয়েছি।
এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করা হয়তো অশোভন মনে হল সংগ্রামনারায়ণের। তাই অন্য কথায় চলে গেলেন, দিল্লি থেকে সোজা আমাদের এখানেই এসেছ?
হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে রাজীব। বলে, জরুরি একটা কাজে আমাকে আসাম যেতে হবে। আমার বোন আর ভগ্নিপতি বলল, আপনার বৌমার সঙ্গে দেখা করে যেতে। তাই
ভালই করেছ। তোমার এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?
না।
একটু চুপ করে থেকে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, রয়ালটি চলে গেছে। জওহরলাল-প্যাটেলরা জোর করে প্রতাপপুর স্টেট কেড়ে নিয়ে আমাদের ভিখিরি করে দিলে। তোমার আদরযত্ন কতটুকু আর করব! যখন রাজত্ব ছিল তখন যদি আসতে–একটু থেমে ফের বললেন, তখন আর আসবে কী করে? তোমার হয়তো সে সময় জন্মই হয়নি।
সুবর্ণা অবাক হয়ে যাচ্ছিল। উগ্র, ক্ষিপ্ত, রগচটা সংগ্রামনারায়ণ অনেকটা বদলে গেছেন ঠিকই কিন্তু এমন আন্তরিকভাবে রাজীবের সঙ্গে কথা বলবেন, ভাবতে পারেনি।
রাজীব জানাল, আদরযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রুটি হচ্ছে না, সে বেশ আরামেই আছে।
কী উত্তর দিতে গিয়ে দৃষ্টিটা স্থির হয়ে গেল সংগ্রামনারায়ণের। ধীরে ধীরে এবার বললেন, জানো রাজীব, কাল অদ্ভুত একটা কো-ইন্সিডেনস ঘটেছে।
রাজীব উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করে, কীসের?’
কাল তুমিও এসেছ। এদিকে প্রায় একই সময়ে নর্থ-ইস্টের একজন ভয়ঙ্কর টেরোরিস্টকে আমাদের প্যালেসের কাছে দেখা গেছে। পুলিশ তার খোঁজে প্যালেসে ঢুকেও পড়েছিল। তাকে অবশ্য পায়নি। তবে বৌমাকে সাবধান করে দিয়ে গেছে।
সুবর্ণা চমকে ওঠে। রাজীব কি ধরা পড়ে গেল? দাড়িটাড়ি কামিয়েও কি সংগ্রামনারায়ণের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি? এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, ভাবতেও সাহস হচ্ছিল না সুবর্ণার। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে দাঁড়িয়ে থাকে।
সংগ্রামনারায়ণ টেরোরিস্ট বা পুলিশের কথা বললেও রাজীবের চোখে মুখে বিন্দুমাত্র অস্থিরতা দেখা গেল না। খুব শান্ত গলায় সে বলল, আপনার বৌমার কাছে আমিও তা শুনেছি।
একটু চুপচাপ।
তারপর সংগ্রামনারায়ণ বললেন, দিল্লি থেকে এতটা রাস্তা এসেছ। নিশ্চয়ই শরীরের ক্লান্তি কাটেনি। রেস্ট নাও গিয়ে। পরে আবার দেখা হবে।
সুবর্ণা একধারে দাঁড়িয়ে দু’জনকেই লক্ষ করছিল। ধীরে ধীরে তার বুকের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস বেরিয়ে আসে। যাক, সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে সন্দেহ করেননি। আপাতত দুর্ভাবনাটা অন্তত কাটল।
রাজীব চলে গিয়েছিল। সুবর্ণা ঘর থেকে বেরুতে যাবে, সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বৌমা, একটু পরে যেও–’
সুবর্ণা থেমে যায়।
সংগ্রামনারায়ণ বলেন, রাজীবকে তুমি আগে কখনও দেখেছ?
বুকের ভেতরকার ধকধকানি হঠাৎ যেন বেড়ে যায় সুবর্ণার। তাহলে কি সংগ্রামনারায়ণ রাজীবের ব্যাপারে পুরোপুরি নিঃসংশয় নন? কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলে, না।