পরের দিন খবরের কাগজে বসন্ত পড়েছিলেন, জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মারা যাননি। দেহাতি কয়েকটি শিশু এবং নারী হতাহত হয়েছে।
চারিদিকে পুলিশের খানাতল্লাশ শুরু হল। হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশ আসামীদের ধরবেই।
বেগতিক দেখে দাদারা পাঞ্জাবে শারোয়ান সিংয়ের আস্তানায় চলে যেতে বললেন। এক বছর পাঞ্জাবে লুকিয়ে ছিলেন বসন্ত।
এই এক বছরের প্রতিটি মুহূর্ত তিলে তিলে মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তিনি। নিরীহ শিশু এবং নারীদের হত্যাকারী হিসাবে মনে হয়েছে নিজেকে। অস্বস্তিকর এক অনুভূতি সবসময় তাকে তাড়া করে বেড়াত। পাশের মুসলমান কয়েদিটির মতো কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। কেমন এক আতঙ্ক সারাক্ষণ শ্বাসনালীটাকে চেপে ধরে থাকত। পৃথিবীতে এত বাতাস, তবু মনে হত, নিশ্বাস নেবার মতো পর্যাপ্ত নয়। এত অফুরন্ত আলো, তবু মনে হত, সব অন্ধকার। রাতে চোখ দুটো ঘুমে বুজে এলেই চারপাশে শিশু এবং নারীর আর্তনাদ শুরু হত। চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে বসতেন বসন্ত। অসহ্য, অসহ্য।
আত্মপীড়নের মাত্রাটা যখন চরমে উঠত, তখন নিজের রায় নিজেই ঠিক করে ফেলতেন বসন্ত। হ্যাঁ, ফাঁসিই হওয়া উচিত তার। এক-এক সময় মনে হত, পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাবেন।
এমন করে সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী মনটা একদিন মরে গেল। নতুন ভাবনার পুঞ্জ পুঞ্জ আলো এসে পড়ল তার চিন্তায়। মেল ডাকাতি, দু-একটা খুনখারাপি কিংবা খণ্ড খণ্ড সন্ত্রাস সৃষ্টি করে দেশের এবং দেশের মানুষের কোনো মৌলিক পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, এই সন্ত্রাসবাদের মধ্যে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে ভীতি এবং আতঙ্ক। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় সন্ত্রাসবাদীকে। আত্মগোপন করে থাকতে হয়। নিজের অজান্তেই বোমা-পিস্তলের। রোমান্সের সঙ্গে মনের মধ্যে অপরাধবোধ লুকিয়ে থাকে। রোমান্সের জলুস নিভলে সেই বোধটা মাথা চাড়া দেয়। তখন অবস্থা মারাত্মক হয়ে ওঠে। বসন্ত ভাবলেন, এ পথে গন্তব্যে পৌঁছুনো সম্ভব হবে না।
দ্বিধায় যখন মন দুলছিল তখন পায়ের সামনে আরেকটা পথ পাওয়া গেল। সে পথ অহিংস সত্যাগ্রহের। অসহযোগের। সত্যাগ্রহ করেই এক বছর শিলং জেলে আটক রয়েছেন বসন্ত। এ পথে অপরাধীর মতো লুকিয়ে চুরিয়ে বেড়াতে হয় না। সগৌরবে মাথা উঁচু করে চলা যায়।
সত্যাগ্রহে দীক্ষা নিয়ে নতুন জন্মলাভ হয়েছিল বসন্তর।
আজকের অনেক পরিণত বসন্ত সেন ভাবেন, দেহই শুধু বাঁচন এবং মরণশীল নয়, মনও।
আচমকা পাশের সেলে সেই গোঙানি শোনা গেল, হা আল্লাহ-হ-হ–এবার গলার আওয়াজ তেমন উচ্চ কিংবা তীক্ষ্ণ নয়। কেমন যেন নির্জীব। বোধ হয়, হতাশার শেষ সীমায় এসে পড়েছে লোকটা।
কম্বল মুড়ি দিয়ে সেঙাই শুয়ে ছিল। মুখ বাড়িয়ে বলল, কে কাঁদে রে?
বসন্ত জবাব দিলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন।
৫০. শিলং পাহাড়ে আসার পর
৫০.
চুপচাপ শুয়ে ছিল সেঙাই। ঘুম আসছে না।
শিলং পাহাড়ে আসার পর দুটো দিন পার হয়ে গেল। এই দু দিনে আদিম বুনো মনের বয়স যেন হঠাৎ অনেক বেড়ে গিয়েছে। কাল সমস্ত দিন চেঁচামেচি করেছে সেঙাই, কেঁদেছে, নিরুপায় আক্রোশে অশ্রাব্য গালাগালি করেছে, নিজের চুল মঠো মুঠো ছিঁড়ে ফেলেছে। খিমচে কামড়ে বসন্তকে ক্ষত বিক্ষত করেছে। কিন্তু আজ একেবারে চুপচাপ, নিঝুম পড়ে রয়েছে।
সেঙাই ভাবছে। তার ভাবনাটা সোজা সহজ খাতে বইছে না। চিন্তাগুলোও শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়। তার ভাবনাগুলোকে গোছগাছ করে নিলে মোটামুটি এরকম দাঁড়ায়।
কোথায়, কত দূরে, ছয় আকাশ ছয় পাহাড়ের ওপারে তাদের ছোট গ্রাম কেলুরি পড়ে রইল। তাদের জোহেরি কেসুঙ, আঁকাবাঁকা টিজু নদী, পাহাড়-জলপ্রপাত-মালভূমি, চড়াই এবং উতরাই, সেই অরণ্য-আদিম জীবজগৎ–সেখানে কি আর কোনোদিনই ফেরা যাবে? শত্রুপক্ষের জোয়ানী মেহেলীকে কি বিয়ে করা সম্ভব হবে? নানকোয়া গ্রামের বাঘমানুষ মেজিচিজুঙের সঙ্গে হয়তো এই সাঙসু ঋতুর রাত্রিতে মেহেলীর বিয়ে হচ্ছে। হয়তো সালুয়ালাঙ এবং নানকোয়া বস্তির শয়তানগুলো বিয়ের উৎসবে বাঁশের চোঙা ভরে আকণ্ঠ রোহি মধু গিলে, সাদা শুয়োরের মাংস চিবুতে চিবুতে হস্লা করছে। নাচ-গান-বাজনা এবং উল্লাসে সালুয়ালাঙ গ্রামটা মেতে উঠছে। অসহ্য, অসহ্য। বুকের মধ্যে রাগ এবং যন্ত্রণা মোচড় দিতে থাকে।
মেহেলীর কথা ভাবতে ভাবতে চিন্তাটা হঠাৎ অন্য দিকে ঘুরে গেল। সেঙাই ভাবতে লাগল, তাদের গ্রামটাকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়েছে সাহেবরা। ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়েছে। জোয়ানদের বন্দুক দিয়ে খতম করেছে। গর্ভিণী জামাতসুকে পেটে লাথি মেরে সাবাড় করেছে। বুড়ি বেঙসানুকে বুকে গুলি মেরে শেষ করেছে। কেলুরি গ্রামের আর তাদের কত বড় বনেদি বংশের ইজ্জত নষ্ট করেছে। নানকোয়া আর সালুয়ালাঙ বস্তির জোয়ানরা মেহেলীকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ভাবতে ভাবতে ফুঁসতে লাগল সেঙাই, চোখের তারাদুটো জ্বলতে লাগল। না না, কাউকে সে রেহাই দেবে না।
ছোট্ট সেল। একপাশে টিমটিমে তেলের লণ্ঠন।
ওধারে গরাদের পাশে বসে ছিলেন বসন্ত। নিজের ভাবনা এবং জীবনধারায় পরিবর্তন ইত্যাদি নানা বিষয়ে চিন্তা করছিলেন। তার দৃষ্টি হঠাৎ সেঙাই-এর ওপর এসে পড়ল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। সেঙাই আসার পর থেকেই একটা নতুন ভাবনা অস্পষ্টভাবে মনের মধ্যে উঁকি মারছিল। এই মুহূর্তে, হঠাৎ সেটা অত্যন্ত স্পষ্ট হল, রাশি রাশি আলোক কণিকার মতো মনের ওপর ছড়িয়ে পড়ল।