হেড অফ দি ফ্যামিলি যদি এই হয়, সংসারের হাল কী দাঁড়াতে পারে সহজেই আন্দাজ করা যায়। লতিকার মা লোকের বাড়ি থেকে অর্ডার-টর্ডার এনে জামা-প্যান্ট সেলাই করে সংসারটাকে জোড়াতালি দিয়ে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কি সংসার বাঁচে। রোজ দুবেলা খাওয়াই জুটত না। লতিকার ঠিক পরের ভাইটার ছিল ক্যান্সার। ডাক্তাররা তার সম্পর্কে সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের ধারণা, ম্যাক্সিমাম আর এক বছর সে বাঁচবে।
যার ফ্যামিলির রেখাচিত্র এই, সেই যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস কিন্তু পরম নিশ্চিন্তে দিন কাটিয়ে যাচ্ছিল। স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের দিকে সে ফিরেও তাকাত না। বরং নেশা আর জুয়োর পয়সায় টান পড়লে লতিকার মাকে মেরে ধরে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে যেত। এ নিয়ে সংসারে খিটিমিটি লেগেই থাকত।
তবু এরই মধ্যে দুবেলা দুটো টিউশানি করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে লতিকা। তার আশা ছিল ইউনিভার্সিটির শেষ ডিগ্রিটা নিয়ে বেরোতে পারলে একটা কিছু হয়ে যাবে। শ চারেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে এক আঁকে এম-এ-টা পাশ করে বেরিয়েও ছিল সে। একে বাংলায় এম-এ তার ওপর খুব নীচের দিকের একটা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিল। এতে চাকরি হয় না। বছর তিনেক নানা স্কুল, সরকারি আর মার্চেন্ট অফিসে ঘোরাঘুরির পর সেই আত্মহত্যার দিন দুপুরে ক্যামাক স্ট্রিটের এক প্রাইভেট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কনসানে গিয়ে সোজা ডিরেক্টরের চেম্বারে ঢুকে পড়েছিল।
ডিরেক্টর মিস্টার সোনি–পঞ্চান্নর মতো বয়স, টকটকে গায়ের রঙ, চওড়া হাড়ের ফ্রেমে মজবুত শরীর, কাঁচা পাকা চুল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, বেশ সুপুরুষই বলা যায় তাকে-সহানুভূতির সঙ্গে লতিকার সব কথা শুনেছেন, সুন্দর সহৃদয় ব্যবহার করেছেন, কফি খাইয়েছেন, বলেছেন চাকরি নিশ্চয়ই দেবেন এবং সেটা তখনই।
কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গিয়েছিল লতিকার। রুক্ষ কর্কশ ওয়ার্ল্ডে সেই প্রথম একজন হৃদয়বান মানুষের দেখা পেয়েছিল সে। কিন্তু কী ধরনের কাজ তাকে করতে হবে, জানতে গিয়েই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছিল।
মিস্টার সোনি জানিয়েছিলেন, কাজটা তেমন কিছু নয়। তিনি বিপত্নীক এবং একেবারেই নিঃসঙ্গ। ছেলেমেয়েরা বিয়ে-টিয়ে করে এবং কাজের সূত্রে দূরে দূরে থাকে। এদিকে অফিসের কাজটুকু বাদ দিলে বাকি সময়টা তিনি বড় একা হয়ে যান। এই সময়টার জন্যে তার একজন সঙ্গিনী দরকার। স্নিগ্ধ, মধুর, সফট টাইপের একটি মেয়ে চাই-ঠিক যেমনটি লতিকা। মিস বিশ্বাস যেন ঈশ্বর-প্রেরিত হয়েই তার কাছে এসেছে।
মিস্টার সোনি আরও বলেছিলেন, কাজটা হোল-টাইমের। লাউডন স্ট্রিটে তাঁর তিন হাজার স্কোয়ার ফুটের প্রকাণ্ড ফ্ল্যাট আছে। লতিকাকে সেখানে গিয়ে থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে ভাই-বোন মা-বাবাকে সে দেখে আসতে পারে। তা ছাড়া বছরে দু-তিনবার মিস্টার সানিকে ইওরোপ-আমেরিকা যেতে হয়, লতিকাকেও তখন তার সঙ্গে যেতে হবে।
লতিকা বুঝতে পারছিল, এই মধ্যবয়সি নোকটা মহানুভবতার মুখোস এঁটে তাকে তার মিস্ট্রেস হয়ে থাকতে বলছে। ইউনিভার্সিটির শেষ ডিগ্রিটা হাতে নিয়ে আসার পরও কেউ যে এমন একটা চাকরির কথা বলতে পারে–এটা ভাবতে গিয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছিল লতিকার; মাথার ভেতর কোথায় যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছিল, গলগল করে ঘামতে শুরু করেছিল সে। একটা কথাও আর না বলে মিস্টার সোনির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল লতিকা। তারপর অন্ধের মতো রাস্তায় নেমে একটা বাস ধরে বাড়ি ফিরেছিল। ফিরেই দ্যাখে ক্যান্সারের রুগী ভাইটার অবস্থা খুব খারাপ; অসহ্য যন্ত্রণায় তার শরীর বেঁকে যাচ্ছে। মা এবং অন্য ভাইবোনরা তাকে ঘিরে বসে সমানে কাঁদছে।
দুপুরে যখন লতিকা ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট অফিসে চাকরির খোঁজে যায় তখন ভাইটার অবস্থা এ রকম ছিল না। যাই হোক, যন্ত্রণা বাড়লে ওকে পেইনকিলার ট্যাবলেট দেওয়া হয়। তাড়াতাড়ি একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিল লতিকা; কিন্তু কষ্ট কমেনি। তখন পর পর আরো দুটো ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিল লতিকা। কিন্তু তাতেও যখন কিছু হল না তখন তার বুকের ভিতরকার শিরা-টিরা মুচড়ে-টুচড়ে কী রকম যেন হয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক এই সময় বাবা যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস বাড়ি এসে ঢুকেছিল। সঙ্গে কালো গাবদা গাবদা রক্ষাকালীর মতো চেহারা এক মহিলা আর দুটো বাচ্চা। যোসেফ গঙ্গাপদ আনুষ্ঠানিকভাবে মহিলা এবং বাচ্চা দুটির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। লতিকাকে বললেও, কথাটা সবারই উদ্দেশ্য। ওই মহিলাটি গঙ্গাপদর দ্বিতীয় স্ত্রী, অর্থাৎ লতিকার ছোট মা এবং ছেলে দুটো তার ভাই। এতদিন বেহালার ওদিকে ভাড়া বাড়িতে ওরা থাকত। এখন যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস সিদ্ধান্ত করেছে, ওদের আর দূরে থাকার মানে হয় না। সে বলেছিল, সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকবি-বুঝলি লতু! তোর ফাস্ট মাদার, সেকেন্ড মাদার, আমি, তোরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে আমরা একটা হ্যাপি ফ্যামিলি; সুখী পরিবার।
বাবা যে লুকিয়ে লুকিয়ে আরেকটি বিয়ে করেছে এবং সন্তান-সন্ততি উৎপাদন করে বসে আছে, এ খবরটা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি। প্রসেসান করে দ্বিতীয় পক্ষের সংসারটিকে নিয়ে আসায় এই ব্যাপারটা আচমকা বাজ পড়ার মতো ঘটনা। বাবার কথা শেষ হতে না হতেই লতিকার আসল মা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আর তখন লতিকার মাথার ঠিক ছিল না; বাড়ি থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো সে বেরিয়ে পড়েছিল। সারাদিনে যা ঘটনা ঘটে গেছে সবগুলো মেন্টাল ব্যালান্স অর্থাৎ মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। অনেকক্ষণ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে স্থির করে ফেলেছিল আত্মহত্যা করবে।