কিন্তু চন্দ্রনাথের মতো ছোটখাটো সেকশন ইনচার্জের পক্ষে মাসের শেষে এত টাকা গুণে দেওয়া অসম্ভব। অফিসে মাইনে তাঁর বেশ খানিকটা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু চাল ডাল তেল মশলা মাছ তরি-তরকারির দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে সংসার খরচও। তার ওপর পুরোনো শ্বাসকষ্টটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রচুর ওষুধ খেতে হয়। নেবুলাইজার নিতে হয়। সপ্তাহে কম করে দুদিন অক্সিজেন। সংসার এবং শমিতার পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি চিকিৎসার খরচ চালাতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছিল চন্দ্রনাথের। ওদিকে রিটায়ারমেন্টের বেশি বাকি নেই। মেরে কেটে তিন কি সাড়ে তিন বছর। দুহাজার টাকা ভাড়া দিতেন, সেটা যদি আচমকা ষোলো হাজারে চড়ে যায় বাকি চোদ্দো হাজার কোত্থেকে জোগাবেন? আচমকা মাথায় বাজ পড়ার মতো হাল। চোখে অন্ধকার দেখছিলেন চন্দ্রনাথ। হাতজোড় করে বলেছিলেন, আমি আর হাজারখানেক নাহয় দেব। আমার অবস্থা তো জানো, এর বেশি দিতে হলে না খেয়ে মরতে হবে। একটু করুণা করো।
কিন্তু হাজার কাকুতি-মিনতি করেও কাজের কাজ কিছুই হল না। দিবাকর তার দাবিতে অনড় রইল। হয় চন্দ্রনাথ ষোলো হাজার দেবেন, নইলে বাড়ি ছাড়তে হবে। দিবাকর অবশ্য পুরোপুরি অবিবেচক নয়। বাড়ি ছাড়ার জন্য চন্দ্রনাথকে সে দুমাস সময় আর নগদ দেড় লাখ টাকাও দিতে চেয়েছে।
দিবাকর হুকুমনামা জারি করেছে বলেই যে বাড়ি ছাড়তে হবে, এমন কোনও কথা নেই। ভাড়াটেদের স্বপক্ষে অনেক জোরালো আইন-টাইন আছে। রেন্ট-কন্ট্রোল, লোয়ার কোর্ট, হায়ার কোর্ট ইত্যাদি। কিন্তু চন্দ্রনাথের মতো রুগ্ণ, শ্বাসকষ্টের পেশেন্টের পক্ষে এতসব ঝাক্কি পোয়ানোর মতো শক্তি বা এনার্জি কোনওটাই নেই তাঁর। মামলা-টামলা যে চালাবেন, তত টাকাই বা কোথায়? নিতনি ঝগড়ুটে, মামলাবাজ নন। খুবই নিরীহ, নিঝাট মানুষ।
দিবাকারের কথাতেই রাজি হতে হল চন্দ্রনাথকে। তবে অনেক বলেকয়ে বাড়ি ছাড়ার জন্য টাকার অঙ্কটা দেড় লাখ থেকে দুলাখ করে নিয়েছিলেন। তারপর শুরু হয়েছিল বাড়ি খোঁজা। কিন্তু দু-আড়াই হাজার টাকায় খাস কলকাতা শহরে একটা রোয়াকও মিলবে না।
শেষ পর্যন্ত এক দালাল ধরে পালপাড়ায় অম্বিকা পাল রোড়ে তিন হাজারে দুকামরার একটা ফ্ল্যাট পাওয়া গেল। শর্ত হল, দশ হাজার টাকা ডিপোজিট এবং আগাম দুমাসের ভাড়া। দালালের সঙ্গে বার তিনেক পালপাড়ায় গিয়ে বাড়িওয়ালা সুরেশ্বর চক্রবর্তীর সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে টাকাপয়সা মিটিয়ে রসিদ নিয়েছিলেন চন্দ্রনাথ।
তার কদিন বাদে এক হেমন্তের বিকেলে একটা ম্যাটাডোর ভ্যানে সংসারের যাবতীয় মালপত্র বোঝাই করে পালপাড়ার দিকে রওনা হলেন চন্দ্রনাথ। পঁচিশ বছরে সেই তাঁদের প্রথম ঠিকানা বদল।
টালিগঞ্জের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আদিগঙ্গার শীর্ণ ধারাটির ওপর কংক্রিটের ছোট ব্রিজ পেরিয়ে বেশ খানিকটা যাবার পর পালপাড়া।
শমিতার মনে আছে, লটবহর বোঝাই ম্যাটাডোরটা আগে আগে চলছে। তার পেছনে একটা ট্যাক্সিতে তারা তিনজন। লম্বা ব্যাকসিটের মাঝখানে লতিকা, একধারের জানলার পাশে চন্দ্রনাথ, আরেক ধারের জানলার পাশে শমিতা। সে বাইরে তাকিয়েছিল। জন্মের পর থেকে উনিশ-কুড়ি বছর অবধি যে মেয়ে রবীন্দ্র সরোবরের পাশের ঝকঝকে পশ এলাকায় কাটিয়ে এসেছে তাকে কোন এক ধ্যাদ্দেড়ে, পালপাড়ায় গিয়ে থাকতে হবে, ভাবতেই কদিন ধরে মন খারাপ শমিতার। কিন্তু কিছুই করার নেই। তীব্র হতাশা, বিরক্তি এবং অসন্তোষ ভেতরে ভেতরে জমা হচ্ছিল। সেটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
ম্যাটাডোর ভ্যানের ড্রাইভারকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল পালপাড়ায় কোথায় যেতে হবে। এইরকম ভ্যানওয়ালারা সারা বছর কলকাতার এক মাথা থেকে আরেক মাথা তো বটেই, চারপাশের শহরতলি চষে বেড়াচ্ছে। এলাকা আর রাস্তার নাম জানিয়ে দিলেই হল; ঠিক পৌঁছে দেবে। গ্রেটার কলকাতার নাড়ি-নক্ষত্র তাদের জানা।
আগে আগে চলেছে ম্যাটাডোর ভ্যান, সেটার পেছনে শমিতাদের ট্যাক্সি।
একসময় টালিগঞ্জের চৌহদ্দি পেছনে ফেলে আদিগঙ্গার ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে খানিকটা যেতেই চন্দ্রনাথ বলেছেন, শমি, আমরা প্রায় এসে গেছি। আর চার-পাঁচ মিনিট গেলেই, ব্যস।
শমিতা উত্তর দিল না। জানলার বাইরে যেমন তাকিয়ে ছিল তেমনি তাকিয়ে রইল। এটাই যে পালপাড়া বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কেননা নতুন বাড়ি ঠিক করার পর চন্দ্রনাথ মেয়ে আর স্ত্রীকে এখানকার এমন নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন যে সেটা ছবির মতো মনে গেঁথে গেছে। গাড়ি পালপাড়ায় ঢোকার পর একবারও মনে হয়নি জায়গাটা অচেনা।
শমিতার চোখে পড়ছিল পালপাড়া পুরোপুরি শহরও নয়, আবার গ্রামও নয়। শহর এবং গ্রামের আধাখেঁচড়া মিশ্রণ। এখানে মিলিয়ে-মিশিয়ে পিচের রাস্তা যেমন রয়েছে তেমনি কটা কাঁচা রাস্তাও। যেতে যেতে যে কটা রাস্তা শমিতার চোখে পড়েছে সেগুলোর দুধারে লাইন দিয়ে সেকেলে একতলা, দোতলা। মাঝে মাঝে দু-চারটে জমকালো তেতলা কি চারতলা। টিনের বা টালির চালের বাড়ি একটাও না। এলাকাটার গায়ে প্রাচীনত্বের ছাপ মারা। শরৎ ব্যানার্জি রোড, লেক রোড, ল্যান্সডাউন রোড বা সাদার্ন অ্যাভেনিউ থেকে পালপাড়া আর কত দূরে? কিন্তু শমিতার মনে হল, তারা যেন মহানগর থেকে অনেক-অনেক দূরে আদ্যিকালের কোনও এক শহরে এসে পড়েছে। রাস্তায় লোকজন দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে তারা কয়েক পুরুষ ধরে বুঝি-বা এখানে রয়েছে।