এদিকে স্কুল সারভিস কমিশনের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গিয়েছিল। এই পরীক্ষাতেও দারুণ রেজাল্ট করেছে শমিতা। তিন মাসের মধ্যে দমদমে একটা নামকরা স্কুলে চাকরিও পেয়ে গেল সে। স্কুলে ছুটিছাটা অনেক বেশি। ছুটির দিনগুলো শমিতা মা আর শাশুড়ির কাছে গিয়ে কাটিয়ে আসত। কিন্তু দীপেনের অফিসে প্রচণ্ড প্রেশার, তাই সে পালপাড়ায় খুব বেশি যেতে পারত না। এইভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল।
.
মনে পড়ে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে আসার পর সে আর দীপেন যেন একটা স্বপ্নের উড়ানে উঠে ভেসে বেড়াচ্ছিল। দিনগুলো বড়ই সুখের।
বছর দেড়-দুই কেটে যাবার পর হঠাৎ একদিন রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরে এসে ড্রইংরুমের সোফায় অ্যাটাচি কেসটা ছুঁড়ে দিয়ে বসতে বসতে দীপেন বলেছিল, শমি, তোমাকে একটা দুর্দান্ত খবর দেব। তার চোখ-মুখ থেকে উত্তেজনা এবং উল্লাস যেন ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল।
শমিতা বলেছে, আগে বাথরুমে যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো। চা-টা খাও। তারপর তোমার দুর্দান্ত খবর শোনা যাবে।
না না, এক্ষুনি শুনতে হবে– শমিতার হাতে ধরে তাকে পাশে বসিয়ে দিতে দিতে দীপেন বলেছে, দারুণ একটা অফার এসেছে। চান্স অফ আ লাইফটাইম
উৎসুক চোখে দীপেনের দিকে তাকিয়ে শমিতা জিগ্যেস করেছে, কীসের চান্স?
দীপেন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। বলে যাচ্ছিল, আমাদের বাকি লাইফটা একেবারে পালটে যাবে। ড্রিম, বুঝলে ড্রিম।
কী আশ্চর্য, ড্রিম-টিম, লাইফ পালটে যাওয়া, সবই বুঝলাম। কীসের ড্রিম, কীসের লাইফ পালটাবে, তা কিন্তু এখনও বলোনি।
বলছি, বলছি–
এরপর দীপেন যা বলেছে তা এইরকম। জেনিথ কনস্ট্রাকশন-এর কাজ করতে করতে দীনদয়াল গুপ্তার সঙ্গে আলাপ। তিনিও রিয়েলটি বিজনেসে আছেন। তাঁর কোম্পানির নাম স্টার কনস্ট্রাকশন। কিছুদিন ধরেই তিনি দীপেনকে তার সানি পার্ক-এর বাড়িতে ডাকছিলেন। ব্যস্ততার কারণে যাওয়া যচ্ছিল না। আজ অফিসের প্রেশার কিছুটা কম থাকায় দীনদয়াল গুপ্তকে ফোন করে সানি পার্কে চলে গিয়েছিল। দীনদয়ালজি নতুন আরেকটা ফার্ম খুলতে চান। নামও ঠিক করে ফেলেছেন। সুইট হোম। তিনি চান তাঁর এই নতুন ফার্মে দীপেন জয়েন করুক।
শমিতা মন দিয়ে শুনে যাচ্ছিল। বলেছে, দীনদয়াল গুপ্তার তো একটা কোম্পানি আছে। তার ওপর আরও একটা! মানে
হেসে হেসে দীপেন বলেছে, মানুষের অ্যাম্বিশনের কি শেষ আছে! রিয়েল এস্টেটের বিজনেস এখন রমরম করে চলছে। ফ্ল্যাটের ডিমান্ড যতটা, সাপ্লাই তার চেয়ে অনেক কম। পুরোনো ফার্ম তো রয়েছেই, তার পাশাপাশি নতুন একটা খুললে আরও প্রফিট, কোটি কোটি টাকা
কিন্তু
কীসের কিন্তু?
তুমি জেনিথ কনস্ট্রাকশনে আছ। টোডিজি তোমাকে এত ভালোবাসেন। প্রচুর টাকা স্যালারি দেন। সেই সঙ্গে কতরকম পার্ক, থাকার জন্যে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে এত বড় ফ্ল্যাট। স্কুলে চাকরি এখন আর আগের মতো নেই। আমি ভালো একটা অ্যামাউন্ট পাই। দুজনের যা ইনকাম, কটা মিডল ক্লাস ফ্যামিলি তো ভাবতে পারে? আমার
শমিতাকে থামিয়ে দিয়ে দীপেন বলছে, সবটা আগে শুনে নাও
ঠিক আছে, বলো–
নতুন কোম্পানিতে আমি একজন এমপ্লয়ি হয়ে থাকব না। ইনভেস্টমেন্ট যা করার তার পুরোটাই করবেন দীনদয়ালজি। আমি হব তাঁর ওয়ার্কিং পার্টনার। প্রফিটের টেন পারসেন্ট আমার। কেয়াতলায় আমাদের থাকার জন্যে দীনদয়ালজিদের একটা নতুন বিল্ডিংয়ের পুরো একটা ফ্লোর পাওয়া যাবে।
মনটা খুঁতখুঁত করছিল শমিতার। দুজনের যা দরকার, প্রয়োজনের তুলনায় সেই অঙ্কটা পাঁচ-ছগুণ বেশি। এর বেশি টাকা দিয়ে কী হবে? সে জিগ্যেস করেছে, দীনদয়ালজি তোমার খবর পেলেন কী করে?
রিয়েল এস্টেট এমন এক বিজনেস, কে কোন কোম্পানিতে কী ধরনের সারভিস দিচ্ছে অন্যেরো তার খবর রাখে।
কিন্তু টোডিজি কী মনে করবেন?
দেখো, যে সুযোগটা আচমকা এসে গেছে বাকি লাইফটাইমে সেটা আর সেকেন্ড টাইম আসবে না। এটা আমি ছাড়তে পারি না। আর টোডিজির কথা বলছ তো?
হ্যাঁ।
ওঁকে আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি চিনি। উনি আমাকে কোত্থেকে কোথায় তুলে এনেছেন, সবসময় আমার তা মনে আছে। যতদিন বেঁচে আছি, মনে থাকবে। আমি চাইলে আরও কয়েক হাজার টাকা মাইনে নিশ্চয়ই বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু কোনওদিনই আমাকে ওঁর কোম্পানির পার্টনার করে নেবেন না।
একটু চুপচাপ।
তারপর ফের শুরু করলেন দীপেন।–জেনিথ কনস্ট্রাকশন ছাড়ার আগে আমি টোডিডির সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। আশা করি তাঁর অনুমতি পাওয়া যাবে।
.
শমিতার মনে আছে, দীনদয়াল গুপ্তার অফারটা আসার একমাসের মধ্যে তারা কেয়াতলায় উঠে গিয়েছিল। এটাও লেকের কাছাকাছি। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকা। দীপেনও সুইট হোম-এ জয়েন করেছে। উৎসাহে তখন সে টগবগ করে ফুটছে। সকাল সাতটা-সাড়ে-সাতটায় বেরিয়ে যায়; ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা-বারোটা।
বছরখানেক এভাবেই চলল। মুখের কথায় তো একটা কোম্পানি দাঁড়ায় না। তার পেছনে থাকে অনেক পরিকল্পনা, প্রচণ্ড পরিশ্রম। প্রতিটি স্টেপ হিসেব করে ফেলতে ফেলতে এগোতে হয়। ক্যালকুলেশন বা প্ল্যানিংয়ে ভুল-ত্রুটি থাকলে সমস্ত ব্যাপারটা ডানা ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়বে। তার আর আকাশে ওড়া হবে না।
মনে পড়ে একটা বছর কিংবা আর একটু বেশি সময় লেগেছিল। তারপর সুইট হোম-এর উড়ান শুরু হল। বিল্ডিং তৈরি হয় সেরা মেটিরিয়াল দিয়ে, ফ্ল্যাটের মাপের মধ্যে কারচুপি নেই, যে তারিখে ফ্ল্যাট ডেলিভারি দেবার কড়ার করা হয়, ঠিক সেই তারিখেই দেওয়া হয়। ক্লিন বিজনেস সুইট হোম শুরুতেই ব্র্যান্ড নেম হয়ে উঠল। এতটাই সুনাম ছড়িয়ে পড়ল যে এই শহরের তো বটেই, ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডা থেকে অনেক প্রবাসী বাঙালি অন-লাইনে ফ্ল্যাট বুক করতে লাগল। রিটায়ারমেন্টের পর দেশে ফিরে বাকি জীবন এখানেই তারা কাটিয়ে দিতে চায়।