জেলখানায় বসে বাইরের খবর ঠিকমতো পাওয়া যায় না। যা আসে তা ছাড়া ছাড়া, টুকরো টুকরো। সেগুলো থেকে ধারাবাহিক ছবি ধরা যায় না। কল্পনা দিয়ে ফাঁক ভরাট করতে হয়।
অনেক সময় উৎকণ্ঠায় আশঙ্কায় সংশয়ে দৃঢ় কঠোর আশাবাদী মন আকীর্ণ হয়ে থাকে। দেশ কি ঠিক পথে চলেছে? কোন মত এবং পথে সিদ্ধি? সন্ত্রাসবাদ না অহিংস সত্যাগ্রহ? নানা চিন্তা, নানা জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে জটলা পাকায়। এক-এক সময় সন্দেহ জাগলে বড় দুর্বল হয়ে পড়েন বসন্ত। নৈরাশ্য আসে। কিন্তু আজ সেঙাইকে দেখতে দেখতে উত্তর পূর্ব ভারতের বন্য আদিম জোয়ানটির মধ্যে সমগ্র দেশের আকাঙ্ক্ষার স্পন্দন শুনে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, না না, স্বাধীনতা আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অসম্ভব। আমরা দেখব, শয়তানেরা আর কত অত্যাচার করতে পারে।
সেঙাই বলল, তুই কী বলছিস, কিছুই যে বুঝতে পারছি না রে ধাড়ি টেঙ।
তন্ময় হয়ে ছিলেন বসন্ত। একটু চমকে উঠলেন। উত্তেজনায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই বিভ্রান্তির পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে দ্বিতীয় রিপু। মুহূর্তের জন্য সত্যাগ্রহীর অনুশাসনগুলি ভুলে গিয়েছিলেন, আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন। সত্যাগ্রহের পথ বড় দুর্গম। ছয় রিপু এবং পঞ্চেন্দ্রিয় দমন। করে এ পথে হাঁটার অধিকার পাওয়া যায়।
সেঙাইকে দেখে মাত্রাছাড়া, বেপরোয়া উত্তেজনা হয়েছিল। রাগের বশে সত্যাগ্রহীর পক্ষে অশোভন কটুক্তিও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু আজ আর সেজন্য বিশেষ অনুশোচনা হচ্ছে না।
উত্তর পূর্ব সীমান্তে অরণ্য-আদিম পাহাড়ী দেশেও যে নতুন জীবনবোধ জেগেছে সে খবর। এনেছে সেঙাই।
অপরিসীম আশায়, উদ্দীপনায় এবং আনন্দে সমস্ত হৃদয় ভরে গেল বসন্তর। .
.
৪৯.
শিলং শহরের ওপর রাত্রি ঘন হচ্ছে। ছোট্ট সেলের মোটা গরাদের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বসন্ত। গাঢ় ধোঁয়ারঙের কুয়াশার স্তরগুলি পাহাড়ের চূড়া ঢেকে রেখেছে। পাইনের পাতায় পাতায় বাতাসের একটানা সোঁ সোঁ শব্দ। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। বাতাসের আওয়াজ ছাড়া পাহাড়ী রাত্রি কী নিঃসাড়, কী ভীষণ নিস্তব্ধ!
অবশ্য থেকে থেকে নিঝুম রাতের আত্মা বিদীর্ণ করে আর্তনাদ উঠছে। উচ্চ, তীক্ষ্ণ এবং প্রাণফাটা কান্না একটু একটু কমে গোঙানির রূপ নিয়ে থেমে আসছে, ইয়া আল্লাহ-হ্-হ্–
পাশের সেলে মুসলমান কয়েদিটা কয়েক রাত্রি ধরে সমানে কাঁদছে। নিজেও ঘুমোয় না, আশেপাশের কাউকে ঘুমোতেও দেয় না। কদিন ধরে কিছু খাচ্ছে না, কারো সঙ্গে কথা বলছে না। সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মতো দূরের পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, আর রাত্রি হবার সঙ্গে সঙ্গে মাত্র দু’টি শব্দ করে কাঁদে, ইয়া আল্লাহ-হ্-হ্–
দিন পাঁচেক আগে রায় বেরিয়েছে, জরু হত্যার অপরাধে ফাঁসি হবে লোকটার। দিন কুড়ি পরেই বুঝি ফাঁসির দিন স্থির হয়েছে।
এখন বুক চাপড়ে কাঁদছে সে, হতভাগাটা বোধ হয় পাগল হয়ে যাবে।
বসন্ত ভাবছিলেন। নানা চিন্তা, অসংখ্য ঘটনা মনের মধ্যে একাকার হয়ে, বলা যায়, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। করাত ধরেই তার সমানে মনে হচ্ছে, জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানে কী দুর্বিষহ যন্ত্রণাই না লোকটার মধ্যে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ কান্না থামিয়ে দিল লোকটা।
অনেকক্ষণ পর বসন্তর ভাবনা অন্য একটি খাত বেয়ে ছুটতে লাগল। নিজের জীবনের কথা মনে পড়ল। কত বার যে পাশের সেলের কয়েদিটার মতো জীবন এবং মৃত্যুর সীমান্তে তাকে দাঁড়াতে হয়েছে, বাঁচার প্রবল আকাঙ্ক্ষা এবং মৃত্যুর আতঙ্কে উন্মাদ হতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
প্রতি মুহূর্তে মত-পথ-বিশ্বাস-আস্থা হারানো এবং প্রাপ্তির মধ্যে কখনও মনে হয়েছে, শেষ হয়ে গেলেন। পরক্ষণে নতুন আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছেন।
বসন্ত ভাবছিলেন।
সাত হাত লম্বা, সাড়ে পাঁচ হাত চওড়া ছোট সেলের মধ্যে ওঠাবসা ছাড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করার উপায় নেই। এক পা এগুলেই পায়ের নিচে জমি ফুরিয়ে যায়। দেওয়ালে কপাল ঠুকে যায়। বসে বসে চিন্তা করা, অর্থাৎ মনকে সক্রিয় এবং সঞ্চালিত করা ছাড়া কোনো কাজ নেই। তাই বসন্ত ভাবেন।
হঠাৎ একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল।
বছর তিনেক আগের কথা। সন্ত্রাসবাদে তখন অসীম আস্থা বসন্তর। সে সময় তার ধারণা, রক্তক্ষয় ছাড়া স্বাধীনতা অসম্ভব।
সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কাটিহারে গিয়েছিলেন তিনি। কিষেণগঞ্জ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেরিয়েছিলেন সফরে। পথে কাটিহার স্টেশন পড়বে।
স্টেশন থেকে খানিক দূরে বাঁশবনে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে ছিলেন বসন্ত, পাশে দশ জন সঙ্গী। হাতে হাত-বোমা।
নিঝুম ঘুটঘুটে রাত। পাল্লা দিয়ে ঝিঁঝির দল একটানা বিলাপ করে চলেছে। কোথায় ব্যাঙ ডাকল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। জোনাকির সবুজ আলো জ্বলছে নিভছে, নিভছে জ্বলছে। হঠাৎ দমকা বাতাস হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল বাঁশবনে, মটমট শব্দ হল। এগারোটি রুদ্ধশ্বাস মানুষ চকিত হয়ে উঠল।
ট্রেনটা স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে একচক্ষু সিগন্যাল পোস্টটা পেছনে ফেলে বাঁশঝোঁপের কাছাকাছি এসে পড়ল।
মনে আছে, প্রচণ্ড উত্তেজনায় মেরুদণ্ড হঠাৎ টান টান হয়ে গিয়েছে। হৃৎপিণ্ডটা শব্দ করে থেমে গেল। হাত থেকে নিজের অজান্তে বোমাটা ছুটে গিয়েছিল। একটা ভয়ঙ্কর শব্দ, তারপর পর পর আরো দশটা। চক্ষের পলকে তাণ্ডব ঘটে গেল। আর্তনাদ, চিৎকার, ঘস্স্স্ করে ট্রেন থামার শব্দ। তারপর কী হয়েছিল, মনে নেই। শূন্য রুক্ষ মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে মনে হয়েছিল, একটা অস্বাভাবিক আতঙ্ক অন্ধকারে বিরাট রোমশ হাত বাড়িয়ে পিছু পিছু ছুটে আসছে।