একসময় মাথার ওপর ঘন পাতার ছাদ শিথিল হয়ে এল। এবার টুকরো টুকরো আকাশের নীলাভা নজরে আসছে। বাঘনখের আঁচড়ের মতো ফালি ফালি পথে, কোমরসমান পাহাড়ী ঘাসের ওপর জাফরি-কাটা রোদ এসে পড়েছে।
অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে দুজনে। এখান থেকে টিজু নদীর খরধারা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শীতের টিজুতে বর্ষার সেই দুর্বার যৌবন নেই। এখানে সেখানে রাশি রাশি পাথরের কঙ্কাল আত্মপ্রকাশ করেছে। তবু ভৈরব গর্জনে পাথরের চাঁইগুলোর ওপর আছড়ে আছড়ে পড়ছে ঘন নীল জল। আক্রোশের মতো ছিটকে ছিটকে বেরুচ্ছে ফেনার ফুলকি।
বিশাল একটা নিখাঙি গাছের তলা দিয়ে টিজু নদীর কিনারায় চলে এল সেঙাই আর রেঙকিলান। সামনে রোদমাখা উপত্যকাটা নজরে আসছে। টিজু নদীর ঘন নীল দেহে সোনার রেখার মতো এসে পড়েছে শীতের রোদ।
শেষবারের মতো বাঁশের চাচারিতে শব্দ তুলল রেঙকিলান। আর সঙ্গে সঙ্গে ওঙলেদের উত্তরও ভেসে এল।
হঠাৎ খুশিতে একটা আওয়াজ করে উঠল রেঙকিলান, হুই–হুই দ্যাখ। দেখেছিস?
কী? কোথায়? ফিরে তাকাল সেঙাই।
হুস-স-স-স, আস্তে। সেঙাই-এর সরব কৌতূহলের ওপর যতি টানল রেঙকিলান, সম্বর। কানা না কী! হই যে নদীর ওপারে–
এবার সত্যিই দেখতে পেল সেঙাই। একটা মেশিহেঙ ঝোঁপের আবডাল থেকে টিজু নদীর দিকে মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে সম্বরটা। চলমান জলের আয়নায় নিজের রূপ দেখতে দেখতে আবিষ্ট হয়ে গিয়েছে প্রাণীটা। বাঁকা বাঁকা শিঙ, শান্ত স্নিগ্ধ দু’টি চোখ। খয়েরি দেহে সাদা সাদা চএ।
সেঙাই বলল, আস্তে। একটা শিকার ফসকেছে। খুব সাবধান। এটাকে মারতেই হবে। দূরের বাঁকটা ঘুরে নদী পার হই চল।
দূরের বাঁকে যাব কেন?
সাধে কি বলি, বিয়ে করে একেবারে ছাগী হয়ে গেছিস। এখান দিয়ে পার হলে দেখতে পাবে না! আমাদের দেখলে তোর বাড়ি ভোজের নেমন্তন্ন নেবার আশায় বসে থাকবে! খুব বাহাদুর। এই বুদ্ধিতে শিকারি হয়েছিস! কণ্ঠ থেকে তাচ্ছিল্য ঝরল সেঙাইর।
হয়েছে, হয়েছে। ফ্যাক ফ্যাক করিস না। চল হুই বাঁকের দিকে। নরম গলায় বলল রেঙকিলান। আর মনে মনে সেঙাই-এর খাসা বুদ্ধির তারিফ করল। সত্যিই তো, এ কথাটা তো তার মগজে উঁকি মারেনি!
বাঁকের মুখ অনেকটা সমতল। টিজুনদী এখানে খানিক শান্ত। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলে নানা রঙের রাশি রাশি পাথর। কোমরসমান স্রোত ডিঙিয়ে ওপারে চলে এল দুজনে। তারপর আখখাকিয়া গাছের আড়াল দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মেশিহেঙ ঝোঁপটার পাশে এসে দাঁড়াল।
সেঙাই তাকাল রেঙকিলানের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত টিজু নদীর উদ্দাম নীল স্রোতকে চমকিত করে মেঘ গর্জন করে উঠল। নদীর আরশিতে শিউরে উঠল সম্বরের মুগ্ধ ছায়া। মেঘ গর্জায়নি, বাঘ ডেকেছে।
চকিত রেঙকিলান বলল, চিতাবাঘ।
হিসহিস করে উঠল সেঙাই, খুব সাবধান।
তারপরেই পলকের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। এক ঝলক বিদ্যুতের মতো সম্বরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা চিতাবাঘ। সঙ্গে সঙ্গে বর্শাটা আকাশের দিকে তুলে ধরল সেঙাই। তীক্ষ্ণমূর্খ ফলাটায় মৃত্যু ঝিলিক দিয়ে উঠল। পেশীর সমস্ত শক্তি কবজির মধ্যে জড়ো করে বর্শাটা ছুঁড়ে মারল সেঙাই। কিন্তু তার আগেই সম্বরটাকে পিঠের ওপর তুলে মেশিহেঙ ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে চিতাবাঘটা। আর সেঙাই-এর বর্শাটা সাঁ করে একটা খাটসঙ গাছের গুঁড়িতে গেঁথে গিয়েছে।
তীব্র গতিতে ঘুরে দাঁড়াল সেঙাই, কি রে, বর্শা লাগল না যে চিতাবাঘের গায়ে?
তার আমি কী জানি। লাগাতে পারিসনি, তাই বল।
কাল রাতে বউ-এর কাছে শুয়েছিলি, আর সেই কাপড়ে নিশ্চয়ই উঠে এসেছিস। তা না হলে শিকার ফসকে যাচ্ছে কেন? সেঙাইর দুচোখে কুটিল সন্দেহ, ইজা রামখো!
বাজে কথা। কাল তো আমি মোরাঙে গিয়ে শুয়েছিলাম। এক কাজ করি আয়, চিতাবাঘটা বেশি দূর যেতে পারেনি এখনও। আশেপাশেই আছে। সাবধানে খুঁজে বার করি চল। একটু থামল রেঙকিলান। তারপর আবার বলতে শুরু করল, আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে, কাল শুয়োর মারিসনি তো সেঙাই?
কী বললি? গর্জন করে উঠল সেঙাই, নে রিহুগু (তোকে বাঘে খাক)। কাল সারাদিন আমি মোরাঙ থেকে বেরিয়েছি?
শিকারের আগের রাতে নাগারা স্ত্রীর সঙ্গে এক বিছানায় শোয় না। যারা অবিবাহিত, তারা শুয়োর হত্যা করে না। এ রাতটা তাদের কঠোর শুচিতা দিয়ে ঘেরা। শিকারিরা এ রাতে গ্রামের মোরাঙে এসে বিছানা বিছায়। তাদের বিশ্বাস, কলুষিত দেহমন নিয়ে শিকারে বেরুলে অসফল হয়ে ফিরতে হয়। তার ফলে ক্রুদ্ধ বনদেবীর অভিশাপ এসে পড়ে। রিখুস প্রেতাত্মা কুপিত হন। তাদের ওপর। বনদেবীর অভিশাপ আর রিখুস প্রেতাত্মার কোপ বড় ভয়াল। সে অভিশাপ আর কোপ পাহাড়ে পাহাড়ে দাবাগ্নি ছড়িয়ে দেয়। তাতে ছারখার হয়ে যায় সমস্ত নাগা পৃথিবী।
একসময় রেঙকিলান বলল, দেরি করতে হবে না, চল। আবার চিতাটা না ভেগে পড়ে।
চল।
খাটসঙ গাছের গুঁড়ি থেকে বর্শাটাকে টেনে খুলে নিল সেঙাই। কোমরে বাঁশের লম্বা খাপ, তার মধ্যে ফলাটাকে ঢুকিয়ে দিল সে। তারপর মেশিহেঙ ঝোঁপটা পাশে রেখে পাহাড়ী ঘাসের ওপর নিঃশব্দে পা ফেলে এগিয়ে যেতে শুরু করল। সামনে সেঙাই। পেছনে রেঙকিলান। তাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় ধনুকের ছিলার মতো প্রখর হয়ে উঠেছে। তাদের ঘ্রাণ কান-দৃষ্টি আর স্নায়ু অতিমাত্রায় সচেতন। সন্দেহজনক একটুমাত্র শব্দে চমকে চমকে উঠছে দুজনে।