প্রফুল্ল রায়
বাটানগর
২০ ভাদ্র : ১৩৬৪
.
প্রকাশকের নিবেদন
পূর্বপার্বতী প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রকাশক ছিলেন বেঙ্গল পাবলিশার্স। কয়েকটি সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়ার পর অন্য একটি প্রকাশন-সংস্থা থেকে এটি বেরোয় এবং আরো কয়েকটি সংস্করণের পর আমরা এই ধ্রুপদী উপন্যাসটি প্রকাশ করি। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে চারটি মুদ্রণ শেষ হয়েছে। বর্তমানে আগাগোড়া পরিমার্জিত হয়ে সুদৃশ্য রয়াল সাইজে এটির সুমুদ্রিত, শোভন রাজ সংস্করণ প্রকাশিত হল।
একান্ন বছর আগে প্রথম প্রকাশকালে পূর্বপার্বতীর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন বম্বেপ্রবাসী প্রখ্যাত শিল্পী আশু বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকদিন হল তিনি প্রয়াত। শিল্পীর সম্মানে তার অনবদ্য প্রচ্ছদটি দিয়ে সাজিয়ে পূর্বপার্বতীর রাজ সংস্করণ পাঠককে উপহার দেওয়া হল।
বেঙ্গল পাবলিশার্স-এর সৌজন্যে এটি সম্ভব হয়েছে।
সুধাংশুশেখর দে
.
কাহিনি
১.
পাহাড়ী উপত্যকা। ভেরাপাঙ গাছের ছায়াতল দিয়ে বিশাল একটা চড়াই-এর দিকে উঠে গিয়েছে। ভেরাপাঙ আর জীমবো গাছ। ঘনবদ্ধ। পাহাড়ের তামাভ মাটি থেকে কণা কণা প্রাণ সঞ্চয় করে উদ্দাম হয়ে উঠেছে এই অরণ্য। মাঝে মাঝে সাঙলিয়া লতার ছায়াকুঞ্জ। যেখানেই একটু র পেয়েছে সেখানেই পাথুরে মাটি চৌফালা করে মাথা তুলেছে আখুশি আর খেজাঙের। ঝোঁপ। আতামারী লতা সাপের মতো বেয়ে বেয়ে উঠে গিয়েছে খাসেম গাছের মগডালে।
উদ্দাম বন। কাঁটালতার জটিল বাঁধনে বাঁধনে কুটিল হয়ে রয়েছে। রোদ, বৃষ্টি আর অবারিত বাতাস থেকে স্বাস্থ্য আহরণ করে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।
পাহাড়িয়া অরণ্য। ভয়াল আর ভয়ঙ্কর। এতটুকু ফাঁক নেই, এতটুকু রন্ধ্র নেই। শুধু মৃত্যুর মতো আশ্চর্য এক হিমছায়া নিথর হয়ে রয়েছে তার পাঁজরের নিচে। সবুজ আর সবুজ। একটা তরঙ্গিত সবুজ সমুদ্র স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে কোনো পাহাড়ী ডাইনির কুহকে।
ভীষণ এই পাহাড়িয়া বন। তবু মেশিহেঙ ঝোঁপের বাহারি ফুলে এই নিষ্ঠুর বন্যতার মধ্যে কিছুটা স্নেহের আভাস পাওয়া যায়। কিছুটা শান্তি আছে সোনা গাছের নরম নরম মুকুলে।
অনেক দূরে বৃত্তাকারে বাঁক নিয়েছে টিজু নদী। ঘন নীল জল। রাশি রাশি পাথরের বাধাকে কলোল্লাসে মাতিয়ে মাতিয়ে, ফেনার ফুলকি ফুটিয়ে ফুটিয়ে, বাঁকে বাঁকে হারিয়ে গিয়েছে। এখান থেকে নীল হাঁসুলির একটা চকিত ঝিলিকের মতো মনে হয় টিজু নদীকে। এই পাহাড়ী বনের কোথাও কোনো খাড়াই টিলার ওপর থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে নেমেছে জলপ্রপাত। কোথাও বা সাপেথ কুঞ্জের পাশ দিয়ে শব্দহীন ঝরনা রেখার আঁকিবুকি টেনে নিচের দিকে মিলিয়ে গিয়েছে। দূরের ওই টিজু নদীর উচ্ছ্বাস, অজানা প্রপাতের এই কল কল উল্লাস–এগুলিই এই পাহাড়ী বনের হৃৎপিণ্ড হয়ে অহরহ বেজে চলেছে।
শীতের রোদে মধুর আমোদ আছে। সেই রোদই সোনালি আমেজের মতো ছড়িয়ে পড়েছে উপত্যকায়। সবুজ সমুদ্রটা রোদের অকৃপণ সোনা মেখে রূপময় হয়ে উঠেছে।
ওপরে অবারিত আকাশ। তার নীল রঙে আশ্চর্য ক্রুরতা। কোথাও দু-এক টুকরো মেঘের ভ্রুকুটি ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেক উঁচুতে পাহাড়ের চড়াইটা ঘিরে এখনও সাদা কুয়াশার একটা চিকন রেখা স্থির হয়ে আছে।
বাঁ দিকে অবিন্যস্ত ওক বন আর আপুফু গাছের জটিল জটলা। হঠাৎ তার মধ্য থেকে যুঁড়ে বেরিয়ে এল দু’টি বন্য মানুষ। ঘন তামাভ গায়ের রং। বিশাল বুকে, অনাবৃত বাহুসন্ধির দিকে থরে থরে পেশীভার উঠে গিয়েছে। স্ফীত নাক, মোটা মোটা ঠোঁট। ওদের ভাসা ভাসা পিঙ্গল চোখের মণিতে আদিম হিংস্রতা। কানের ওপর দিয়ে সারা মাথায় চক্রাকার রেখা টেনে চুল কামানো। খাড়া খাড়া উদ্ধত চুল দু’টি কান আর ঘাড়ের ওপর কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়েছে। বিরাট থাবায় দুজনেই মুঠো করে ধরেছে জীমবো পাতার মতো তীক্ষ্ণমুখ বর্শা। মোটা মোটা আঙুলের মাথায় ধারাল নখ। বর্শার লম্বা বাঁশে সেই নখগুলি স্থির হয়ে বসেছে। সারা মুখে দাড়িগোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। গাল, চিবুক আর গলা থেকে তাদের নির্মূল করা হয়েছে। কানে। পিতলের গোলাকার গয়না। সারা দেহ অনাবরণ। একজনের কোমরের চারপাশে হাতখানেক চওড়া পী মুঙ কাপড়। গাঢ় কালো রঙের প্রান্তে ঘন লালের আঁকিবুকি। পরিষ্কার কৌমার্যের সংকেত। আর একজনের পরনে জঙগুপি কাপড়, একেবারে জানু পর্যন্ত নেমে এসেছে। ঘন নীল রঙের ওপর চারটে সাদা সাদা দাগ। সাদা দাগের আড়াআড়ি চারটে লাল রেখা আঁকা। বিবাহিতের পরিচয়। সেই সঙ্গে বোঝা যায়, মানুষটা প্রিয়জনদের অনেকগুলো ভোজ দিয়ে জঙগুপি বস্ত্রের সম্মান অধিকার করেছে।
সামনেই একটা বাদামি রঙের বিশাল পাথর। চারপাশে পাংশু ঘাসে পাহাড়ী রুক্ষতা। ঘাসের পাতায় পাতায় রাত্তিরে শিশির ঝরেছিল। সেই শিশিরকণা শুভ্র আর নিটোল মুক্তোর। মতো জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। আবার সূর্যের নতুন উত্তাপে এখন গলে গলে টলটলে জলবিন্দু হয়ে গিয়েছে। রুক্ষ পাহাড়ী ঘাসের ওপর ফাটা ফাটা পায়ের চিহ্ন এঁকে বাদামি পাথরের ওপর এসে দাঁড়াল দুজন।
শীতের হিমাক্ত বাতাস উঠে আসছে টিজুনদীর জলধারা থেকে, সাঁ সাঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওক আর ভেরাপাঙ গাছের জঙ্গলে। সেদিকে এতটুকু লক্ষ্য নেই পাহাড়ী মানুষ দু’টির। বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই।