হে মহান জনগণ, ওপেন-এয়ারের বাংলা যেন কী? ও হা—মুক্তাঙ্গন। খোলা আকাশের নীচে মুক্তাঙ্গনে শমিতা আমাকে ড্রিংক করাতে চাইছে। দেখাই যাক আমার নাকে বঁড়শি লাগিয়ে শমিতা কোথায় কতদুরে টেনে নিয়ে যায়। ভবানীপুর এসে একটা গলির ভিতর গাড়ি ঢোকাল শমিতা। তারপর সোজা যেখানে গিয়ে থামল সেটা একটা বাংলা মদের দোকান। আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে একটু হেসে বলল, স্কচে কিছুই হল না; একটু কান্ট্রি লিকার খেয়ে দেখা যাক। বলেই জোরে হর্ন বাজাল।
আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল, এ শহরের যাবতীয় খুঁড়িখানা-দিশি বা বিলিতি–সবই চেনে শমিতা–হর্নের শব্দে দোকান থেকে একটা ছোকরা ছুটে এল। তার হাতে দাম দিয়ে এক বোতল কালীমার্কা বাংলা মদ আনতে বলল শমিতা।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বোতলটি নিয়ে আমরা গঙ্গার পাড়ে চলে এলাম। ওপেন এয়ারে। মুক্ত অসীম আকাশের তলায় দুজনে মুখোমুখি বসে বোতলটি যখন শেষ করলাম শমিতা পুরোপুরি আউট হয়ে গেছে। আমার মাথার ভেতরেও একটানা জোরালো কনসার্ট বেজে যাচ্ছে। তবে শমিতার মতো বেহুশ হয়ে যাইনি; চেতনার একটু আধটু তলানি তখনও পড়ে আছে।
শমিতা আউট হয়ে গেলেও শুয়ে পড়েনি; বসেই ছিল। তার ঘাড় ভেঙে মাথাটা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। হাতদুটো আলগা হয়ে শরীর থেকে যেন ঝুলছে।
এই ফাঁকা নির্জন জায়গায় আর বসে থাকার মানে হয় না। শমিতাকে টেনে তুলে কোনওরকমে গাড়িতে নিয়ে এলাম। ড্রাইভ করার মতো ওর অবস্থা নয়। আমিই গাড়িটা চালিয়ে ইডেন গার্ডেন, আকাশবাণী ভবন, নেতাজী স্ট্যাচু ইত্যাদির পাশ দিয়ে যখন রেড রোডে এসে পড়েছি শমিতা অতি কষ্টে মাথাটা তুলে জড়ানো গলায় জিগ্যেস করল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।
নেশায় শমিতার চোখ বুজে গিয়েছিল। সেটা আধাআধি খুলে আরক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। তারপর বলল, আমি বাড়ি যাব না।
দারুণ নেশার মধ্যেও চমকে উঠলাম, তা হলে কোথায় যাবেন?
এনি হোয়ার। হেভেন অর হেল–যেখানে ইচ্ছা নিয়ে চলুন।
রেড রোড় বাঁয়ে ফেলে আমরা পার্ক স্ট্রিটের কাছে চলে এসেছিলাম। আমার ইচ্ছা ক্যামাক স্ট্রিট, সাকুলার রোড হয়ে গুরুসদয় রোডে পড়ব; সেখানে থেকে ডাইনে ঘুরে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। শমিতা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ইউ সোয়াইন, বললাম না বাড়ি যাব না। গাড়ি ঘেরাও
কলকাতার রাস্তাঘাটের ম্যাপ ভুলে যায়নি শমিতা। যাই হোক স্কচ এবং বাংলা পাকস্থলীতে চালান করবার পরও এই রকম সেটুকু এখনও আমার আছে যে এত রাত্তিরে খামখেয়ালি মাতাল যুবতী মেয়েকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাকে তার নিজের ঠিকানাতেই জমা করে দেওয়া দরকার। হে মহান জনগণ, চৌরঙ্গী পেরিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকিয়ে দিলাম।
এবার শমিতা আমার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে স্টিয়ারিংটা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। আর সমান চিৎকার করতে লাগ, ইউ বাস্টার্ড, সান অফ এ বিচ–আমার কথা তোমার কানে ঢুকছে না!
এত রাত্রে রাস্তা প্রায় ফাঁকাই; গাড়ি-টাড়ি তেমন নেই। কিন্তু যেভাবে শমিতা স্টিয়ারিংটার ওপর হামলা করছে তাতে গাড়িটা ফুটপাতে উঠে ল্যাম্পপোস্ট-টোস্টে ধাক্কা মেরে অ্যাকসিডেন্ট বাধিয়ে দিতে পারে।
অগত্যা কী আর করা, গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলাম এবং এত রাত্তিরে কোথায় আর যাব; সোজা এন্টালিতে নিজের সেই আস্তানায় ফিরে এলাম।
হে মহান জনগণ, মেয়ে ফুসলে কিডন্যাপ করার চার্জে না পড়ে যাই। আপনারা কিন্তু সাক্ষী হয়ে রইলেন।
যাই হোক গাড়িটা লক করে শমিতাকে ধরে ধরে তেতলার ছাদে উঠতে উঠতে হাতঘড়িটা একবার দেখে নিলাম, এখন সাড়ে বারোটা বাজে। এই মধ্যরাতে গোট বাড়িটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
ছাদে আসতে চোখে পড়ল, দু-ঘরেই লাইট জ্বলছে; আর মেঝেতে বসে দুই হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে ঢুলেছে চার্লি। চার্লির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। তার মাথায় এবং হাতে দুটো বড় ব্যান্ডেজ।
পায়ের শব্দে চার্লি চোখ মেলে তাকাল। আমার সঙ্গে শমিতাকে দেখে মেঝেতে হাতের চাপ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়াল। তার ব্যান্ডেজ-ট্যান্ডেজগুলো দেখিয়ে জিগ্যেস করলাম, তোমার এ অবস্থা হল কী করে?
চার্লি বলল, আমার কথা পরে শুনো। লর্ড, তুমি সত্যিই লর্ড। চোখের কোণ দিয়ে শমিতাকে দেখাতে দেখাতে গলার স্বরটা ঝপ করে অনেকখানি খাদে নামিয়ে দিল, কালকে ফাস্ট দেখলে আর আজই বাড়িতে এনে তুললে! ইউ আর রিয়ালি গ্রেট। কী করে ম্যানেজ করলে বলো তো?
শমিতাকে আমার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললাম, সব বলব। তার আগে চট করে আমি একটা ফোন করে আসছি। তুমি একে একটু দেখো।
আমি বেরিয়ে গেলাম। মনোবীণা সান্যালকে একটা ফোন করতে হবে। আমাদের বাড়ির প্রায় উল্টোদিকে একটা পেট্রোল পাম্প রয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত সেটা খোলা থাকে। সেখান থেকে পয়সা দিলে ফোন করা যায়।
সোজা পেট্রোল পাম্পে এসে ডায়াল করতেই মনোবীণাকে পাওয়া গেল। আমার অবশ্য ভয় ছিল এত রাত্রে তাকে পাব কিনা। সে যাক, ওধার থেকে তার জড়ানো বিরক্ত কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হু দা ডেভিল ইউ আর?
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মহিলা যথেষ্ট পরিমাণে মদ্যপান করেছেন। তার কণ্ঠস্বর রীতিমতো জড়ানো। বললাম, আমি রাজীব-রাজীব সরকার।