বিড়বিড় করে মাথোলাল বলল, সায়েবরা আমার দোকানটা ভেঙে দিল। আমি তো কোনো দোষ করিনি। খালি রানী গাইডিলিও আর গান্ধিজির গল্প বলেছি পাহাড়ীদের কাছে। বুঝলি বুধোলাল, বাপ আমার, খবদ্দার হুই পাহাড়ে যাবি না। নাগা পাহাড়ে পাপ ঢুকেছে। সীয়ারাম, সীয়ারাম। আঃ-আঃ-আঃ–
গোঙাতে গোঙাতে থেমে গেল মাখোলাল। ঠোঁট দুটো একটু একটু নড়ল, মুখটা হাঁ হয়ে রইল। কোটরের মধ্যে চোখ বুজে রয়েছে। একসময় সমস্ত শরীর নিস্পন্দ হয়ে গেল তার।
বাঁ হাত দিয়ে মাধোলালের কাঁধে কঁকানি দিল সেঙাই। বলল, শোন মাখোলাল, তোর কথামতো আমি কাজ করেছি। সায়েবদের সঙ্গে আমাদের বস্তির লড়াই হয়েছে। রানীর খোঁজে শয়তানরা গিয়েছিল আমাদের বস্তিতে। আমি তাদের মারিনি। তুই বারণ করেছিলি। ওরাই আমাদের বন্দুক দিয়ে খুঁড়েছে, ঘরে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অনেক সয়ে সয়ে কোহিমার বড় ফাদারকে বর্শা হাঁকড়ে ছিলাম। কী করব বল, ঠাকুমাকে আর জামাতসুকে সাবাড় করলে ওরা। মেজাজটা বিগড়ে গেল কি-না।
মাধোলাল জবাব দিল না, তেমনি নিথর পড়ে রইল।
বসন্ত বললেন, মাধোলাল বুঝি কোহিমাতে অনেকদিন ছিল?
হু-হু, অনেক দিন। আমি মাস কয়েক আগে ওকে দেখেছি। আমাদের বস্তির সারুয়ামারু, বুড়ো নড্রিলো, আমার বাপ সিজিটো–সবাই ওর দোকান থেকে নিমক নিত। মজাদার গল্প বলত মাথোলাল। কথা শেষ হলেই বলত, সীয়ারাম সীয়ারাম। তাই না রে মাথোলাল? বলতে বলতে মাধোলালের গায়ে হাত পড়তেই সেঙাই চমকে উঠল। দেহটা ভীষণ ঠাণ্ডা, হিমাক্ত। সেবার সালুয়ালা গ্রামের খাদে পড়ে গিয়েছিল সেঙাই। মেহেলী না বাঁচালে খাদের মধ্যে মরে থাকতে হত। সেই সাতকি রাত্রিতে হিমাক্ত দেহে মৃত্যুর লক্ষণ বুঝতে পেরেছিল সেঙাই। মরে গেলে কিংবা মরতে বসলে মানুষের দেহ বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
অপরিসীম আতঙ্কে সেঙাই চিৎকার করে উঠল, দ্যাখ দ্যাখ, মাধোলালটা কেমন ঠাণ্ডা মেরে গেছে।
ঠাণ্ডা মেরে গেছে। গলাটা কেঁপে গেল বসন্তর। একবার মাথোলালের গায়ে হাত দিলেন। তারপর তড়িৎগতিতে হাতখানা তার নাকের সামনে আনলেন। অনেকক্ষণ পর সন্দেহ ঘুচল। নাঃ, নিশ্বাস পড়ছে না।
মাথাটা নিচের দিকে ঝুলিয়ে ভগ্ন, দুর্বল গলায় বসন্ত বললেন, মাধোলাল নেই।
নেই! এই তো রয়েছে মাধোলাল! আহে ভু টেলো! কদর্য মুখভঙ্গি করল সেঙাই।
মাধোলাল মরে গেছে।
মরে গেছে!
নির্নিমেষ, বিমূঢ় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মাথোলালের দেহটার দিকে তাকিয়ে রইল সেঙাই। তারপর হঠাৎ একটা প্রবল কান্নার তোড় বুকটাকে চুরমার করে গলা ফাটিয়ে হু-হু–করে বেরিয়ে এল। মাধোলালের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেঙাই। ফুলে ফুলে, কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল। তার চোখ থেকে নোনা জল ঝরে ঝরে মাথোলালের মুখে মাখামাখি হতে লাগল।
সেঙাই-এর মাথার ওপর হাত রাখলেন বসন্ত।
কোহিমা পাহাড়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে, এমনকি নিজের অজান্তে সেঙাইকে এক নতুন জীবনের কথা শোনাবার ভার নিয়েছিল মাধোলাল। সেই মাধোলাল আজ মারা গেল। সেঙাই এর জীবনে তার ভূমিকা শেষ হল।
শিলং পাহাড়ে সেঙাইকে আর এক ব্যাপক, বিপুল এবং মার্জিত জীবনের শিক্ষা দেবার দায়িত্ব সজ্ঞানে নিয়েছে বসন্ত। মাধোলালের কাছ থেকে বসন্তর কাছে এই দায়িত্ব হস্তান্তর সেঙাই-এর সম্পূর্ণ অজান্তেই ঘটল।
হাউ হাউ শব্দ করে সেঙাই কাঁদছে। চুল ছিঁড়ছে। মাথোলালের দেহটাকে আঁচড়াচ্ছে, কামড়াচ্ছে।
সেঙাই–সে বন্য এবং হিংস্র। হত্যা কিংবা মৃত্যু তার কাছে বিচলিত হবার মতো ঘটনাই নয়। জীবনের সবরকম ভীষণতায় সে অভ্যস্ত। তবু মাধোলালের মৃত্যুতে সে কাঁদছে। লালসা, প্রতিহিংসা, আক্রোশ, কাম, তীব্র রতিবোধ–আদিম মানুষের উগ্র প্রবণতাগুলো এই মুহূর্তে তার মন থেকে মুছে গিয়েছে। একটি সুকুমার বৃত্তি তার স্ফুটনোন্মুখ চৈতন্যকে ভরে রেখেছে। সেটি হল মমতা, এবং মমতার সঙ্গে অপরিসীম বেদনা। বাইরে গাঢ় কুয়াশা জমেছে। পাহাড়ী চক্ররেখা ঘিরে সেই কুয়াশা স্তরে স্তরে তুলোর মতো ঝুলছে।
.
সেঙাই-এর মনে বেদনা ও মমতার জন্ম হল।
সেঙাই-এর আদিম জীবন শেষ হল।
[প্রথম পর্ব সমাপ্ত]