বিক্রমের সঙ্গে ডিভোর্সের পর সংগ্রামনারায়ণ কিছুটা বদলে গিয়েছিলেন। মুখ ফুটে সেভাবে প্রকাশ না করলেও সুবর্ণার প্রতি তার হয়তো চাপা সহানুভূতি ছিল। আগের সেই উদাসীনতা, উপেক্ষা বা রূঢ়তা ক্রমশ কমে আসছিল। তাছাড়া সর্বক্ষণ যার সেবাযত্নের ওপর নির্ভর করতে হয় তার প্রতি স্বাভাবিক একটা কৃতজ্ঞতা থাকেই। বিবাহ বিচ্ছেদের পর থেকে সুবর্ণাকে কাছে বসিয়ে প্রায়ই অনেক গল্প-টল্প করেন। এটাই হয়তো তাঁর সমবেদনা প্রকাশের পদ্ধতি। আজ যে তার জন্য সংগ্রামনারায়ণকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, কয়েক বছর আগে তা ভাবাও যেত না।
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, ঠিক আছি বললে তো হবে না। আজ কলেজে না গিয়ে রেস্ট নাও।
সুবর্ণা জানাল আজ তার বেশ কয়েকটা ইমপর্ট্যান্ট ক্লাস আছে; কলেজে না গেলেই নয়। তারপর বলল, আপনি খান। দাদাভাইয়ের এখনও খাওয়া হয়নি। আমি যাচ্ছি–
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার সেই আত্মীয়টি ব্রেকফাস্ট করেছেন?
এখনও করেন নি। আমি তার খাবার নিয়ে যাচ্ছি।
কাল রাত্তিরে আলাপ হয়নি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেলে ওঁকে আমার ঘরে নিয়ে এসো।
একটু চুপ করে থেকে সুবর্ণা বলল, আচ্ছা—
বাকি খাবারসুদ্ধ ট্রেটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে সে বেরুতে যাবে, ব্যস্তভাবে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, একটু দাঁড়াও বৌমা–
উৎসুক চোখে তাকায় সুবর্ণা।
এই দেখ কাগজে কী সাঙ্ঘাতিক খবর বেরিয়েছে। বিছানার ওপাশ থেকে দৈনিক দিনকাল’-এর কপিটা তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে সংগ্রামনারায়ণ দেখাতে থাকেন, এই যে-’
খাটের কাছে এগিয়ে আসে সুবর্ণা। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নিচের দিকে বড় বড় হরফে পাঁচ কলমের হেডলাইন চোখে পড়ে। প্রতাপপুর সিটিতে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসবাদীর প্রবেশ। সঙ্গে দাড়ি-টাড়িসুদ্ধ রাজীবের তিন কলমের ছবি আর স্টাফ রিপোর্টারের দীর্ঘ প্রতিবেদন।
ছবিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ড যেন জমাট বেঁধে গিয়েছিল। মাথাটা এত টলছিল যে হুড়মুড় করে সুবর্ণা পড়েই যেত, কোনওরকমে সামলে নিল।
সংগ্রামনারায়ণ বলছিলেন, কাগজে লিখেছে টেরোরিস্টটা পুলিশের তাড়া খেয়ে কাল আমাদের প্যালেসের দিকে চলে এসেছিল। এত বড় বাড়ি, কোথাও ঢুকে-টুকে বসে আছে কিনা কে জানে। একটু থেমে বললেন, কাল রাত্তিরে পুলিশ নাকি তার খোঁজে আমাদের বাড়িতে এসেছিল?
চমকে ওঠে সুবর্ণা। শ্বাসরুদ্ধের মতো জিজ্ঞেস করে, কে বললে?
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, এই তো, রিপোর্টটায় বেরিয়েছে।
আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয় সুবর্ণা। বলে, হ্যাঁ।
আমাকে ডাকোনি কেন?
আপনার শরীর ভাল না। ডাকলে টেনসন হত। সেটা হার্টের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই–
চোখ কুঁচকে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, এই যে ব্রেকফাস্ট নিয়ে এলে, এখনও তো পুলিশের খবরটা দাওনি।
ভেতরে ভেতরে একটু থমকে যায় সুবর্ণা। তারপর বলে, ভেবেছিলাম দাদাভাইকে খাইয়ে এসে বলব।
সংগ্রামনারায়ণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কাল পুলিশ এসে কী করল? বেহ সুবর্ণা বলল, একতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখল। আমাদের সাবধানে থাকতে বলল। আর টেরোরিস্টটার ডেসক্রিপশান দিয়ে অনুরোধ করল, এমন কাউকে দেখলে তক্ষুণি যেন থানায় ফোন করি।
ঠিক আছে।
সুবর্ণা আর দাঁড়াল না। স্তব্ধ হৃৎপিণ্ডটা এখন প্রবল বেগে ওঠানামা করছে।
রোজ খুব ভোরে হকার তাদের কাগজ দিয়ে যায়। মায়া একতলা থেকে সেটা তুলে প্রথমে তার কাছে নিয়ে আসে। সকালে খুঁটিয়ে কাগজ পড়ার সময় নেই; দ্রুত পাতা উলটে উলটে হেডলাইনগুলো দেখে শুধু, তারপর সংগ্রামনারায়ণের ঘরে পৌঁছে দেয়। অবশ্য বড় রকমের চাঞ্চল্যকর কোনও খবর থাকলে পুরোটা পড়ে ফেলে। আজ দেরি করে তার ঘুম ভাঙার জন্য খুব সম্ভব মায়া কাগজটা সংগ্রামনারায়ণকে দিয়ে গিয়েছিল। আগে সুবর্ণার হাতে পড়লে ওটা সে সরিয়ে ফেলত। খবরের কাগজ না পড়লে সংগ্রামনারায়ণের পেটের ভাত যে হজম হয় না, এমন নয়। পরে যদি চাইতেন কোনও একটা অছিলা খাড়া করে এড়িয়ে যাওয়া যেত। সুবর্ণা বলত, আজ কাগজ দেয়নি বা অন্য কিছু। দৈনিক দিনকাল’-এর প্রিন্টিং মেশিনটা অনেক কালের পুরনো। মাঝে মাঝেই গোলমাল করে, তখন দু-একদিন কাগজ বেরোয় না। এই অজুহাতটা দিলে অবিশ্বাস করতেন না সংগ্রামনারায়ণ। অবশ্য কাগজটা আগে ওঁর হাতে গেলেও ততটা দুশ্চিন্তার কারণ হত না, কিন্তু রিপোর্টের সঙ্গে রাজীবের ছবিটা ছাপা হয়ে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রাজীবকে দেখামাত্র সংগ্রামনারায়ণ চিনে ফেলবেন। তখন যে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেও শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা একটা স্রোত বইতে থাকে। প্রবল উৎকণ্ঠায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মনে হচ্ছে রক্তচাপ হঠাৎ বিপজ্জনকভাবে কমে গিয়ে চোখের সামনের সমস্ত কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
উদ্ভ্রান্তের মতো টলতে টলতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে একেবারে হকচকিয়ে গেল সুবর্ণা। বৃদ্ধটির ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি মশারির ভেতর চুপচাপ বসে আছেন। অন্যদিন মায়া তাকে বিছানা থেকে তুলে মুখ ধুইয়ে পোশাক পালটিয়ে সোফায় বা ডিভানে বসিয়ে দিয়ে যায়। পরে এসে সুবর্ণা খাইয়ে দেয়। তার চমকটা শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের জন্য নয়। এই ঘরে আর যার থাকার কথা তার বদলে আরেক জন চেয়ারে বসে আছে। লোকটার মুখ নিখুঁত কামানো, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, পরনে অ্যাশ কালারের পরিষ্কার ট্রাউজার আর সাদা শার্টের ওপর লাল উলের পুল-ওভার। বিহ্বলের মতো তাকিয়ে লোকটাকে। দেখছিল সুবর্ণা। লোকটা বলল, আমাকে চিনতে পারছেন না মিসেস সিংহ! আমি রাজীব।