তাতান অবশ্য তার প্লেটগুলো সাফ করে ফেলেছে। শমিতা আর সুকান্ত দু-এক চুমুক কফি খেয়েছিল কিন্তু প্লেটে হাত দেয়নি।
দীপেন বাধা দেবার আগেই শমিতা রুম-সারভিসে ফোন করে দিয়েছে এবং কয়েক মিনিটের ভেতর গরম গরম টাটকা খাবার চলে এসেছে
সুকান্ত বলল, এবার শুরু করুন মিস্টার ঘোষ
দীপেন কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বুকে চিন চিন করে ব্যথা শুরু হল। চেনা লক্ষণ। একটা বড় ধরনের স্ট্রোক হবার পর ডাক্তার দত্তগুপ্ত তাকে সবসময় ব্যথানাশক বড়ি সঙ্গে রাখতে বলেছিলেন। যেখানেই দীপেন যায়, একপাতা ওই বড়ি তার পকেটেই থাকে।
ওষুধের প্যাকেটটা দ্রুত বের করে একটা বড়ি জিভের তলায় রাখল দীপেন।
সুকান্ত, শমিতা আর তাতান দীপেনের দিকের তাকিয়ে ছিল। সুকান্ত জিগ্যেস করল, ওটা কী খেলেন মিস্টার ঘোষ, সরবিট্রেট?
দীপেন উত্তর দিল না।
সুকান্ত জিগ্যেস করল, যাদের হার্টের সমস্যা আছে, মাঝে মাঝে যখন বুকে পেইন হয় তাদের ওই ওষুধটা খেতে হয়। আপনার কি সেরকম কোনও প্রবলেম আছে?
আছে। একটা ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল। বাইপাস সার্জারি করতে হয়।
যে সুকান্ত কৌশলে তাদের বংশ, বনেদিয়ানা ইত্যাদি সম্বন্ধে সাত কাহনের জায়গায় চোদ্দো কাহন ফেঁদে বসেছিল তার ভেতর থেকে হঠাৎ দায়িত্বশীল চিকিৎসকটি যেন বেরিয়ে এল।সরি মিস্টার ঘোষ, আমি এটা জানতাম না। কাবাব-টাবাব দেওয়া ঠিক হয়নি।
দীপেন বলল, আজকেই তো আলাপ হয়েছে। জানবেন কী করে? নিজের অজান্তেই তার চোখ শমিতার দিকে চলে যায়। মহিলাটির চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ ফুটে উঠেই চকিতে মিলিয়ে গেল।
সুকান্ত স্ত্রীর দিকে তাকায়।–মিস্টার ঘোষের জন্যে চিকেন স্যুপ-টুপ দিয়ে যেতে বলো। যেন খুব লাইট হয়।
একবার কাবাব, ফিশফিঙ্গার জুড়িয়ে জল হওয়া, এবার হঠাৎ বুকের ব্যথাটা চাগিয়ে ওঠা–দু-দুবার তার জন্য দামি দামি খাবার নষ্ট তো হলই, বিলটা সুকান্ত ব্যানার্জিদেরই মেটাতে হবে। বিড়ম্বনার একশেষ। চুড়ান্ত বিব্রত দীপেন দুহাত নেড়ে বলতে লাগল, না না, প্লিজ কিছু আনাবেন না। আমি এবার যাব। বলেই দ্রুত উঠে দাঁড়ায় সে।
সুকান্ত ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।–যাবেন কী মশাই! আমি একজন ডাক্তার। হার্ট স্পেশালিস্ট। আপনাকে এই অবস্থায় যেতে দিতে পারি না।
বলে কী লোকটা? মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? দীপেন তাকিয়ে থাকে।
সুকান্ত থামেনি।-আপনার বাইপাস হয়েছে। পাহাড়-টাহাড়ে বেড়াতে আসা ভীষণ রিস্কি। সে যাক, আমাদের টু-বেডরুম সুইট। আজ রাতটা এখানেই থেকে যান। আমাদের কোনওরকম অসুবিধা হবে না। সংকোচের কোনও কারণ নেই।
এর মধ্যে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। আর বুকের ব্যথানাশক বড়িটা মুখের লালায় গলে গিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় যন্ত্রণাটা আর নেই দীপেনের। এখানে থেকে যাওয়া মানে জটিল ফাঁদে আটকে যাওয়া। নিজেকে মুহূর্তে শক্ত করে নিল সে। বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ডক্টর ব্যানার্জি। আমাকে আমার হোটেলে ফিরতেই হবে।
দীপেন দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল, আর তখনই তার চোখে পড়ল, শ্বাসরুদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছে শমিতা। সে চলে যাচ্ছে দেখে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। খুব সম্ভব মুক্তির নিঃশ্বাস। দীপেন তাদের স্যুইটে রাত্তিরে থাকুক, খুব সম্ভব সেটা কোনওভাবেই সে চাইছিল না।
মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল দীপেন। সুকান্তও উঠে পড়েছে। ব্যস্তভাবে বলল, আরে আরে, আপনি তো ভীষণ জেদি লোক দেখছি। ডাক্তার হিসেবে বারণ করছি, তবু শুনছেন না?
দীপেন উত্তর দিল না। এর মধ্যে সে দরজার কাছাকাছি চলে গেছে।
একটু দাঁড়ান, যখন থাকতে চাইছেন না, কী আর করা যাবে। আপনাকে আপনার হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি।
দীপেন বলল, দয়া করে একজন অচেনা লোকের জন্যে আপনি আর কষ্ট করবেন না। আমি একাই চলে যেতে পারব।
অচেনা কোথায়? পরিচয় তো হয়েই গেছে। সুকান্ত লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল কিন্তু আর আগেই দীপেন দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে।
আশ্চর্য লোক তো- সুকান্ত ধীরে ধীরে দরজাটা বন্ধ করে কয়েক লহমা দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ফিরে এসে তার সেই সোফাটায় বসল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, এত করে বললাম তবু থাকল না?
শমিতা অন্যমনস্কর মতো বলল, সে যখন থাকতে চাইছিল না তখন এত জোরাজুরি করার কী দরকার ছিল?
স্থির দৃষ্টিতে শমিতাকে লক্ষ করতে করতে সুকান্ত বলল, লোকটা হার্টের পেশেন্ট। তাই
পহেলগাঁওয়ে যে টুরিস্টরা বেড়াতে এসেছে, তাদের মধ্যে আরও কেউ কেউ এই ধরনের পেশেন্ট থাকতে পারে। তাদের রোগের খবর জানতে পারলে আমাদের স্যুইটে থাকতে দেবে নাকি? বলে আর দাঁড়াল না শমিতা। ভেতর দিকের রুমটায় চলে গেল।
অদ্ভুত মিহি একটা হাসির রেখা চকিতের জন্য সুকান্তর ঠোঁটে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
২. রুম-সারভিসে ফোন
০৩.
রুম-সারভিসে ফোন করে ডিনার আনিয়ে নিয়েছিল সুকান্ত। সে লক্ষ করেছে ভালো করে খেতে পারেনি শমিতা। আঁচ করা যাচ্ছিল তার মধ্যে যেন তুমুল আলোড়ন চলছে। অন্যমনস্কর মতো খাবার নাড়াচাড়া করে একটু-আধটু মুখে তুলে সে উঠে পড়েছে।
সুকান্ত জিগ্যেস করেছে, কী হল, কিছুই তো খেলে না!
শমিতা বলল, শরীরটা ভালো লাগছে না।
খাওয়ার জন্য জোরাজুরি তো করেইনি সুকান্ত। আর কোনও প্রশ্নও করল না।