ঢোঁক গিলে অনিমেষ বলেছে, স্যার মেয়েদের নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন।
মানে?
কীভাবে যে আপনাকে বোঝাব?
যা বোঝার আমি খানিকটা বুঝেছি। বাকিটা বলো–
স্যার প্রায়ই রোজ কোনও-না-কোনও মেয়েকে নিয়ে হোটেলে চলে যান। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে কাটান। নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়েছে?
মাঝরাত্তিরে বা শেষ রাত্তিরে নেশায় চুর চুর হয়ে বাড়ি ফেরাটা তখন দীপেনের ডেইলি রুটিনের মধ্যে ঢুকে গেছে। এ নিয়ে শমিতার প্রবল বিতৃষ্ণা, তবু দাম্পত্যটা টিকিয়ে রাখার জন্য বিষ-তেতো বড়ি গেলার মতো মেনে নিয়েছিল সে। কিন্তু মেয়েমানুষ নিয়ে বেলেল্লাপনা, ভাবা যায়? নরকের কোন খাসমহলে পৌঁছে গেছে দীপেন! মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল শমিতার। স্নায়ুমণ্ডলী ছিঁড়েছুঁড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তার চারপাশের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে।
শমিতা রুদ্ধশ্বাসে জিগ্যেস করেছে, তুমি যা বলেছ সেটা যদি মিথ্যে হয় তার রেজাল্ট কী হতে পারে জানো?
জানি ম্যাডাম। শুধু আমিই না, অফিসের প্রায় সবাই জানে। এই নিয়ে ফুসফুস গুজগুজ চলছেই। আমার ভীষণ খারাপ লাগে। ম্যাডাম, আমি আপনাকে রেসপেক্ট করি। কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।
অনিমেষের কথাগুলো শেষ দিকে যেন শুনতে পাচ্ছিল না শমিতা। জিগ্যেস করেছিল, এই মেয়েরা কারা?
বাইরের মেয়ে। পয়সা ঢাললে এদের পাওয়া যায়। অথচ এরা সব ভালো ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। শিক্ষিতা, সুন্দরী। সোসাইটি কোন জাহান্নামে যাচ্ছে, ভাবতে পারবেন না। বলতে বলতে একটু থেমে ফের শুরু করেছে, কিন্তু
কিন্তু কী?
রিসেন্টলি অফিসের একটি মেয়ের ওপর নজর পড়েছে। মেয়েটা খুব ভালো। নাম অঞ্জনা। বাবা নেই। মা বারোমাস ভোগে। দুটো ছোট ভাইবোন আছে। তারা কলেজে পড়ে। অঞ্জনাই একমাত্র আর্নিং মেম্বার। শুনেছি, স্যার দু-একদিন তাকে লং ড্রাইভ কিংবা হোটেলে নিয়ে যেতে চেয়েছেন; এখনও পারেননি। ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে অঞ্জনা। অন্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছে। কিন্তু মুখের কথা খসালেই আজকাল চাকরি এখন জোটে না। সে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সুইট হোম-এর কাজটা ছাড়লে তাদের ফ্যামিলি একেবারে শেষ হয়ে যাবে। অনিমেষ ব্যাকুলভাবে বলেছে, ম্যাডাম, আপনি ওকে বাঁচান–
আমি। শমিতা চমকে উঠেছে।
হ্যাঁ, আপনি। অনিমেষ বলেছে, আপনি ছাড়া ওকে রক্ষা করার আর কেউ নেই।
কী উত্তর দেবে, ভেবে পাচ্ছিল না শমিতা। সে চুপ করে থেকেছে।
অনিমেষ এবার বলেছে, ম্যাডাম, অঞ্জনাকে বলেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে। বাড়িতে যেতে বারণ করেছি। আপনাদের বাড়িতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। স্যার কোনওভাবে জানতে পারলে একটা বিশ্রী সিচুয়েশনের সৃষ্টি হবে। তাই ওকে আপনার স্কুলে দেখা করতে বলেছি।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কেটেছে। পালপাড়ার সেই ভদ্র, সহৃদয়, আপাদমস্তক সৎ যুবকটির বদলে যাওয়ার অর্ধেকটা নিজের চোখে দেখেছে শমিতা। বাকি আধাআধির পরিবর্তনটা যে কতটা ভয়াবহ তার বিবরণ অনিমেষের মুখে শুনতে শুনতে কখনও কুঁকড়ে গেছে সে, কখনও ঘৃণায় সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠেছে, কখনও বা গনগনে আঁচে সে ঝলসে গেছে। ভেতরের তোলপাড়টা একটু থিতিয়ে এলে শমিতা সিদ্ধান্ত নিল কিছু একটা তাকে করতেই হবে। বলেছে, ঠিক আছে, অঞ্জনা যত তাড়াতাড়ি পারে, আমার স্কুলে যেন চলে আসে। তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না। তবু ওর মুখ থেকে সবটা শুনতে চাই
.
মনে পড়ে দু-একদিনের মধ্যে কিন্তু আসেনি অঞ্জনা। পুরো একটি সপ্তাহ পেরোবার পর স্কুলের লাস্ট পিরিয়ড তখন চলছে, তারপরেই ছুটির ঘণ্টা বাজবে, দারোয়ান একটা স্লিপ নিয়ে এল। অঞ্জন দত্ত। জানাল, ভিজিটরস রুমে তাকে বসিয়ে রেখেছে। খবরটা দিয়ে সে চলে গেল।
দশ-বারো মিনিটের মধ্যেই ক্লাস শেষ হল। কাঁধে লেডিস ব্যাগটা ঝুলিয়ে সটান দর্শনার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট রুমটিতে চলে এসেছে শমিতা।
এই সময় বাইরের লোকজন কেউ স্কুলে আসে না। ছাত্রীদের অভিভাবক বা অন্য কারও প্রয়োজন থাকলে তাঁদের আসার কথা স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে। তাই বিশাল ভিজিটরস রুমে একটিমাত্র তরুণী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তার ধ্বস্ত, উৎকণ্ঠিত চেহারা বুঝিয়ে দিচ্ছিল মেয়েটি কে হতে পারে।
শমিতা বলেছে, তুমি নিশ্চয়ই অঞ্জনা।
মেয়েটি ত্বরিত পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।-হ্যাঁ। আগে কেউ কারওকে না দেখলেও সে-ও বুঝতে পেরেছে কে তার সামনে দাঁড়িয়ে।
শমিতা বলেছে, বোসো–
দুজনে মুখোমুখি বসে পড়েছিল। শমিতা এবার বলেছিল, অনিমেষ তোমার ব্যাপারে সব জানিয়েছে। তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। ডিটেলে বলবে।
অঞ্জনা মাথা নীচু করে বলে গিয়েছিল। অনিমেষ যা জানিয়েছে তা আরও বিস্তৃতভাবে। সেই সঙ্গে নতুন কিছু জুড়ে দিয়েছে। কদিন ধরে দীপেন চাপ দিচ্ছিল, সপ্তাহখানেকের জন্য অঞ্জনাকে তার সঙ্গে গোপালপুর অন সিতে যেতে হবে। গেলে অঞ্জনার লাভই হবে। অফিসে বড় রকমের প্রোমোশনের ব্যবস্থা করে দেবে দীপেন। স্যালারি কম করে আট-দশ হাজার টাকা বেড়ে যাবে। তা ছাড়া নানারকম পার্কর্স এবং সব সময়ের জন্য একটা গাড়ি।
শুনে মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল শমিতার। জিগ্যেস করেছে, তারপর?
ভয়ে আমি অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু স্যার রেগুলার আমাকে মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছেন। কী করব ভেবে পাচ্ছি না; একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। চাকরি ছাড়লে আমাদের ফ্যামিলিটা শেষ হয়ে যাবে। আর অফিসে গেলে-ম্যাডাম, আপনি আমাকে রক্ষা করুন। বলে প্রায় আছড়ে পড়ে শমিতার দুটো পা আঁকড়ে ধরেছিল অঞ্জনা।