সেই সঙ্গে টাকাও আসতে লাগল অঢেল। আর এই বিপুল অর্থই দীপেন আর শমিতার জীবনটাকে আগাগোড়া ভেঙেচুরে খান খান করে দিল।
আগে মাঝে মাঝে দু-একটা সিগারেট-টিগারেট খেত দীপেন। কিন্তু কেয়াতলায় আসার কিছুদিন পর থেকে ফ্যামিলি ডিসিপ্লিন বলতে বিশেষ কিছুই আর টিকে থাকল না। রাত্তিরে কখন বাড়ি ফিরবে তার ঠিক নেই। কোনওদিন দীপেন ফিরত বারোটা কি একটায়। কোনও দিন তারও পরে। তার মুখ থেকে মদের গন্ধ পাওয়া যেত। মদ্যপানটা শমিতার ঘোর অপছন্দ। মাতালদের সে প্রচণ্ড ঘৃণা করত। সেটা জানা ছিল দীপেনের। তাই বাড়াবাড়ি রকমের ড্রিংকটা করত না। তবু যতটা সম্ভব সতর্ক হয়েই বাড়ি ফিরত। কিন্তু ঠিক ধরা পড়ে যেত।
শমিতা বলত, ড্রিংকু শুরু করলে! এ তো আমি ভাবতেই পারি না।
কাঁচুমাচু মুখে সাফাই দিত দীপেন, আমাদের যা কাজ তাতে প্রায় রোজই পার্টি লেগে থাকে। এই দু-এক সিপ। বিজনেসের জন্যে এটুকু না করলে
আগে যে সতর্কতা বা সংকোচ ছিল, পরে আর তা রইল না। বেপরোয়া ভঙ্গিতে বেহেড মাতাল হয়ে টলতে টলতে মধ্যরাতে কিংবা শেষ রাত্তিরে ফিরে আসতে লাগল দীপেন।
একটা ভদ্র, সৎ, শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ কীভাবে চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে কোনও কোনও দিন মুষড়ে পড়ত শমিতা, কোনও দিন তার মাথায় আগুন ধরে যেত। ঘৃণায় চোখ-মুখ কুঁচকে যেত তার। একদিন সে বলেছে, এভাবে রাত্তিরে বাড়ি ফেরো, তোমার লজ্জা করে না?
দীপেন হিংস্র, বুনো জন্তু মতো গর্জে উঠেছে।–শাট আপ, আমি কারও বাপের পয়সায় মদ খাই না।
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল শমিতা। কিছু একটা উত্তর দিতে চেয়েছিল কিন্তু গলায় স্বর ফোটেনি। ঠোঁট দুটো শুধু থরথর কাঁপছিল।
সেদিন দীপেনের মাথায় কী চেপেছিল, কে জানে! সে আরও উগ্র হয়ে উঠেছে।-মিডল ক্লাস গাঁইয়া মেয়েদের মতো প্যানপ্যানানি ঘ্যানঘ্যাননি আর কক্ষনো করবে না। নেভার। টলতে টলতে ড্রইংরুমের একধারে যে ডিভানটা ছিল তার ওপর হুড়মুড় করে আছড়ে পড়েছে।
যে মানুষটাকে একদিন শ্রদ্ধা করত, বিশ্বাস করত, যার ওপর ভরসা রাখত, সে কি এই দীপেন? নিদারুণ কষ্ট আর অসহ্য রাগে মাথার ভেতরটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। দীপেনকে কি আগে ভালো করে চিনতে বা বুঝতে পারেনি সে? শমিতার গোপন গর্ব ছিল মানুষকে যাচাই করে নেবার মতো অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যে। কিন্তু দীপেনকে নিয়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিতে এত বড় ভুলটা তার হল কী করে? এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে সে একটা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারেনি।
সেই রাতেই তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল। তারই মধ্যে দীপেনকে শোধরাতে কম চেষ্টা করেনি শমিতা। সকালের দিকটা মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে দীপেন। কিন্তু মাঝরাত্তিরে যখন সে ফেরে সেইসময় তার মাথায় একরোখা, ভয়ংকর জিন ভর করে থাকে। শমিতা ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিল।
.
মনে পড়ে, এইসব মাসকয়েক চলল। সকালের দিকে কাজ-চলা গোছের দু-চারটে কথা; রাত্তিরে যে মূর্তিতে দীপেন ফিরে আসে তার ধারে-কাছে ঘেঁষতে ইচ্ছা করে না, সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে।
একটা পুরুষ এবং একটি নারীর সম্পর্কের গিটটা তখন অনেকটা আলগা হয়ে গেছে। বলা যায়, কোনওরকমে টিকে আছে। সেই সময় একদিন স্কুলে যায়নি শমিতা। আগের রাত থেকেই জ্বর জ্বর লাগছিল। দুপুরবেলা শুয়ে শুয়ে অন্যমনস্কর মতো একটা ইংরেজি মান্থলি ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। মোবাইল স্ক্রিনে নাম এবং নাম্বার ফুটে উঠেছে। অনিমেষ চৌধুরি।
খুব অবাক হয়ে গেছে শমিতা। অনিমেষকে ভালোই চেনে সে। দীপেনদের সুইট হোম-এ সে জুনিয়র অ্যাকাউন্টেন্ট। কত আর বয়স হবে বাইশ কি তেইশ। খুবই ভদ্র, বিনয়ী। একটু লাজুক ধরনেরও। কোনও কারণে দীপেন অফিসে, যেতে না পারলে কখনও-সখনও জরুরি কাজে অনিমেষ এ বাড়িতে তার কাছে এসেছে। ছেলেটার সঙ্গে শমিতার ভালোই আলাপ হয়েছে।
অনিমেষ শমিতাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। কিন্তু আগে কখনও ফোন করেনি। কী হতে পারে? রিংটোন বেজেই চলেছে। একটু দ্বিধা, তারপর ফোন তুলে নিয়ে হ্যালো বলতেই অনিমেষের চাপা, সতর্ক কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছে, ম্যাডাম, একটা বিশেষ দরকারে আপনাকে বিরক্ত করতে হল।
নরম গলায় শমিতা বলেছে, মোটেও বিরক্ত হচ্ছি না। যা বলতে চাইছ, বলো
ম্যাডাম, ভীষণ সংকোচ হচ্ছে, আবার ভয়ও হচ্ছে। কিন্তু আপনাকে না বলেও বাকিটা আর শেষ করল না অনিমেষ।
শমিতা বলেছে, কোনও সংকোচ নেই। নির্ভয়ে বলো।
একটু চুপ করে থেকে অনিমেষ বলেছে, ব্যাপারটা স্যারকে নিয়ে
স্যার মানে দীপেন। আধ-শোওয়া হয়ে কথা বলছিল শমিতা। এবার উঠে বসেছে। অনিমেষের কথাগুলোতে, বলার ভঙ্গিতে কীসের একটা সংকেত যেন ছিল। শমিতা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না। বলেছে, বলো না। তোমাকে তো বলেছি, ভয় নেই।
শমিতা ভরসা দিলেও অনিমেষ কিন্তু দ্বিধা বা ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শুকনো গলায় বলেছে, স্যার জানতে পারলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। আমাদের ফ্যামিলি টোটালি রুইনড হবে।
স্যার জানতে পারবে না। নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার এতটুকু ক্ষতি হবে না। শমিতা বুঝতে পারছিল অনিমেষ দীপেনের ব্যাপারে কোনও সুখবর দেবে না। তার ভেতরকার অস্বাচ্ছন্দ্যটা ঠেলে সরিয়ে প্রবল উৎকণ্ঠা যেন চেপে বসতে শুরু করেছে।