বসন্ত ভাবলেন, আসমুদ্রহিমাচল এই বিশাল, বিস্তীর্ণ ভারতবর্ষ। কোটি কোটি মানুষের এই দেশের আত্মা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় জ্বলছে। সমতলের শহর বন্দরের সুসভ্য মানুষই কেবল নয়, অরণ্যচারী এবং পাহাড়ী আদিবাসীরাও নতুন স্বপ্নে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। এদের শিক্ষাদীক্ষা নেই, সুশৃঙ্খল নেতৃত্ব নেই, শুধুমাত্র অফুরন্ত প্রাণাবেগ এবং উন্মাদনা সম্বল করে স্বাধীনতার লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
বসন্ত ভাবতে লাগলেন, সেঙাইকে শিক্ষাদীক্ষা এবং দেশকাল সম্পর্ক প্রয়োজনীয় ধারণা দেওয়া একান্ত উচিত। অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্যের সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা-জ্ঞানের মিলন ঘটলে এই সব আদিম মানুষ দেশকে নতুন শক্তি দেবে।
বসন্ত স্থির সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছুলেন, সেঙাই নামে ভারত সীমান্তের এক খণ্ড পাথরে তিনি অপরূপ ভাস্কর্য রচনা করবেন।
স্তব্ধ, নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রয়েছেন বসন্ত। লণ্ঠনের টিমটিমে আলোতে তাকে একটা ধাতুমূর্তির মতো দেখাচ্ছে।
.
৫১.
ভোর রাত্রির দিকে সেলের তালা খোলার শব্দ শোনা গেল। বসন্তের তন্ত্ৰামত এসেছিল। কম্বলের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল সেঙাই। ঘুম আসেনি।
হঠাৎ সেলের দরজাটা খুলে গেল। নিমেষের মধ্যে একটা ভারী দেহ ছিটকে এসে পড়ল সেঙাই-এর ওপর। বাইরে থেকে সিপাইরা ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারপরেই আবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
সেঙাই চিৎকার করে উঠল, ইজা হুতা! আমার ঘাড়ে এসে পড়েছিস শয়তানের বাচ্চা! একেবারে জানে লোপাট করে দেব। বর্শা দিয়ে ফুড়ে ফেলব।
মানুষটা জবাব দিল না, চুপচাপ পড়ে রইল।
ডান হাতের জখমী কবজিটা যন্ত্রণায় টাটিয়ে উঠেছে। কাতরাতে কাতরাতে একপাশে সরে বাঁ হাত দিয়ে লোকটার গলা খিমচে ধরল সেঙাই। সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ শোনা গেল, আঃ-আঃ-আঃ–
সেঙাই-এর চেঁচামেচিতে ধড়মড় করে উঠে বসেছিলেন বসন্ত। হামাগুড়ি দিয়ে লণ্ঠন হাতে সামনে এগিয়ে এলেন।
লোকটার মুখে আলো পড়তেই সেঙাই চমকে উঠে। শেষ রাতের সঙ্কীর্ণ, নিস্তব্ধ সেলটাকে শিউরে দিয়ে সে চিৎকার করে উঠল, তুই, তুই মাধোলাল! এই মাধোলাল, তোর কী হয়েছে? শয়তানের বাচ্চা, কথা বলছিস না কেন?
সেঙাই-এর স্ফুটনোম্মুখ মনে কতকগুলো ছায়া নড়াচাড়া করতে লাগল। কোহিমা শহর থেকে ডিমাপুরগামী সেই আঁকাবাঁকা সড়ক, তার পাশে সমতলের বেনিয়াদের বাজার, তেল লবণ-চাল, মোষের শিঙ, বাঘ-হরিণের ছাল, নানা রঙের নানা আকারের মনিহারী জিনিসের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে বাঁশের মাচানে বসে থাকত মাখোলাল। রানী গাইডিলিওর গল্প বলত, সমতল দেশের গল্প, গান্ধিজি নামে একটি মানুষের আজব কহিনি বলে সবার তাক লাগিয়ে দিত।
সেই মাধোলাল! তাজ্জবের ব্যাপার। শিলং শহরের জেলখানায় তার সঙ্গে দেখা হবে, এ কথা কি জানত সেঙাই? না, কস্মিনকালে ভেবেছিল?
সেঙাই আবার ডাকল, এই মাধোলাল, শোন না, আমার দিকে তাকা।
নির্জীব গলায় মাধোলাল আর্তনাদ করল, আঃ-আঃ-আঃ–
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল সেঙাই, তুই তো এখানে আঃ-আঃ–করছিস! কোহিমায় তোর দোকানটা যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে রামখোর বাচ্চারা! শুনলি রে শয়তান, তোর দোকানে কিছু নেই, সব লোপাট করে দিয়েছে।
চোখের পাতা দুটো অতি কষ্টে মেলল মাধোলাল। রক্তাভ, ঘোর ঘোর চোখ। জড়ানো বিকৃত গলায় বলল, কে? কখন এলি? আয় বাপ বুধোলাল–
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সেঙাই গর্জে উঠল, আহে ভু টেলো! আমাকে চিনতে পারছিস না রে ধাড়ি টেফঙ! আমি তো সেঙাই। সারুয়ামারুর সঙ্গে তাদের দোকানে গিয়েছিলাম। তুই বানী গাইডিলিওর গল্প বলেছিলি। আসান্যুদের সদ্দার গান্ধিজির গল্প বলেছিলি। মনে পড়ছে না তোর! ইজ হুকুঙ তা।
চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে বুজে আসছে। কোনোক্রমে অর্ধেক চোখ মেলে তাকাল মাধোলাল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর অস্পষ্ট গলায় নাগা ভাষায় বলতে লাগল, বড় দরদ হচ্ছে। সায়েবরা মাজায় বন্দুকের গুলি করেছিল। দাওয়াই দেয়নি। আঃ-আঃ-আঃ–
শেষ পর্যন্ত আর কথাগুলো শোনা গেল না। একটানা গোঙানি শুরু হল।
এতকাল নাগা পাহাড়ে কাটিয়েছে। আজমিড় কি মাড়োয়ারের সেই দেহাতি গ্রাম এবং মাতৃ ভাষাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছে মাধোলাল, নাগা ভাষাতেই সে কথা বলে।
সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, সায়েরা তোকে ছুঁড়েছে, রামখোর বাচ্চারা আমাদেরও খুঁড়েছে। ওদের সব কটাকে খতম করব। বলতে বলতে মাধোলালকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। একটু পর মাধোলালকে ছেড়ে বসন্তর দিকে তাকাল সেঙাই। বলল, হুই যে। তোকে মাথোলালের কথা বলেছিলাম, এই সেই মাধোলাল। সায়েব শয়তানরা ওকে ছুঁড়েছে।
বুঝেছি। লণ্ঠনটা নিয়ে মাথোলালের ওপর ঝুঁকে পড়লেন বসন্ত। তলপেট, কোমর, এমন। কি উরু পর্যন্ত অস্বাভাবিক ফুলে রয়েছে। কোমরের কাছে একটা ক্ষতমুখ। লালচে থকথকে রস গড়িয়ে আসছে। পাটকিলে রঙের পচা মাংস থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। দেখতে দেখতে শিউরে উঠলেন বসন্ত। আতঙ্কে চোখ দুটো বিস্ফারিত হল তাঁর। গ্যাংগ্রিন। কী বীভৎস! কী ভয়ানক!
সেঙাইও দেখছিল। মাধোলালের কোমরে ক্ষত দেখতে দেখতে অনেক দিন আগে সালুয়ালা গ্রামের খোনকের কথা মনে পড়ল। সেদিন খোনকের বুকে বিরাট ক্ষত দেখে হিংস্র উল্লাসে মনটা ভরে গিয়েছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে মাধোলালের দগদগে ঘা দেখতে দেখতে কী এক দুর্বোধ্য এবং অসহ্য বেদনায় শিরাস্নায়ুগুলো পাকিয়ে পাকিয়ে ছিঁড়ে পড়তে লাগল। হৃৎপিণ্ডটাকে দলে-মুচড়ে তীব্র, অদম্য কান্নার বেগ গলার ভেতর থেকে ছুটে আসতে চাইল।