ভেতরের বেডরুমটা বেশ বড়। মাঝখানে ডাবল-বেড খাটের গা ঘেঁষে একটা সিঙ্গল-বেড এমনভাবে সাজানো যাতে সুকান্তরা তিনজন পাশাপাশি শুতে পারে।
রুম হিটার থাকায় পুরো সুইটটাই বেশ গরম এবং আরামদায়ক। খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে সুকান্ত আর তাতান বেডরুমে চলে এল।
সুকান্ত লক্ষ করল, ডাবল-বেড খাটটার একধারে মাথা-মুখ-টুখ কম্বলে ঢেকে শুয়ে আছে শমিতা। শীতকালে আগাপাশতলা মুড়ি দিয়ে শোওয়া তার অভ্যাস।
সুকান্ত ধীরে ধীরে খাটে উঠে শমিতার পাশে শুয়ে পড়ল, তার এধারে তাতান। তারা দুজনেই গলা অবধি কম্বল টেনে দিল।
শিয়রের দিকে একটা নীচু টেবিলে কম পাওয়ারের টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। তার হালকা নরম আলোয় ঘরটা ভরে আছে।
সুকান্ত সামান্য কাত হয়ে নীচু গলায় জিগ্যেস করল, কী হল, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
হুঁ, বিরক্ত কোরো না। শমিতার কণ্ঠস্বর জড়ানো জড়ানো।
পনেরো মিনিটও হয়নি, ড্রইংরুম থেকে উঠে এসে শুয়েছে শমিতা। এর মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই হয় নাকি? নিশ্চয়ই জেগে আছে। সুকান্ত আর ডাকাডাকি করল না। দু-এক লহমা তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে টেবিল-ল্যাম্পটা নিভিয়ে চিত হয়ে শুল। এইভাবে শোওয়াটাই তার অনেককালের অভ্যাস।
সারা বেডরুম এখন অন্ধকারে ডুবে আছে। তার ওপর রুম-হিটারের উত্তাপ। সুকান্ত রীতিমতো ঘুমকাতুরে। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় ঘুমে তার দুচোখ জুড়ে এল। ওদিকে তাতানও জেগে নেই। ঘুমের ব্যাপারে বাবার ধাতটা পেয়েছে সে।
সুকান্ত যা আন্দাজ করেছিল ঠিক তাই। শমিতা ঘুমোয়নি।
পহেলগাঁওয়ের এই রাত একেবারে নিস্তব্ধ। শুধু লিডার নদী অবিরল ঝুম ঝুম আওয়াজ তুলে বয়ে চলেছে। নদীর ওপারে গল্ফ ক্লাবের দিক থেকে মাঝে মাঝে কোনও রাতজাগা পাখি অদ্ভুত আওয়াজ করে ডেকে উঠছে। কাশ্মীরের এই পাখিটার নাম জানে না শমিতা। সুকান্ত তার পেশেন্ট, নার্সিংহোম ইত্যাদি নিয়ে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে সময় করে স্ত্রী এবং ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে। কোনওবার যায় অমরকন্টক, কোনওবার গোয়া, কোনওবার অজন্তা-ইলোরা, কখনো বা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোথাও। এইভাবে তাদের সফর চলে। দেশ-বিদেশে কত জায়গাতেই তো তারা বেড়াতে গেছে। কিন্তু অন্য কোথাও এমন বিষাদ-মাখানো পাখির ডাক কখনও শোনেনি শমিতা। কিন্তু পাখির ডাকাডাকি বা লিডার নদীর অবিরাম কলকলানি, কিছুই যেন তেমন শুনতে পাচ্ছিল না সে। ক্রমশ সেসব অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল আর সময়ের অদৃশ্য উজান টান পনেরো-ষোলো বছর আগের দিনগুলোতে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
.
একসময় শমিতার বাবা চন্দ্রনাথ পালিত আর মা লতিকা পালিত থাকতেন লেক মার্কেটের লাগোয়া শরৎ ব্যানার্জি রোডে। ওটা কলকাতার সেরা একটা পশ এলাকা। চারিদিকে ঝাঁ-চকচকে নতুন নতুন হাইরাইজ, ঝকঝকে সব রাস্তা। চোখ-ধাঁধানো শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, রেস্তোরাঁ। উত্তর দিকে দু-পা গেলে দেশপ্রিয় পার্ক, দক্ষিণে লেক অর্থাৎ রবীন্দ্র সরোবর। গোটা অঞ্চলটা কসমোপলিটান। বাঙালি, গুজরাতি, মারাঠি, তামিল, কে নেই? কোনওরকম রাজনৈতিক আকচা-আকচি ছিল না। বোমাবাজি মারদাঙ্গার কথা ওখানেই কেউ ভাবতেই পারে না। খুবই শান্ত, ভদ্র পরিবেশ। এলাকার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষিত। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উঁচু উঁচু পোস্টে ছিলেন। এছাড়া কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, নামকরা চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানী, গায়ক, জনপ্রিয় অভিনেতা–এরকম অনেকে। সবাই এঁদের সন্ত্ৰমের চোখে দেখত।
শরৎ ব্যানার্জি রোডে তিন কামরার খোলামেলা, প্রশস্ত ফ্ল্যাটে পঁচিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন চন্দ্রনাথ এবং লতিকা। খুব উঁচু স্তরের অফিসার ছিলেন না চন্দ্রনাথ। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের ছোটখাটো সেকশনের ইনচার্জ। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসের টানটাও বেড়ে যাচ্ছিল। লতিকার পুতুল পুতুল চেহারা। সবসময় মুখে হাসি লেগে আছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নির্ঝঞ্ঝাট ভালোমানুষ।
লেকের কাছাকাছি এই জমকালো এলাকাটায় বাড়িভাড়া বরাবরই একেবারে আকাশ-ছোঁয়া। ভাড়ার অঙ্ক শুনলে চোখ কপালে উঠে যাবে।
পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের ছোটখাটো সেকশনের একজন ইনচার্জ যে এখানে এতকাল কাটিয়ে দিয়েছেন তার কারণ তিনি পুরোনো ভাড়াটে এবং বাড়িওয়ালা মানুষটি শান্ত-শিষ্ট গোছের। টাকাপয়সার খাই তাঁর ছিল না।
শরৎ ব্যানার্জি রোডের ওই বাড়িতেই শমিতার জন্ম। সেখানেই তার বড় হয়ে ওঠা। পাঠভবন স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করার পর হিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে লেডি ব্র্যাবোন কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই সমস্যাটা দেখা দিল। বাড়িওয়ালা শিবনাথ মুখুজ্জে হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাকে মারা যেতে বিরাট সমস্যা দেখা দিল। নতুন বাড়িওয়ালা হয়ে বসল দিবাকর-শিবনাথ মুখুজ্জের একমাত্র ছেলে। সে বাপের ঠিক উলটো। শিবনাথের পারলৌকিক কাজ মিটে যাবার মাসখানেক বাদে দিবাকর এক ছুটির দিনে শমিতাদের ফ্ল্যাটে এসে হাজির। লেশমাত্র ভণিতা-উনিতা না করে সটান বলে ফেলল, ভাড়া বাড়াতে হবে। এতকাল যে টাকায় চন্দ্রনাথরা থেকে এসেছেন দিবাকরের দাবি তার আটগুণ। সেটা অনায্য বা বাড়াবাড়ি কিছু নয়। চন্দ্রনাথরা এগারোশো স্কোয়ার ফিটের তিন কামরার ভাড়া দিতেন দুহাজার। তখন দক্ষিণ কলকাতার ওই পশ এরিয়ায় ওই মাপের একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া কম করে ষোলো-সতেরো হাজার।