দুজনের একবার চোখাচোখি হল।
একজন বলল, কি রে সেঙাই, কোন দিকে যাবি? এদিকে সুবিধে হবে না, মনে হচ্ছে।
সেঙাই এতক্ষণ তার পী মুঙ কাপড়ে একটা শক্ত গিঁট দিয়ে নিচ্ছিল। গম্ভীর গলায় বলল, হু, তাই মনে হচ্ছে। একটা কানা হরিণ পর্যন্ত নজরে আসছে না। এক কাজ করা যাক, ওই টিজু নদীর দিকে চল যাই রেঙকিলান। সম্বর কি চিতাবাঘ পাবই ওদিকে।
একবার চমকে উঠল রেঙকিলান। গলাটা তার কেঁপে কেঁপে উঠল, কিন্তু ওদিকে তো সালুয়ালাঙ বস্তি। আমাদের শত্রুপক্ষ। ওরা দেখলে একেবারে কিমা বানিয়ে ছাড়বে দুজনকে।
দুচোখ ঘৃণায় ভরে উঠল সেঙাই-এর, কেলুরি বস্তির নাম তুই ডুবিয়ে দিবি টিজু নদীতে। বিয়ে করে একটা ছাগী হয়ে গেছিস রেঙকিলান।
কী বললি! রেঙকিলানের দু’টি পিঙ্গল চোখে হত্যা ঝিলিক দিয়ে উঠল, আমি ভীতু হয়ে গিয়েছি! আমি ছাগী বনে গিয়েছি!
হু-হু। ছাগী না, একটা টেফঙ (পাহাড়ী বানর) হয়ে গেছিস। নির্বিকার গলায় বলল সেঙাই, আপোটিয়া (তুই মর)।
খিস্তিটা নিঃশব্দে পরিপাক করল রেঙকিলান, তারপর সেঙাইর দিকে তাকাল। দু’টি চোখ থেকে তার পিঙ্গল আগুন বেরিয়ে আসছে। কিন্তু আশ্চর্য শান্ত গলায় সে বলল, চল, কোন চুলোয় যাবি–
সেঙাই সামনের দিকে বর্শাসমেত হাতখানা প্রসারিত করে দিল, হুই টিজু নদীর দিকে
বেশ। জঙগুপি কাপড়ের গোপন গ্রন্থি থেকে একটা বাঁশের চাচারি বার করল রেঙকিলান। তারপর আড়াআড়ি দু’টি ঠোঁটের মধ্যে রেখে শব্দ করে উঠল। সেই তীক্ষ্ণ শব্দের তরঙ্গ প্রতিধ্বনিত হতে হতে উপত্যকার ওপর দিয়ে খাড়াই প্রান্তরের দিকে মিলিয়ে গেল। একটু পরেই সেই একই শব্দ পাহাড়ের মাথা থেকে বাতাসের ওপর তরঙ্গিত হতে হতে ভেসে এল। রেঙকিলানের শব্দটি সংকেত। পরের শব্দটি উত্তর।
সেঙাই বলল, তা হলে ওঙলেরা ঠিকই এসে গেছে।
হু। আর দেরি করে লাভ নেই। চল। ওরা এখনই দূর পাহাড় ঘুরে এখানে এসে পড়বে।
বাদামি পাথরটার ওপর থেকে দুজনে ভোরপাঙ গাছের নিবিড় অরণ্যে ঢুকল। মাথার ওপর পাতার নিচ্ছেদ ছাদ। রোদ আসার একটুকু ফঁক নেই। নাগা পাহাড়ের এই ঘন বনে সূর্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ। নিচে আশ্চর্য হিমাক্ত ছায়া। মাঝে মাঝে বাঘনখের আঁচড়ের মতো ফালি ফালি পথ। চারপাশে কাঁটালতা ঝুলছে। খুগু পাতা দুলছে। আর উদ্দাম হয়ে উঠেছে বুনো কলার বন। ঋতুমতী পৃথিবী এই নাগা পাহাড়ের উপত্যকায় অকৃপণভাবে সুশ্যাম জীবন উপহার দিয়েছে।
পাহাড়ী ঘাস। কোথাও কোমরসমান উঁচু, কোথাও হাঁটু পর্যন্ত। ওক আর জীমবো গাছের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে চলেছে সেঙাই আর রেঙকিলান। বার বার কাঁটালতার আঘাত লাগছে। তামার দেহ থেকে রক্তরেখা ফুটে বেরিয়েছে। সেদিকে একবিন্দু হৃক্ষেপ নেই।
মাথার ওপরে আকাশ নেই। শুধু ওক আর ভেরাপাঙ পাতার নীরন্ধ্র ছাদ প্রসারিত হয়ে রয়েছে।
মাঝে মাঝে বুনো মৌমাছির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে গাছের আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী বানরের দল। দূরে দূরে বুনো ঘাসের ওপর মাথা তুলেই আউ পাখিরা অদৃশ্য হচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে লাল রঙের শানিলা পাখিদের। অস্বাভাবিক লম্বা তাদের ধূসর রঙের ঠোঁট। গাছের শাখায় শাখায় ঠোঁট দিয়ে ঠক ঠক শব্দ করছে খারিমা পতঙ্গেরা।
পাহাড়ী বনের বাধা ছিঁড়ে ছিঁড়ে এগিয়ে চলেছে সেঙাই আর রেঙকিলান। কিছুক্ষণ পর পর বাঁশের চাচারিতে তীব্র-তীক্ষ্ণ শব্দ করছে রেঙকিলান। সঙ্গে সঙ্গে আগের মতোই বাতাসে দোল খেতে খেতে ভেসে আসছে তার উত্তর। পাহাড়ের দূর সীমা ধরে তাদের অনুসরণ করে চলেছে ওঙলেরা।
নাগাদের মধ্যে শিকারের একটি প্রথা আছে। শিকারিরা ঘন বনের ভেতর দিয়ে শিকারের সন্ধানে এগিয়ে যাবে। আর দুজন মানুষ বহু দূরে পাহাড়ের প্রান্ত বেয়ে বেয়ে তাদের খাবার নিয়ে অনুসরণ করবে। বাঁশের চাচারিতে শব্দ তুলে দুদলের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়, এবং উভয় দলের অবস্থিতি বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
আচমকা একটা খুঙগুঙ গাছের মগডাল থেকে একটা পাহাড়ী ময়াল সাপের বাচ্চা আছড়ে এসে পড়ল ঘাসবনের ওপর। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সেঙাই আর রেঙকিলান। একটি মাত্র মুহূর্ত। তারপরেই সেঙাইর বর্শাটা আকাশের দিকে উঠে গেল। সেই হিমছায়ার মধ্যেও ঝকমক করে উঠল খরধার ফলাটা। সেঙাইর ঠিক পাশেই রেঙকিলান। তার চোখেও পিঙ্গল ঝিলিক।
কিন্তু আশ্চর্য! সেঙাই-এর বর্শা আকাশের দিকেই স্থির হয়ে রইল। চোখের পলকে ময়ালের বাচ্চাটা একটা কালো বিদ্যুতের রেখা এঁকে সাপেথ কুঞ্জের আড়ালে পলাতক হল।
প্রথম শিকার। তা-ও ফসকে গেল। সেঙাই তাকাল রেঙকিলানের দিকে। রেঙকিলানর চোখও তার দিকেই নিস্পলক হয়ে রয়েছে। আর দুজনের দৃষ্টিতেই পৃথিবীর সমস্ত সন্দেহ কপিশ দু’টি মণির আকার নিয়ে স্থির হয়ে আছে। সেঙাই ভাবছে, কোনো অনাচার করেনি তো রেঙকিলান কি তার বউ? রেঙকিলান ভাবছে, শিকারে আসার আগে অপবিত্র কোনো কাজ করেছে কি সেঙাই? কলুষিত করেছে দেহমনকে? কেউ কোনো কথা বলল না। দুজনের দৃষ্টিই বিস্ফারিত। শুধু একটি সন্দেহের ঢেউ ফুলে ফুলে উঠছে তাদের মনে। সেই সঙ্গে একটা সর্বনাশা ইঙ্গিত মাথার মধ্যে চমক দিয়ে উঠেছে। তবে কি, তবে কি রিখুস প্রেতাত্মা ময়াল সাপের মূর্তি ধরে এসেছিল!
কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর টিজু নদীর দিকে পা বাড়িয়ে দিল সেঙাই। তার পেছন পেছন পূর্বপার্বতী রেঙকিলান। একটি কথাও বলছে না কেউ। সেঙাইও না, রেঙকিনও না। শুধু অজানা জলপ্রপাতের অবিরাম কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুজনে ভাবছে, আজ রাতেই আনিজার নামে মুরগি জবাই করে উৎসর্গ করতে হবে।